ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুভাষ সিংহ রায়

বই এবং বই নিয়ে মেলা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

বই এবং বই নিয়ে মেলা

(শেষাংশ) ॥ তিন ॥ এমন অবস্থা সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্প আছে এবং তার একটা ইতিহাসও আছে। ১৮৬০-এ ঢাকা থেকে ‘নীলদর্পণ’ প্রকাশিত হওয়ার ঘটনা কি কম গৌরবের? বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁ পারিল নওয়াধা থেকে প্রকাশিত ‘পারিল বার্তাসহ’ সেই কোনকালে (১৮৪১) প্রকাশিত হয়েছিল। এমনিভাবে কুষ্টিয়া, রাজশাহী ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর এবং ঢাকা থেকে একশ’ বছর আগেও পত্রপত্রিকা এবং বই প্রকাশিত হয়েছে। সেসব প্রকাশনার কিছু কিছু আজকের মানেও ফেলনা নয়। উদাহরণ : কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ বা হিতকরী, রংপুর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা বা ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত ‘সৌরভ’। চট্টগ্রামের বইঘর, ঢাকার মাওলা ব্রাদার্স, নওরোজ কিতাবিস্তান, প্রকাশ ভবন, খান ব্রাদার্স প্রভৃতি সংস্থার প্রকাশনা নতুন প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ১৯৬০-এর দশকে পূর্ববাংলার যে অসাম্প্রদায়িক বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনা গড়ে উঠতে থাকে তার পেছনে এসব সংস্থার বইয়ের অবদান কম নয়। স্টুডেন্ট ওয়েজ ‘রবীন্দ্রনাথ’, মাওলা ব্রাদার্সের বদরুদ্দীন উমরের গ্রন্থসমূহ, শওকত ওসমানের তীক্ষè, তির্যক রচনাসমূহ, আবদুল হকের স্বনাম ও ছন্দনামে লেখা কিছু প্রবন্ধ, সত্যেন সেনের বিস্ফোরণমূলক আত্মপ্রকাশ, ‘সমকাল’ পত্রিকার নানা লেখা সেকালে চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এবার বাংলা একাডেমির বইমেলার কথা। আমরা বলছি, বাংলা একাডেমির বইমেলার রূপ, রং ও চরিত্র আলাদা অন্য কোন দেশের বইমেলার সঙ্গে একে তুলনা করা যায় না। এই মেলা গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অন্যন্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ সময়ে ও পরিস্থিতিতে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ২০-২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। এর আয়োজক ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। ওই বছরকে ইউনেস্কো ‘জাতীয় গ্রন্থবর্ষ’ ঘোষণা করে। দেশের প্রকাশকরা ছাড়াও ৮টি দেশ এতে অংশ নেয়। গ্রন্থকেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক মরহুম সরদার জয়েনউদ্দীন ছিলেন এর মূল সংগঠক। ওই বইমেলা উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সেমিনারেরও আয়োজন করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে ছিল উৎসবের আমেজ। তার পেছনে ছিল সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা। ১৯৭৪ সালের সাহিত্য সম্মেলনের প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সুলিখিত নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন। তার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি বিশেষ গুরুত্ব পায়। তবে বঙ্গবন্ধুকে মঞ্চে বসিয়ে রেখেই একটি আগুন ঝরানো ভাষণ দিয়েছিলেন কবি জসীম উদ্দীন। কাগজ, কালি ও মুদ্রণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির তীব্র প্রতিবাদে সে ভাষণটি ছিল অনন্য। ওই সম্মেলনে ভাষণটি একটি প্রতিবাদী মাত্রা যোগ করে। সরকার প্রধানের উপস্থিতিতে এমন সমালোচনা সরকারের সহনশীলতার পরিচায়ক। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর ঘোর অমানিশার অন্ধকার নেমে আসে। সংস্কৃতি রাজনীতি ক্ষেত্রে পক্ষে-বিপক্ষে তখন বাঙালী-বাংলাদেশী বিতর্ক সোচ্চার। তবে ব্যাপকসংখ্যক তরুণ তখন পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোন তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবাদী চেতনা সৃষ্টি করেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা-ের প্রতিবাদে প্রকাশিত সংকলন-‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’। ॥ চার ॥ আমাদের বইমেলা পাঠক সৃষ্টি করতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান গত বছর ২৭ জানুয়ারির আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমাদের বাংলা সাহিত্যের অন্তত : পাঁচ সাতজন নোবেল পেতেন যদি ভাল ইংরেজী অনুবাদ হতো।’ ১৯২৫ সালে জজ বার্নাড শ নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পান। তিনি সেই অর্থ ব্যক্তিভাবে খরচ করেননি। ওই টাকায় এ্যাংলো সুইডিশ লিটারারি ফাউন্ডেশন গঠন করেন। সেই সমিতির উদ্দেশ ছিল সুইডিশ সাহিত্যের ভাল ভাল বই ইংরেজীতে অনুবাদ করা। বাংলা একাডেমি এখন অনুবাদ সাহিত্যের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে। সম্প্রতি বাংলা সাহিত্যে অনন্য সৃষ্টি মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’র অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ফ্রাঙ্কফুটের বইমেলায় গিয়ে ভাল করে বুঝেছি বাংলা সাহিত্যকে বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে দিতে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। পৃথিবীর ওই বইমেলায় বাংলাদেশকে ‘থিম কান্ট্রি’র মর্যাদা পেতে হবে। তার জন্য দরকার আমাদের সাহিত্যের বড় বড় সৃষ্টিগুলো ইংরেজীতে অনুবাদ করে বিশ^সভায় উপস্থাপন করা। ইংরেজ পড়া পাঠকের সংখ্যা এখন নেহাৎ কম নয়। দু’তিন বছর যাবৎ ‘লেট ফেসটিভল’ এ পাঠক সমাবেশ বেশ ছিল। এখন অমর একুশের গ্রন্থমেলায় বড় বড় প্রকাশরা ১০০টা বই এর মধ্যে ১০টা বই ইংরেজী ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন। আমরা জানি, গণতন্ত্র ও মুদ্রণ অঙ্গাঙ্গি সম্বন্ধে যুক্ত। সুনাগরিক গড়ে তুলতে জনগণের হাতে বই তুলে দেয়া দরকার পুঁথির যুগে এটা সম্ভব ছিল না। বইয়ের মাধ্যমে নানা ভাবনার সংমিশ্রণে ব্যক্তিগত ধারণা ও বিশ^াস দৃঢ় হয়। যেসব নাগরিক নিজস্ব সুচিন্তিত মতবাদের ওপর আস্থাবান তারাই গণতন্ত্রের সম্পদ। আর এ রকম নাগরিক পেতে হলে দেশের লোকের হাতে বই দিতে হবে, অনেক বই নানা বিষয়ের এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা বই। শুধু বই নয়, পত্র-পত্রিকাও। বইয়ের বিকল্প যদি বা পুঁথির মধ্যে সামান্য কিছু পাওয়া যায় পত্রিকার প্রভাবশালী জগত একান্ত মুদ্রাযন্ত্রের সৃষ্টি। সংবাদপত্র দেশ ও পৃথিবীকে আমাদের ঘরের মধ্যে এনে দিয়েছে। বই ও পত্রিকার প্রচার না ঘটলে জাতীয়তাবোধ এবং আন্তর্জাতিক ভাবনার বিকাশ ঘটত কিনা সন্দেহ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গ্রন্থ প্রকাশনা সহজ করার স্বার্থে একটি জাতীয় গ্রন্থনীতি প্রণয়ন করেছে। একই সঙ্গে সরকার প্রকাশকদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রকাশক পল্লী ও প্রকাশকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। গত বছর বইমেলায় স্টলের ইউনিট সংখ্যা ছিল ৬৫০; এবারের স্টল ইউনিটের সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৫০-এর মতো। গত বছর বই মেলায় বই বিক্রি হয়েছে ৬০ কোটি ৪০ লাখ টাকার, তার আগেরবার বিক্রি হয়েছিল ৪০ কোটি ৫০ টাকার। মুদ্রণের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দান হলো জ্ঞানের মুক্তি। মুদ্রণ-পূর্ব যুগে জ্ঞানের একমাত্র উপকরণ কয়েকটি পুঁথি কয়েকজনের করায়ত্ত ছিল। তাঁরা ছিলেন বিদ্যার পুঁজিপতি। শিষ্যগুরুকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে বিদ্যালাভ করা সম্ভব না। শিক্ষার্থীদের জাত বিচার করা হতো, সকলের পড়াশোনার অধিকারও যারা পেত তাদেরও অবাধে পুঁথির ব্যবহার করতে দেয়া হতো না। গুরু পড়ে যেতেন, শিষ্যরা শুনে মুখস্থ করত। এই ছিল সাধারণ রীতি। গুরুর অনুমতি ছাড়া পুুঁথি কেউ নকল করে নিতে পারত না এবং এই অনুমতি ছিল দুর্লভ। মিথিলা থেকে ন্যায়ের পুঁথি নকল করে আনার অনুমতি না পেয়ে ন্যায় শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে মিথিলা হীনপ্রভ হয়ে পড়ল, খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল নবদ্বীপের। সকলের কাছে যদি পুঁথি সহজলভ্য হয় তা হলে জ্ঞানের রাজ্যে গুরুর আধিপত্য ক্ষুণœ হবার আশঙ্কা থাকে। সে অবস্থা থেকে অনেক অনেক উন্নতি হয়েছে। জ্ঞান অন্বেষণে বই এর কোন বিকল্প নেই। বইমেলা পাঠকদের কাছে বইকে তুলে ধরে। আমরা জানি অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুধু বইমেলা নয়; বাঙালী জাতির আবেগ, অনুভূতি, সংস্কৃতি ঐতিহ্যের এক মহাসম্মেলন। প্রতি বছর ফিরে আসে এই বইমেলা। তাই স্পষ্ট করেই বলা যায়, এই বইমেলা পৃথিবীর আর দু’পাঁচটা বইমেলার মতো না। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×