ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যাহিদ হোসেন

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

॥ পর্ব-১ ॥ পাকিস্তানীদের সুকল্পিত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক শাসন ও শোষণের হাত থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের শুরু মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে যার পরিসমাপ্তি ঘটে আমাদের একাত্তরের গৌরবোজ্জ্বল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন শরীফ শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রণীত রিপোর্ট বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়ে গ্রেফতার হয়ে ঢাকা সেনানিবাসে কয়েকদিন বন্দী ছিলাম। সে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাঙালীর প্রতি আচার-আচরণ এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব সরাসরি প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা হয়। এছাড়া ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত একটা গ্রন্থের জন্য পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড কর্তৃক প্রদত্ত সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য পাকিস্তানে গিয়ে লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ, মারী, পেশোয়ার, করাচিসহ আরও কয়েকটি শহর ঘুরে দেখার সময়ে পাকিস্তানের ভাষা, সংস্কৃতি, চালচলন, রাজনীতি ও জীবনবোধ যে আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন তা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগও হয়। ১৯৭১ সালে ঢাকার একটি সরকারী কলেজে লেকচারার হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। ছাত্রজীবনে ইংরেজী দৈনিক মনিং নিউজের ইউনিভার্সিটি করেসপনডেন্ট এবং পরে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে সরকারী কলেজের লেকচারার হিসেবে যোগদান করার পরও মনিং নিউজ ও পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয়ে মাঝে মধ্যে লেখালেখি করার সুযোগ হয়। সম্ভবত একাত্তরের মার্চ মাসের ১২ অথবা ১৩ তারিখে তৎকালীন ইংরেজী দৈনিক পিপল-এ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন শিরোনামে আমার একটি লেখা ছাপা হয়। সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বলার চেষ্টা করা হয়Ñ তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চল থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ সদস্যপদ দখলকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জেডএ ভুট্টোর নানাবিধ ঘোষণাসমূহ সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সামরিক জান্তাদের কেউই পাকিস্তানের নেতৃত্ব বাঙালীদের হাতে হস্তান্তর করতে কোনভাবেই সম্মত হবে না। তাই তৎকালীন বাঙালী রাজনৈতিক নেতাদের পাকিস্তানের নেতৃত্ব গ্রহণের প্রচেষ্টা চিরতরে নির্মূল করার পরিকল্পনা করছে তারা। দৈনিক পিপল-এ আমার লেখাটি ছাপা হবার পর থেকেই আমার বন্ধুরা বিশেষ করে সাংবাদিক বন্ধুরা ও সরকারী চাকরিতে কর্মরত আমলা বন্ধুরা সাবধানে চলাফেরা করা, যেখানে সেখানে না যাওয়া এবং পাবলিক প্লেসে কথাবার্তা সাবধানে বলার পরামর্শ দেয়। কারণ যেহেতু আমি সরকারী চাকরি করতাম তাই। এই বন্ধুদের মধ্যে শহীদুল হক ও গোলাম রসুল মল্লিক ইতোমধ্যে মারা গেছেন। রাহাত খান ও ফেরদৌস কোরেশী এখনও সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত। নাসিম আহম্মদ শুনেছি পাকিস্তানে সম্পাদক হিসেবে কোন একটা কাগজে কাজ করছে। আমলা বন্ধুদের অনেকেই ইতোমধ্যে সরকারের সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছে। যাই হোক, ২৫ মার্চ রাতে যখন জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা তাদের পূর্ব পরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে অভিহিত বাঙালী নিধন অভিযান শুরু করে তখন আমার বাসস্থান ছিল আজিমপুরে। সরকারী কোয়ার্টার্সে। সেটা নিউ মার্কেটের দক্ষিণ দিকের গেটের সামনে। পরে স্বনামে আকাশবাণী প্রচারিত ‘জবাব দাও’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কারণে আমার মালামাল ও অন্যান্য আবাসপত্র লুট করিয়ে দিয়ে অন্যের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়। এদিকে ২৭ মার্চ থেকে সরকারী ও আধা সরকারী অফিসের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কাজে যোগদান করার জন্য রেডিও টিভির মাধ্যমে সরকারী ঘোষণা প্রচার হওয়া শুরু হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ নির্দেশ ছিল। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত অফিসে যোগদান না করার জন্য। তাই ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করলেও অফিসে যাওয়া থেকে বিরত ছিলাম এবং নানা উপায়ে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করি এবং ৬ এপ্রিল ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করি। সেখান থেকে সময় ও সুযোগ মতো সড়কপথে ৬/৭ দিন বাধা বিঘœ অতিক্রম করে বাগডা বর্ডার হয়ে চলে যাই বনগাঁ। তবে বর্ডার অতিক্রম করে মুজিবনগরে প্রবাসী সরকারে যোগদান করার পূর্বে যে কয়দিন ফরিদপুর ও গ্রামের বাড়িতে ছিলাম বিশেষ করে মুজিবনগর সরকার গঠনের পর থেকে সবসময়ই থাকতাম উত্তেজিত এবং প্রতিদিনই সরকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় কাহিনী শোনার জন্য থাকতাম উদগ্রীব। দিনগুলো মোটামুটিভাবে কাটতো অধিক আগ্রহে যে কবে সম্ভব হবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুজিবনগর সরকারের একজন হয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের সেই সাহসী, দেশপ্রেমিক ও ত্যাগী জনতার প্রচেষ্টার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের। বনগাঁ থেকেই জানতে পারলাম, আমার আত্মীয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা এবং এমএনএ কেএম ওবায়দুর রহমান তার এলাকা থেকে আগত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ছেলেকে আপাতত আশ্রয়স্থল হিসেবে কলকাতার ১১৬নং ইলিয়ট রোডে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছেন এবং আমারও সেখানে গিয়ে থাকার সুযোগ হলো। ৮নং থিয়েটার রোডে গিয়ে রিপোর্ট করলাম এবং কয়েক দিনের মধ্যেই ওবায়েদ ভাই জানালেন যে, সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতার বিষয় বিবেচনা করে মুজিবনগর সরকার আমাকে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্বভাব অর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি পরের দিনই তৎকালীন প্রতিরক্ষা সচিব মরহুম আঃ সামাদের সঙ্গে দেখা করে কাজ শুরু করতে বললেন। প্রতিরক্ষা সচিরের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি ওই মুহূর্ত থেকেই কাজ শুরু করার নির্দেশ দিলেন। আমার করণীয় কাজটা কি হবে সে সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ব্রিফিংও তিনি দিলেন এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বেলায়েতের সঙ্গে এবং ওই সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একমাত্র ডেপুটি সেক্রেটারি আকবর আলি খানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আকবর আলি ও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলাম এবং চার বছর একত্রে এসএম হলে ছিলাম তাই তাকে পেয়ে আরও ভাল লাগল। ও শুধু একজন ভাল ছাত্রই ছিল না; একজন ভাল ও দক্ষ পরামর্শক ছিল। ওর সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে সব সময়ই বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ হতো এবং আমাদের ওপর অর্পিত সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারের দায়িত্ব পালনে ও বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। আরও পরে অবশ্য আমাদের সঙ্গে যোগদান করেছিলেন কবি আল মাহমুদ ও সাংবাদিক আল মুজাহিদী। আমাদের বসার জন্য আলাদা কোন রুম ছিল না; এমনকি কোন আলাদা টেবিলও ছিল না। আমরা সবাই মূলত প্রতিরক্ষা সচিবের টেবিলে গোল হয়ে বসতাম। টেবিলটা মূলত ছিল তৎকালীন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ প্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারের। তিনি অধিকাংশ সময়ে বিভিন্ন সেক্টরে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ব্যস্ত থাকতেন। জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার এবং পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বাংলাদেশে কখন কি করছে এবং কি ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছে সে বিষয়ে সম্যক এবং সর্বশেষ তথ্যাবলী সম্পর্কে অবহিত হবার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে একটা ছোট রেডিও কিনে দেয়া হয়েছিল যা মোটামুটি সব সময়ই হাতের কাছে থাকত। তাছাড়া আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে এবং সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনার জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার শাখায় কর্মরত ব্যক্তিদের সঙ্গে বিশেষ করে মওদুদ আহমদ সাহেব এবং ধীরেন বোসের সঙ্গে আমাদের নিয়মিতভাবে মতবিনিময় হতো এবং সব সময়ই সমন্বয়ভাবে কাজ করা হতো। এসব কাজে কবি আল মাহমুদ ও সাংবাদিক আল মুজাহিদী যথেষ্ট পরিশ্রম করতেন এবং দায়িত্ব পালনে সব সময়ই উদ্যোগী ছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে কিছুদিনের জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানসমূহের সমন্বয়ের দায়িত্ব প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর অর্পিত হয়েছিল এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ প্রতিরক্ষা সচিবের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই নানা বিষয়ে বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মতৎপরতা এবং অন্যান্য বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে আসতেন। আমাদের অন্যান্য কর্মতৎপরতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল সমর ফ্রন্টের সাফল্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য অভিযান বিষয়ে প্রতিদিনই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও অন্যান্য স্থানীয় ও বিবিসি ভয়েজ অব আমেরিকা ডয়েচ এ ভেলি প্রভৃতি বিদেশী গণমাধ্যমের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করে পাঠানো। এছাড়া আকাশবাণীতে যে সব লেখক সাহিত্যিক সমাজকর্মী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে নানা অনুষ্ঠান পরিচালনা ও প্রয়োজনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাদের সঙ্গে আমাদের প্রায় প্রতি সপ্তাহেই মিটিং হতো এবং সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে হতো আলাপ-আলোচনা ও বিশ্লেষণ এবং নির্ধারণ করা হতো পরবর্তী কর্মপন্থা। চরমপত্র খ্যাত এম আর আখতার মুকুল ভাই এবং অন্যান্য যে সমস্ত বাংলাদেশী ব্যক্তিরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করতেন এবং বিভিন্ন বিদেশী সংবাদপত্র এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের সঙ্গেও আমাদের নিয়মিতভাবে যোগাযোগ হতো এবং মতবিনিময় করা হতো যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং তৎকালীন বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। এই ধরনের আলোচনায় আমরা প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ সাহেব, আকবর আলি খান ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ড. বেলায়েতকে সব সময়ই আমাদের সঙ্গে পেতাম। এছাড়া ওই সময়ে বাংলাদেশ মিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত আনোয়ারুল করিম চৌধুরীও ভীষণভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন আমাদের কাজে এবং প্রয়োজনে নানা তথ্য দিয়ে আমাদের সাহায্য করতেন। আমাদের অফিস ছিল ৮নং থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের একই কম্পাউন্ডে। প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ সাহেব প্রায় প্রতিদিনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতেন, তাকে নানা বিষয়ে তার নির্দেশনা গ্রহণের জন্য এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাকে অবহিত করার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসার পর প্রতিরক্ষা সচিব আমাকেও মাঝে মধ্যে ডাকতেন সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার সংক্রান্ত বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোন নির্দেশনা অথবা চিন্তা-ভাবনা থাকলে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য বা কার্যকরী করার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব ড. ফারুক আজিজ খানও মাঝে মধ্যে আমাকে ডেকে পাঠাতেন তার অফিসে প্রধানমন্ত্রীর কোন নির্দেশনা অথবা বক্তব্য থাকলে সেটা জানিয়ে দেবার জন্য। আমরাও সব সময় সজাগ থাকতাম এই কারণে যে, তিনি নিজেও আমাদের সব কাজের বিষয়ে অবহিত রয়েছেন এবং সময়ে সময়ে পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। উল্লেখ্য যে, ব্যক্তিগতভাবে আমার স্বকণ্ঠে আকাশবাণী থেকে নিয়মিতভাবে প্রচারিত সাপ্তাহিক ‘জবাব দাও’ অনুষ্ঠানটিতে সময় পেলে প্রধানমন্ত্রী শোনার চেষ্টা করতেন সে কথাটি তার ব্যক্তিগত সচিব আমাকে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব একবার আমাকে তার অফিসে ডেকে প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে জানালেন, জবাব দাও অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী উর্দু ভাষিদের বিষয়ে সময় ও সুযোগ মতো মুজিবনগর সরকারের চিন্তা-ভাবনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। যা পরবর্তী দুটো অনুষ্ঠানে সম্প্রচার করা হয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন এক ছুটির দিনে রবিবারে। শুক্রবারেই ড. ফারুক আজিজ খান পরবর্তী রবিবার সকাল দশটার সময় আমাকে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে তার সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছিল। সময়মতো সেখানে উপস্থিত হলে প্রধানমন্ত্রী একজন তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার উপস্থিতিতে সরাসরি এমন একটা বক্তব্য দিলেন যা ছিল মোটামুটিভাবে যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার, ভারত সরকার নয়। আমার স্বকণ্ঠে বক্তব্যটি জবাব দাও অনুষ্ঠানে একাধিকবার প্রচার করাও হয়েছে। আকাশবাণীর অনুষ্ঠান প্রযোজক সরল দে কখনও এ বিষয়ে কোন প্রশ্ন তোলেননি। তবে বিবিসি, আকাশবাণী, ডয়েচ এ ভেলী (জার্মান রেডি/জাপান রেডিও অস্ট্রেলিয়ান রেডিও, ভয়েস অব আমেরিকার মতো প্রতিষ্ঠান এবং টাইম, নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক টাইমস, লন্ডন টাইমস, ল্যাম প্রভৃতি সংবাদ মাধ্যমগুলো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্যাপকভাবে যেভাবে বাংলাদেশের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল সেটাই ছিল সত্যিকারভাবে প্রকৃত সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন ভারতীয় প্রতিনিধিদের সাহায্য, সহযোগিতা এবং সমর্থন আমরা সব সময়ই পেয়েছি। লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ও ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন
×