ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট কী কাজে লাগছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট কী কাজে লাগছে

কিছুদিন হলো গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জানতে পারছি দেশে ৪-জি মাত্রার মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট চালু হতে যাচ্ছে। বর্তমানে চালু ৩-জি বা ২-জি ইন্টারনেটের যে গতি তার চেয়ে এক ধাপ উঁচু গতি ৪-জি এটা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ইন্টারনেট দিয়ে আমার কি সুবিধা বা আমার কি লাভ হবে? আমি যদি শহরে থাকি এই ইন্টারনেট আমাকে কি সুবিধা দেবে আর যদি গ্রামে থাকি আমি এ দিয়ে কি করব? এই আগ্রহ নিয়ে আমি একটি জরিপ পরিচালনা করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বন্ধুদের প্রায় ৯৯ শতাংশ আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন বা ব্যর্থ হয়েছেন। আমার প্রশ্নটি ছিল, ‘মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমাদের দেশে কী কী ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে তার অন্তত ৫টি উদাহরণ (বা প্রস্তাব বা আইডিয়া) দেবেন।’ উত্তর না পেয়ে আমি মোটেই অবাক হইনি। কারণ প্রাক-জরিপ আলোচনায় বন্ধুদের অনেকেই কিছু উল্লেখ করতে না পেরে বিব্রত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রণ কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত মোবাইল ফোনের ‘গ্রাহক’ সংখ্যা ১৩০.৮৮১ মিলিয়ন বা ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মোবাইল ফোনের গ্রাহক। এরা সবাই মোবাইল ফোনের ‘ব্যবহারকারী’ কি-না সে তথ্য আমাদের জানা নেই। উক্ত ওয়েবসাইটে তার কোন উল্লেখ নেই। ঠিক সে রকমই উল্লেখ আছে দেশে মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত ইন্টারনেট ‘গ্রাহক’ সংখ্যা ৬১.২৮৮ মিলিয়ন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ ও মোট মোবাইল ফোন গ্রাহকের শতকরা ৪৭ ভাগ। এর কত ভাগ ইন্টারনেট ‘ব্যবহারকারী’ তারও কোন উল্লেখ নেই। এই ৬১.২৮৮ মিলিয়নের মধ্যে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ‘গ্রাহক’ ৫৮.০৪৫ মিলিয়ন বা শতকরা ৯৫ ভাগ। বাকি ৬ অংশ মাত্র ওয়াই ম্যাক্স ও আইএসপি ও পিএসটিএন সংযোগপ্রাপ্ত ইন্টারনেট গ্রাহক। এখন কেউ যদি আমার মতো নিচের কয়েকটি বিষয় জানতে বা বুঝতে চান তিনি সূত্র হিসেবে কোন্ পরিসংখ্যান নেবেন? জানা মতে, দুনিয়ার কয়েকটি সংস্থা দেশে দেশে নানা রকম উন্নতি সূচক নিয়ে গবেষণা করে তা প্রকাশ করে (যেমন: ইউএনডিপি, বিশ্বব্যাংক, আইটিইউ, ওইসিডি)। দেশে গ্রহণযোগ্য উপাত্ত না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের সেসবের দ্বারস্থ হতে হয়। যে প্রশ্নগুলোর সমাধান খুঁজতে এই লেখার অবতারণা সেগুলো হলোÑ ১. মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমাদের কর্মশক্তির (ইউএনডিপির ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪) কত ভাগ প্রত্যক্ষ আয় সৃজনে সমর্থ হচ্ছে? ২. ইউএনডিপির তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৯ ভাগ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৪, যাদের ধরা হয় ব্যাপক সম্ভাবনা শক্তি হিসেবে, তাদের কতভাগ মোবাইল ইন্টারনেটের ‘ব্যবহারকারী’ ও তারা তাদের সম্ভাবনা শক্তির কত ভাগ ব্যবহার করে নিজেদের কর্ম সৃজনে সুযোগ পেয়েছে বা পাচ্ছে? ৩. বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো এপ্রিল ২০১৬ প্রতিবেদনে বলছে, গত ২ বছরে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে ৬ লাখ, যা হওয়া উচিত ছিল ন্যূনতম ২৬ লাখ। এই ৬ লাখের কতজন মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ‘ব্যবহার’ করে কর্মস্থলে ভূমিকা রাখছেন তা জানার উপায় কি? ৪. দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর ৭৪ ভাগ তরুণ। মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে এদের জন্য কী কী সুযোগ তৈরি হতে পারে সে বিষয়ে ভাবনার দায়িত্ব কার? ৫. ইউএনডিপি বলছে বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থানের দরকার হবে। সে হিসাবে প্রতি বছর নতুন কর্মসংস্থান প্রয়োজন হবে ১৬ লাখ। মোবাইলে ইন্টারনেট এর কত ভাগ কর্ম সৃজনে ভূমিকা রাখবে? সম্প্রতি পত্রপত্রিকায়, নানা রকম টকশো আলোচনায় মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট দিয়ে দেশে বিপ্লব সাধিত হয়েছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। যে কেউ আমার উল্লিখিত ৫টি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুঁজে পেলে বুঝতে পারবেন এই প্রচার অজ্ঞানপ্রসূত। আমার বিচারে এর একমাত্র ইতিবাচক হলো দেশে টেলিকমিউনিকেশনের প্রত্যক্ষ ব্যবহার বেড়েছে, যার শতকরা ৯৯ ভাগ ব্যবহারকারীর খরচেই (ফোন কেনা, প্যাকেজ কেনা, কথা বলা ইত্যাদি)। এ খরচের সাকুল্যে মাত্র ১৫ ভাগ সরকার পায়, বাকি পুরোটাই যায় অপারেটর নামীয় বিদেশী বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ খরচ ও মুনাফায়। এদের কেউ কেউ দাবি করেন লাইসেন্স ফি অনেক বেশি, স্পেক্ট্রাম খরচ অনেক শত কোটি টাকা দিয়ে নেয়া হয়েছে, কিন্তু বিচক্ষণ মাত্র জানেন এই টাকা বাজার থেকে উঠিয়ে নেয়া সামান্য সময়ের বিষয়। মোবাইল ব্যবসায়ীদের বার্ষিক আয় খাতের হিসাব দেখলেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প বাস্তবায়নে আমাদের নীতিনির্ধারক মহলের সদিচ্ছার সুযোগ নিয়ে মোবাইল ফোনের অপারেটররা নানা রকম কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। এর অবসান হওয়া দরকার। এখন পর্যন্ত মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার কারে তরুণ সমাজের সৃজনশীল কর্ম সৃষ্টির সুযোগ হয়েছে এমন উদাহরণ বিরল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কোন কোন কেন্দ্রীভূত সেবা কেন্দ্র (যেমন ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্রÑ অধুনা ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্র নামে পরিচিত) উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে তুলনামূলকভাবে বেশি আয় করতে সমর্থ হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো রেমিটেন্স আদান-প্রদানসহ গ্রামভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা (এজেন্ট ব্যাকিং) চালু করতে চাইছে। উচ্চগতির নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ছাড়া এ রকম কার্যক্রম গ্রাম পর্যায়ে সম্প্রসারণ মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট দিয়ে কখনই সম্ভব নয়, নিরাপদও নয়। মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট দিয়ে আমরা তরুণ সমাজের বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের কোন সুযোগ তৈরি করতে পারিনি। থ্রি-জি আর একটি স্মার্টফোন দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকে একেবারেই ‘প্রাইভেট’ করে দেয়া হলো বলে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। অপারেটরগুলো যুব সমাজের নির্ঘুম রাত, এমনকি ডাটা ব্যবহারের সস্তা নামক প্যাকেজ দিয়ে রুচিহীন সংস্কৃতিবিরুদ্ধ যেসব কার্যক্রম করেছে, দুঃখজনক যে, হাইকোর্টের নির্দেশনা দিয়ে তাদের এই অপশক্তির মোকাবেলা আমাদের করতে হয়েছে। উন্নত দেশে বা শহরাঞ্চলে নাগরিক সুবিধার জন্য সাধারণত থ্রি বা ফোর-জি (এখন এলটিই প্রযুক্তি) ব্যবহার করা হয়। ম্যাপ, ঠিকানা, হোটেল রেস্তরাঁ খুঁজে বের করা বা ব্যাকিং বা ভ্রমণ কাজে নানা রকম এ্যাপ্লিকেশন দিয়ে তাৎক্ষণিক সেবা সুবিধা গ্রহণে এই প্রযুক্তি জনপ্রিয় হয়েছে। ২০০৯ সালে গৃহীত ব্রডব্যান্ড নীতিমালা ত্রি-স্তর উদ্দেশ্য সংবলিত যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সেসব বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ২০১৫ সালের মধ্যে। এই নীতিমালা প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ করলে খুব সহজেই বোঝা যায়, একে প্রায় উপেক্ষা করা হয়েছে। সে তুলনায় মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবহার সম্প্রসারণ নিয়েই আমরা অনেক বেশি ব্যস্ত থেকেছি। এই নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে ইতোমধ্যে সারাদেশের পোস্ট অফিস, হাসপাতাল, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পেত। গ্রামে গ্রামে যদি এই সেবা সম্প্রসারিত হতো ঘরে বসে বা পাড়ায় পাড়ায় আইটি খাতে সৃজনশীল কর্ম ব্যবস্থা গড়ে উঠত। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠত তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক নানামুখী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। শুধু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করে দিয়েই গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠত সৃজনশীল জ্ঞান কর্মী। জনমিতিক তথ্য সংগ্রহ, স্বাস্থ্য তথ্য, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু, গাছপালা, এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় তাৎক্ষণিক তথ্য সরবরাহের এমন সহজ সুযোগ সংশ্লিষ্ট সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করতে পারছে না। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের পরিকল্পনা উপেক্ষা করে এই কাজের সুযোগ নষ্ট করা হচ্ছে। এখনও সময় আছে, আমাদের সংগ্রহে পর্যাপ্ত ব্যান্ডউইথ আছে। উপজেলা পর্যায়ের প্রায় সব এক্সচেঞ্জ উচ্চগতির ইন্টারনেট দিতে সক্ষম। দরকার শুধু মূল কেন্দ্র থেকে তার দিয়ে এর সম্প্রসারণ। ক্ষেত্র বিশেষে তারবিহীন ব্যবস্থাও সম্ভব। দরকার শুধু সদিচ্ছা আর মোবাইল ইন্টারনেটের দুর্বল বুলির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো। লেখক : পরিচালক আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×