ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা

মিথুন আশরাফ ॥ সাকিব আল হাসান ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়লেন। যেন বাংলাদেশের আশাও শেষ হয়ে গেল। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যে আশা তা হতাশাতেই পরিণত হয়ে গেল। ৭৯ রানে হেরে গেল বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও হয়ে গেল শ্রীলঙ্কা। যে দলটি শুরুতে বিধ্বস্ত ছিল। সেই দলটিই কিনা বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে শিরোপা জিতে নিল। অভিষেক ওয়ানডেতেই শেহান মাদুশঙ্কার হ্যাটট্রিকে শিরোপা জেতার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো বাংলাদেশের। ফিল্ডিংয়ের সময় সাকিব বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে ব্যথা পান। এরপরই বোঝা হয়ে যায় যে ব্যাট হাতে নামতে পারবেন না। নয় ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলতে হবে বাংলাদেশকে। তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটসম্যান না থাকলে কী আর ম্যাচ জেতা এত সহজ! খুবই কঠিন। তা প্রমাণও হলো। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে শনিবার ফাইনাল ম্যাচটিতে টস জিতে শ্রীলঙ্কা। আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রুবেল হোসেন (৪/৪৬) ও মুস্তাফিজুর রহমান (২/২৯) এমনই গতির ঝড় তোলেন শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানরা কুলিয়ে উঠতে পারেননি। শুরুতে একটু নিজেদের মেলে ধরতে পারেন। কিন্তু এরপর আর ব্যাটসম্যানরা ঝলক দেখাতে পারেননি। রুবেল ও মুস্তাফিজের বোলিং তোপে ৫০ ওভারে ২২১ রান করতেই অলআউট হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। উপুল থারাঙ্গা (৫৬) শুধু হাফ সেঞ্চুরি করতে পারেন। জবাব দিতে নেমে এই রানও করতে পারেনি বাংলাদেশ। ৪১.১ ওভারে ১৪২ রান করতেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ সর্বোচ্চ ৭৬ রান করতে পারেন। দুই উইকেট করে নেয়া চামিরা, ধনঞ্জয়ার দুর্দান্ত বোলিংয়ের পর মাদুশঙ্কা হ্যাটট্রিকই করে ফেলেন। অভিষেকেই চতুর্থ বোলার হিসেবে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেন। বাংলাদেশের তাইজুল ইসলাম, দক্ষিণ আফ্রিকার কাগিসো রাবাদা, শ্রীলঙ্কার হাসারাঙ্গার পর অভিষেক ওয়ানডেতেই মাদুশঙ্কা হ্যাটট্রিক করেন। শ্রীলঙ্কা শুরুতে বিপদে পড়েও তা থেকে নিজেদের গুছিয়ে নিতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা পারেনি। ২২ রান হতেই তামিম ইকবাল, মোহাম্মদ মিঠুন ও সাব্বির রহমান আউট হয়ে যান। ব্যাটিং করা কঠিন উইকেটে মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহ মিলে আশা জাগিয়েও হতাশাই যুক্ত হয়। ৮০ রান হতেই মুশফিক (২২) আউট হয়ে যান। দুইজন মিলে ৫৮ রানের জুটি গড়লেও মুশফিক আউট হওয়াতে যেন বাংলাদেশের জয়ের আকাশে অন্ধকার ঘিরে ধরে। সেই অন্ধকার আর দূর করা যায়নি। মেহেদী হাসান মিরাজ আসলেন, আর সাজঘরে ফিরলেন। মাহমুদুল্লাহ এর মাঝে নিজের স্কোরকে হাফ সেঞ্চুরি থেকেও দূরে নিয়ে যেতে পেরেছেন। কিন্তু সাইফউদ্দিন, মাশরাফি, রুবেল দ্রুতই আউট হয়ে যান। শেষে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ আউট হতেই বাংলাদেশের ইনিংসের পতন ঘটে। সাকিব ব্যাট হাতে নামতে না পারায় নয় উইকেট যেতেই অলআউট হয় বাংলাদেশ। মাশরাফি, রুবেলকে আগের ওভারের শেষ দুই বলে আউট করেন মাদুশঙ্কা। পরের ওভারের প্রথম বলে মাহমুদুল্লাহকে আউট করে হ্যাটট্রিক করেন মাদুশঙ্কা। শুরুতেই শ্রীলঙ্কা গুনাথিলাকাকে হারিয়ে ধাক্কা খেলেও এরপর টানা তিনটি উইকেটে তা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় উইকেটে উপুল থারাঙ্গা ও কুশল মেন্ডিস মিলে ৩৪ রানের জুটি, তৃতীয় উইকেটে থারাঙ্গা ও ডিকভেলা মিলে ৭১ রানের জুটি, চতুর্থ উইকেটে থারাঙ্গা ও চান্দিমাল মিলে ৪৫ রানের জুটি গড়েন। এই তিন জুটিতে শ্রীলঙ্কাও ৩৬ ওভারে গিয়ে ১৫৮ রানও করে ফেলে। এরপরই শ্রীলঙ্কার ইনিংস পুরোদমে চাপে পড়ে যায়। থারাঙ্গা দুর্দান্ত ব্যাটিং করেন। কিন্তু দুইবার ‘নতুন জীবন’ পান। দুইবার আউট হওয়া থেকে বেঁচে শেষ পর্যন্ত ৫৬ রানের ইনিংস খেলেন। থারাঙ্গাই ভয় তৈরি করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু মুস্তাফিজ এসে তাকে দলের ১৫৮ রানের সময় বোল্ড করেন। এই উইকেটটি এমন সময় শিকার করেন মুস্তাফিজ যখন থারাঙ্গাকে আউট করা খুবই দরকার ছিল। না হলে শ্রীলঙ্কা অনেকদূর এগিয়ে যেত। থারাঙ্গাকে আউট করে আবার দেশের হয়ে সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে ৫০ উইকেট শিকারও করেন মুস্তাফিজ। থারাঙ্গা আউটের আগে ৮ রানে গুনাথিলাকাকে মেহেদী হাসান মিরাজ ও ৪২ রানে মারমুখী ব্যাটসম্যান কুশল মেন্ডিসকে (২৮) সাজঘরে পাঠান মাশরাফি। ১১৩ রানে ডিকভেলাকে (৪২) সাইফউদ্দিন আউট করে দেন। এরপরই যখন থারাঙ্গা ও চান্দিমাল মিলে বড় জুটি গড়ার দিকে এগিয়ে যান, শ্রীলঙ্কার নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে থাকে ম্যাচ তখনই থারাঙ্গাকে আউট করেন মুস্তাফিজ। এরপর তো রুবেল যে কি বোলিং নৈপুণ্য দেখান। শেষ ৬৩ রানের মধ্যে শ্রীলঙ্কার ৬ উইকেটের পতন ঘটে। চারটিই রুবেল শিকার করেন। ১৬৩ রানে যখন থিসারা পেরেরাকে আউট করে দেন রুবেল তখন বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণেই চলে আসে ম্যাচ। তবুও ভয় ছিল চান্দিমালকে নিয়ে। সেই চান্দিমাল (৪৫) ২০৯ রানে আউট হন রুবেলের বলেই। তার আগে গুনারতেœকেও সাজঘরে পাঠান রুবেল। গুরুত্বপূর্ণ উইকেটগুলোই রুবেলের দখলে চলে যায়। সাকিব ইনজুরিতে পড়ে মাঠ ছাড়ার পর কে বল হাতে সাকিবের অভাব পূরণ করবেন? এমন প্রশ্ন যখন ওঠে, রুবেল সেই অভাব পূরণ করেন। বুঝতেই দেন না সাকিব মাঠে নেই। শেষ পর্যন্ত আকিলা ধনঞ্জয়া (১৭) শেষদিকে একটু ঝলক দেখানোর চেষ্টা করেন। মুস্তাফিজ তাকে থামিয়ে দেন। শেহান মাদুশঙ্কাকে ২১৯ রানের সময় আউট করে দিয়ে চার উইকেট পান রুবেল। ৫০ ওভার শেষ হতে যখন ১ বল বাকি এমন সময় সুরঙ্গ লাকমাল রান নিতে গিয়ে রানআউট হন। তাতে অলআউট হয় শ্রীলঙ্কা। ২২১ রানের বেশি করতেও পারেনি লঙ্কানরা। এই রানই জেতার জন্য যথেষ্ট হয়ে ধরা দিল। এর আগে তিনবার কোন টুর্নামেন্ট বা সিরিজের ফাইনালে খেলতে পারে বাংলাদেশ। ২০১২ সালের এশিয়া কাপে, ২০১৬ সালের টি২০ এশিয়া কাপে ফাইনালসহ ২০০৯ সালের ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। সবকটি দেশের মাটিতে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেই ফাইনালে খেলে। কিন্তু শিরোপা আর জিততে পারেনি। এবার চতুর্থবারের মতো ফাইনালে খেলেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারল না বাংলাদেশ। ত্রিদেশীয় সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অবশ্য আছে। ২০০৭ সালে এ্যাসোসিয়েটস ত্রিদেশীয় সিরিজে কানাডা ও বারমুডার সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলা সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। কিন্তু সেই সিরিজের ফাইনাল ছিল না। তাছাড়া বাংলাদেশ ছাড়া টেস্ট খেলুড়ে কোন দল ছিল না সিরিজে। টেস্ট খেলুড়ে দল আছে এবং তিন দলের সিরিজ বা টুর্নামেন্ট হয়েছে এমন সিরিজ ১৩টিতে খেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ২০০৯ সালেই শুধু জিম্বাবুইয়ে ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলা ত্রিদেশীয় সিরিজে ফাইনালে খেলতে পারে বাংলাদেশ। টেস্ট খেলুড়ে তিন দলের সঙ্গে খেলা আর কোন সিরিজ বা টুর্নামেন্টেই ফাইনালে খেলতে পারেনি বাংলাদেশ। এবার খেলেছে। যে দাপটের সঙ্গে সিরিজের শুরুটা হয়েছিল তাতে চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে বাংলাদেশকেই ধরা হয়েছিল। চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাস গড়বে বাংলাদেশ তা মনে করা হয়েছিল। প্রথমবারের মতো কোন সিরিজে শিরোপা জিতবে তা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কা তা হতে দিল না। বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে উল্টো শিরোপা জিতে নিল। চ্যাম্পিয়ন হলো।
×