ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভেদুরিয়ায় আরেকটি গ্যাসক্ষেত্র মিলল

ভোলার গ্যাস যাবে খুলনা এবং বরিশালে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

ভোলার গ্যাস যাবে খুলনা এবং বরিশালে

রশিদ মামুন ॥ ভোলার গ্যাস যাবে খুলনা এবং বরিশালে। রাষ্ট্রীয় গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলন কোম্পানি বাপেক্স শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে ভোলার ভেদুরিয়াতে নতুন গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়ার বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে বলা হয়েছিল ভোলার মজুদ এক টিসিএফ হলে খুলনা এবং বরিশালে গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এখন ভোলার শাহবাজপুর এবং ভেদুরিয়া মিলিয়ে মজুদ দাঁড়াল দেড় টিসিএফ। ভোলার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুত, জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা এখন বরিশালে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা করছি। এরপর সেখান থেকে খুলনা পর্যন্ত পাইপ লাইন নির্মাণ করা হবে। কী নাগাদ হতে পারে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন আমরা ইতোমধ্যে পাইপ লাইন নির্মাণের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি। আশা করছি শীঘ্রই এই কাজ শুরু হবে। ভোলার ভেদুরিয়াতে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাপেক্স। শনিবার ডিএসটি শেষে দুপুরে গ্যাস উদগিরণ শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৫ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভোলায় গ্যাস পাওয়ার আগাম ঘোষণা দেন। ওই সময়ে ভোলার গ্যাস ক্ষেত্রে কূপ খনন পর্যায়ে গ্যাসের চাপ অনুভব করায় গ্যাস পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়। নতুন এই গ্যাস ক্ষেত্রটির নাম হচ্ছে ভোলা উত্তর গ্যাস ক্ষেত্র। ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে ভোলা উত্তর গ্যাসক্ষেত্রটির দূরত্ব প্রায় ৩৭ কিলোমিটার। এটি হবে দেশের ২৭তম গ্যাসক্ষেত্র। বাপেক্স এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী নওশাদুল ইসলাম শনিবার বিকেলে জনকণ্ঠকে জানান আমাদের অন্যান্য কাজ শেষ করতে আট থেকে নয় মাস সময় প্রয়োজন হবে। এই সময়ে প্রসেস প্ল্যান্ট বসানো ছাড়াও গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্কের সঙ্গে নতুন ক্ষেত্রটিকে যুক্ত করতে হবে। বিতরণ কোম্পানিকে বলা হবে এর মধ্যে বাজার অনুসন্ধান করতে। এখানে কোথায় কোথায় গ্যাস দেয়া যায় তা বিতরণ কোম্পানি নির্ধারণ করবে। তবে বিতরণ কোম্পানি চাইলেই আমরা গ্যাস দিতে পারব বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। গত ৯ ডিসেম্বর ভোলা উত্তর-১ নামের কূপটি খননের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। ওই সময় জানানো হয় ভোলায় এক টিসিএফ গ্যাসের মজুদ পাওয়া যায় তাহলে পাইপ লাইনের মাধ্যমে তা খুলনা-বরিশাল অঞ্চলে সরবরাহ করা হবে। এতে মৃত শিল্পনগরী খুলনা প্রাণ ফিরে পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ভোলার গ্যাস স্থলভাগে আনতে অন্তত ১০ কিলোমিটার সাবসি (পানিতে পাইপ লাইন) নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়া বরিশালে ভোলার গ্যাস দিতে হলে অন্তত ৩৫ কিলোমিটার পাইপ লাইন নির্মাণ করতে হবে। আর খুলনা পর্যন্ত গ্যাস আনতে হলে দরকার হবে আরও ২০০ কিলোমিটার পাইপ লাইন। এর মধ্যে কয়েকটি নদীও রয়েছে। গ্যাস ক্ষেত্রটির ডিএসটির ফলাফল জানতে চাইলে বাপেক্স’র কর্মকর্তা মেহেরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, কূপের ওপর (ওয়েলহেডে) চাপ আছে তিন হাজার ৭০০ পিএসআই। আর নিচেয় চাপ আছে ৪ হাজার ৮০০ পিএসআই। এই কূপের ফলফল বলছে এখানে ৬০০ বিসিএফ মজুদ আছে। ভবিষ্যতে এখানে আরও কূপ খনন করা হলে মজুদ বাড়তে পারে। এই কূপ থেকে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। মাটির গভীরে তিন হাজার ৩৪৮ মিটার থেকে তিন হাজার ৪৬০ মিটার গভীরতায় ১২ মিটারের একটি গ্যাস স্তর থেকে এই গ্যাস পাওয়া গেছে। ভোলার শাহবাজপুর ক্ষেত্রে পৌনে এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) মজুদ রয়েছে। নতুন করে আরও ৬০০ বিসিএফ মজুদ থাকলে ভোলায় গ্যাসের মজুদ দাঁড়াবে এক দশমিক পাঁচ টিসিএফ। তবে শাহবাজপুর এবং ভেদুরিয়াতে আরও নতুন কূপ খনন করবে বাপেক্স। এতে গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ভোলায় সরকার কয়েকটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। এর বাইরে বরিশাল এবং খুলনার শিল্পে গ্যাসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা হয়ে গ্যাস পাইপ লাইন খুলনায় পৌঁছেছে। তবে এই পাইপ লাইন দিয়ে এখনও গ্যাস সরবরাহ শুরু করা হয়নি। খুলনায় এর আগে ডুয়েল ফুয়েল (দ্বৈত জ্বালানি) বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও সেই কেন্দ্রটি ডিজেলে বিদ্যুত উৎপাদন করছে। ভোলার গ্যাস খুলনা পর্যন্ত আনা সম্ভব হলে সেখানে অনেক কম খরচে বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব হবে। গ্যাস সঙ্কটের মধ্যে গত কয়েকবছরে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে উত্তোলন বাড়িয়ে দৈনিক ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) করা হয়েছে। কিন্তু সারা দেশে দৈনিক চাহিদা রয়েছে তিন হাজার ৭০০ এমএমসিএফডি। তবে চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে প্রায় সবগুলোই বিদ্যমান কূপকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। গত নয় বছরে শ্রিকাইল ছাড়া আর কোন মাঝারি মানের গ্যাস ক্ষেত্রও পাওয়া যায়নি। বড় গ্যাস ক্ষেত্রের আশা করেও সুনেত্রতে (সুনামগগঞ্জ- নেত্রকোনা জেলায়) কিছু পায়নি বাপেক্স। ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রটি বেঙ্গল বেসিনভুক্ত এলাকায়। সেখানে যে ভূ-কাঠামোয় গ্যাস পাওয়া গেছে, তার ভূ-তাত্ত্বিক নাম ‘স্টেটিগ্রাফিক স্ট্রাকচার’। দেশের অন্য সব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে সুরমা বেসিনে। এই বেসিনের ভূ-কাঠামোয় ভূ-তাত্ত্বিক নাম ‘এ্যান্টি ক্লেইন স্ট্রাকচার’। ভোলায় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য প্রথমে দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করা হয় ১৯৮৬-৮৭ সালে। তাতে গ্যাসের অবস্থান চিহ্নিত করার পর প্রথম অনুসন্ধান কূপটি খনন করা হয় ১৯৯৪ সালে। এরপর আরও তিনটি কূপ খনন করা হয়েছে। এই কূপগুলো থেকে বর্তমানে দুটি বিদ্যুত কেন্দ্র চলছে। সেখানে আরও বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছে পিডিবি। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে ত্রিমাত্রিক জরিপ করে দেশের দ্বীপ জেলা ভোলায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ইউনোকল এক জরিপের ভিত্তিতে শাহবাজপুরে দুই ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস মজুদের সম্ভাবনার কথা বলেছিল। তখন তারা ওই গ্যাস তুলে তা দিয়ে বরিশাল, খুলনা ও যশোর অঞ্চলে সরবরাহের কর্মপরিকল্পনাও সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছিল। পরে ওই প্রক্রিয়া আর আগায়নি। দেশের ক্রমবর্ধমান গ্যাস চাহিদা পূরণে ২০২১ সালের মধ্যে ১০৮ টি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ৫৩টি অনুসন্ধান কূপ, ৩৫টি উন্নয়ন কূপ ও ২০টি ওয়ার্কওভার কূপ রয়েছে।
×