ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জিতুর লাল সোয়েটার

প্রকাশিত: ০৮:১১, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

জিতুর লাল সোয়েটার

আবেদীন জনী ॥ শীতে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরেছে জিতু। স্কুলে গিয়েছিল সেই ভোরবেলা। যাওয়ার সময় জিতুর ফুলপ্যান্ট আর শার্ট পরা ছিল। শার্টের ওপরে ছিল তুলতুলে লাল সোয়েটার। শার্ট-প্যান্ট ঠিকই আছে। কিন্তু লাল সোয়েটারটি গায়ে নেই জিতুর। আজব ব্যাপার! সোয়েটার কী হলো? মা ভাবছেন, কোথাও খুলে রেখে এসেছে হয়তো। শরীর থেকে তো ওটা একাকী খসে পড়েনি। কিন্তু খুলবে কেন? এখনও তো শীতের দাপট রয়েই গেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও জেঁকে বসে আছে কনকনে শীত। কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা চারপাশ। ঝিরঝির ঝরছে শিশির। হিম হাওয়া বইছে একটানা। আজ সারাদিন গোমড়া আকাশ। ভুলেও একবার উঁকি দেয়নি সূর্য। এমন তীব্র শীতেও স্কুলে যেতেই হবে ওর। একদিন না গেলে নাকি পিছিয়ে পড়বে। অনেক খোকাখুকুকে বকাঝকা করেও স্কুলে পাঠানো মুশকিল। আর জিতুকে একদিন স্কুলে যেতে বারণ করলেই গাল ফুলিয়ে ঢোল। যাবি যা। ভাল কথা। কিন্তু নিজের গায়ের সোয়েটার ফেলে দিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে কেউ আসে? এমন বোকারাম দ্বিতীয়টি নেই। সোয়েটার কী করেছিস, তোকে বলতেই হবে। জিতুর প্রতি ভীষণ রেগে গেলেন মা। মায়ের প্রশ্নের কোন জবাব দিল না জিতু। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। শীতের চোটে কাঁপছে তো কাঁপছেই। মায়ের পিটুনির ভয়েও কাঁপছে। দু’ধরনের কাঁপুনি এক হয়ে কাঁপাকাঁপির মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কথা বলছিস না কেন? ক’দিন আগের কেনা নতুন সোয়েটার। অনেক দামী। টুকটুকে লাল। সেই সুন্দর সোয়েটার কীভাবে হারিয়েছিস, বল্ আমাকে। মা রাগ মেশানে কণ্ঠে আবারও জানতে চাইলেন। ভয়ে ভয়ে নরম গলায় জিতু বলল, লাল সোয়েটারটি নেই, তাতে কী হয়েছে মা? আমার তো একটা পুরনো সোয়েটার আছেই। ওটাই দাও। নতুন সোয়েটার লাগবে না। কিনেও দিতে বলব না। দেখো, বলি কি না। যদি বলি, তুমি আমাকে যত ইচ্ছে বকো, মারো। এখন থেকে আমি পুরনোটাই পরব। দাও না মা পুরনো সোয়েটারটি। দেখো না গায়ে আমার পাতলা একটা শার্ট। ঠা-ায় যে মরে যাচ্ছি আমি। প্রশ্নের উত্তর পেলেন না মা। কিন্তু জিতু এমনভাবে কথা বলল যে, মায়ের রাগ একটুখানি কমে গেল হয়তো। পুরনো সোয়েটার জিতুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, এই নে। তোর বাবা আসুক। সোয়েটার হারানোর মজা হাড়ে হাড়ে টের পাবি। জিতুর খুব খিদে পেয়েছে। মা ওকে ডেকে নিয়ে খেতে দিলেন। পেটে খিদে থাকলেও খেতে ইচ্ছে হলো না ওর। একটু খেয়ে আর মুখে তুলল না। বাবার ভয়েই এমনটা হচ্ছে। বাবা যদি সোয়েটারের কথা জিজ্ঞেস করে, কী বলবে তখন? তাঁর ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের টাকায় কেনা সোয়েটার। দামী সোয়েটার। সেটি লাপাত্তা হয়ে গেলে মেজাজ গরম করতেই পারেন। জিতু ভাবছে, কী বলা যায় বাবাকে। মনে মনে ঠিক করল, বাবার কাছে সত্য কথাই বলব। যা করেছি, ঠিক তাই। একটুও মিথ্যা বলব না। এতে যা হয়, হবে। কিছুক্ষণ পর বাবা বাড়ি এলেন। জিতুকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, স্কুল থেকে কখন ফিরেছিস খোকা? তোর চোখ মুখ ওরকম শুকনো শুকনো লাগছে কেন? কী হয়েছে তোর? অসুখ করেনি তো? এবারও কোন কথা বলল না জিতু। মা এসে বললেন, শোনো, কী কা- করেছে তোমার ছেলে। নতুন সেই লাল সোয়েটারটি হারিয়ে ফেলেছে। শুধু পাতলা শার্ট পরে শীতে কেঁপে কেঁপে বাড়ি এসেছে। বাবার কাছে মায়ের নালিশ শেষ হতে না হতেই কান্না শুরু করে দিল জিতু। সে কী কান্না! যেন খুব বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে ও। কেঁদে কেঁদে বলল, আমি লাল সোয়েটার হারাইনি। মনুকে দিয়েছি। স্কুলে যাওয়ার পথে বড় আমগাছটা আছে না, ওই গাছের তলে খালি গায়ে বসে বসে একটা ছেলে কাঁপছিল। আর কাঁদছিল। ওর নামই মনু। শীতে যেন একদম বরফ হয়ে গেছে। ওর মুখ দেখে খুব মায়া লাগল। ওর নাকি মা-বাবাও নেই। তাহলে ওকে শীতের জামা কিনে দিবে কে? আমার তো মা-বাবা দু’জনই আছ। আরও একটা পুরনো সোয়েটারও আছে। মনুর তো কিছুই নেই। তাই ওকে লাল সোয়েটারটা দিয়ে এসেছি। কী যে খুশি হয়েছে মনু! হেসে হেসে আমাকে বলল, তোমারে আমি ভাই কইতে চাই। কইতে দিবে? আমি বললাম, তুমি আমাকে ভাই ডাকলে খুব ভাল লাগবে। মনু তখন আরও খুশি হলো। জিতু আরও বলল, চিন্তা কর না বাবা। আমি নতুন সোয়েটার কিনে দিতে বলব না। পুরনো সোয়েটারই পরব। জিতুর কথা শুনে মা ও বাবা বড্ড অবাক হলেন। জিতুকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে মা বললেন, তুই যে আমার জাদুসোনা। চাঁদের কণা। সূর্যছেলে। তোকে আমি না জেনে বকেছি। মনুকে সোয়েটার দিয়ে খুব ভাল কাজ করেছিস বাবা। এই কথাটা আগে বলিসনি কেন? এমন কাজ করে কাঁদতে হয় না। হাসতে হয়। বাবাও জিতুকে আদর করলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, শাবাশ জিতু! আমি তোর পিতা হয়ে জিতে গেছি। যত দুঃখ-কষ্ট, সব ভুলে গেছি আজ। এইটুকু বয়সে দুখী মানুষের প্রতি তোর ভালবাসা দেখে আমি খুবই আনন্দিত। তুই অনেক বড় হবি খোকা। অনেক বড় হবি। বাবা-মায়ের প্রশংসায় জিতুর চোখ-মুখও আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×