ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দস্যুদের ছোবল

টেংরাগিরি বন সাবাড়

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

টেংরাগিরি বন সাবাড়

নিজস্ব সংবাদদাতা, আমতলী, বরগুনা, ২৬ জানুয়ারি ॥ জলবায়ু পরিবর্তন ও বনদস্যুদের ছোবলে ধ্বংস হচ্ছে টেংরাগিরি বনাঞ্চল। এতে হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ। বিপন্ন হচ্ছে প্রাণীকুল। সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে তীর ভেঙ্গে সাগরে বিলীন হচ্ছে বনাঞ্চল। শ্বাসমূলীয় গাছগুলোতে পলি জমে ও প্রচ- ঢেউয়ে গোড়ার মাটি-বালু সরে এই বনাঞ্চলের গাছ মরে যাচ্ছে। জানা গেছে, তালতলী উপকূলীয় সংরক্ষিত বনাঞ্চল নিদ্রাসকিনা, নিশানবাড়িয়া ও নলবুনিয়ার নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি টেংরাগিরি। টেংরাগিরি বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য বা ফাতরান বন। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা টেংরাগিরি ১৯২৭ সালের পূর্বে সুন্দরবনের অংশ ছিল। ১৯২৭ সালের বন আইন অনুযায়ী, ১৯৬০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। পরে ১৯৬৭ সালে এটিকে টেংরাগিরি বনাঞ্চল হিসেবে নামকরণ করা হয়। ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর ৪০৪৮.৫৮ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত হয় টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। বিভিন্ন গাছপালা সমৃদ্ধ কেওড়া, গরান, গেওড়া, ওডা, জাম, ধুন্দল, সুন্দরী, বাইন, করমচা, বলই, তাল, কাঁকড়া, বনকাঁঠাল, রেইনট্রি, হেতাল ও তাম্বুলকাটা প্রভৃতি শ্বাসমূলীয় গাছ হচ্ছে এ বনের প্রধান প্রাণ। সুন্দরবনের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন। এই সংরক্ষিত বনে রয়েছে হাজার প্রজাতির প্রাণীকুলের মধ্যে কাঠবিড়ালি, বানর, সজারু, শূকর, কচ্ছপ, শিয়াল, ডোরাকাটা বাঘ, বনমোরগ, মধু কাঁকড়া, বন্যগরু, মহিষ ও প্রায় ৪০ প্রজাতির সাপ। জলবায়ু পরিবর্তন ও বনদস্যুদের ছোবলে পড়ে ধীরে ধীরে উজাড় হচ্ছে টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বনদস্যুরা বনরক্ষীদের সঙ্গে যোগসাজশে গহীন বনের সতেজ গাছ কেটে নিচ্ছে। জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্বাসমূলে বালু জমে ও ঢেউয়ে গাছের গোড়ার মাটি-বালু সরে গিয়ে গাছ মরে যাচ্ছে। বুধবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নলবুনিয়া, নিশানবাড়িয়া, আশারচর ও নিদ্রা-সখিনা এলাকায় দূর থেকে দেখতে অপরূপ ঘন বন মনে হলেও বনদস্যুদের ছোবলে ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে। সাগর সংলগ্ন কয়েক কিলোমিটার এলাকার বনের গাছ স¤পূর্ণ উজাড় হয়ে গেছে। অসংখ্য গাছের বাকল ও ডালপালা ছেঁটে ফেলায় সে সকল গাছ মরে যাচ্ছে। নিদ্রা ও আশারচর এলাকায় কয়েক হাজার গাছ কেটে সাবাড় করার পর পড়ে আছে সেসব গাছের গোড়া। টেংরাগিরি বনাঞ্চলের দক্ষিণ সাগর সংলগ্ন চরে অসংখ্য বড় বড় রেইনট্রি, কেওড়া ও ছৈলা গাছ মরে পড়ে আছে। পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) অজিত কুমার রুদ্র বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের তলদেশ ভরাট হয়ে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। ফলে সাগর সংলগ্ন বনাঞ্চল ক্রমান্বয়ে নদীতে বিলীন হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শ্বাসমূলীয় বনের গঠনে তিনটি স্তর আছে। প্রথমত উপকূলে ভূমি গঠনের পর উড়িগাছ জন্মায়। দ্বিতীয়ত মাটি কিছুটা শক্ত হলে উড়িগাছ মরে গিয়ে কেওড়া, বাইন, গেওয়া ও ছইলা গাছ জন্মায়। তৃতীয়ত মাটি আরও শক্ত হলে আগের গাছগুলো মরে গিয়ে ওইখানে সুন্দরী, গরান, পশুর ও কাঁকড়াসহ অন্যান্য গাছ জন্মায়। শ্বাসমূলীয় গাছগুলো অভিযোজন পদ্ধতিতে শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করে। জোয়ারের পানিতে লবণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার গাছ মরে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শ্বাসমূলীয় গাছ ও টেংরাগিরি বনাঞ্চল রক্ষায় বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ লাগানো ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা টিম কাজ করছে। বনরক্ষীদের যোগসাজশে বনাঞ্চলের গাছ কেটে নেয়ার কথা অস্বীকার করে আরও বলেন, সাগর পাড়ের কিছু গাছ জেলেরা চুরি করে কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
×