ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ার শিশু পরিবার

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

বগুড়ার শিশু পরিবার

বগুড়া শিশু পরিবারের নিবাসীদের অনেকেই এখন উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ গান নাটক খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় সুনাম কুড়িয়েছে। গেল বিজয় দিবসের ডিসপ্লেতে তারা প্রথম স্থান অধিকার করেছে। বগুড়া শিশু পরিবারে প্রায় দেড় বছর আগে ৬৫ বছরের উর্ধে নারীদের বৃদ্ধাশ্রমের দশটি আসন সংরক্ষিত আছে। প্রচারের অভাবে এবং অনেক ক্ষেত্রেই বৃদ্ধাদের অনাগ্রহের কারণে বৃদ্ধাশ্রম ফাঁকাই থেকে যায়। সবচেয়ে পুরনো বগুড়ার এই শিশু পরিবার। ১৯৫৯ সালে কয়েকটি ঘর নিয়ে নগরীর উত্তরে ফুলবাড়ি এলাকায় মহাসড়কের ধারে শিশু পরিবার প্রতিষ্ঠা করা হয়। আগে নাম ছিল সরকারী এতিম খানা। প্রথম দিকে এতিম ছেলেদের এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তির পর একাডেমিক ও কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয়। ১৯৬২ সালে ১৩ দশমিক ২২ একর জায়গার ওপর ইমারতের অবকাঠামো নির্মিত হয়। নাম হয় সরকারী শিশু পরিবার। অবকাঠামো স্থাপনা ছাড়াও এর মধ্যে আছে সুপ্রশস্ত সড়ক, বড় মাঠ, শিশু বিনোদনের স্থান, আম কাঁঠাল ও ফলফলাদির বাগান। তিনটি বড় পুকুর। যার একটি সান বাঁধা। ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এই শিশু পরিবারে শুধু এতিম ছেলেদের নিবাসী করা হতো। ১৯৮৪ সাল থেকে বগুড়া শিশু পরিবার শুধু এতিম মেয়েদের নিবাসী করা হয়। উল্লেখ্য, যারা শিশু পরিবারে থাকে তাদের বলা হয় নিবাসী। বর্তমানে এই শিশু পরিবারে নিবাসীদের মোট আসন ১৭৫। এর মধ্যে মেয়ে নিবাসী আছে ১৬৩ জন। যারা প্রাক প্রাথমিক শ্রেণী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করছে। দশটি আসন বৃদ্ধাশ্রমের জন্য নির্ধারিত। বয়স্ক নারী যারা নানা কারণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন তারা শিশুদের মধ্যে আনন্দঘন পরিবেশে থেকে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন সে জন্য সরকার প্রতিটি শিশু পরিবারে বৃদ্ধাশ্রম চালু করেছে। তবে এখনও কোন বয়স্কা নারী আশ্রমে থাকার জন্য আসেনি। দুই একজন এসে খোঁজখবর নিয়েছিলেন। পরে তারা আর আসেননি। এই পরিবারের নিবাসী শোভা খাতুন (১৫)। বগুড়ার উলিপুর গ্রামে তার বাড়ি। বাবা মাসুদ শেখ গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। মা পারভীন খাতুন কোন রকমে স্বামীর ভিটায় থেকে কৃষি কাজ করে দিনযাপন করেন। শোভা খাতুন এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রিকেট হকি ও ব্যাডমিন্টন খেলে সুনাম কুড়িয়েছে। বগুড়ার পশ্চিম পালশার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস (১৬)। বর্তমানে সে সরকারী মজিবর রহমান মহিলা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় সে এই শিশু পরিবারের নিবাসী হয়। ছেলেবেলায় তার বাবা আবদুস সালাম মারা যান। জান্নাতুলের ইচ্ছা সে উচ্চ শিক্ষা নেবে। নিবাসী তানজিলা আক্তার (১৫) ফুলবাড়ি উত্তরপাড়া থেকে ২০০৬ সালে এসেছে। সেও সরকারী মজিবর রহমান মহিলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বাবা গত হয়েছেন। মা সাদিয়া গৃহকর্ম করেন। এক ভাই একবোনের মধ্যে বড় ভাই সিএনজিচালিত অটোরিক্সা চালায়। তার ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে উচ্চশিক্ষা নেবে। বছিরন খাতুন (১৫) এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। এই নিবাসীর বেশিরভাগই ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ নিচ্ছে। শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক নাহিদা ইসলাম বললেন, নিবাসীদের লিখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চায় গড়ে তোলা হয়। নাচ ও গানের শিক্ষকও আছেন। নিবাসীদের লেখাপড়ার জন্য কাছের কোন স্কুল ও কলেজ বেছে নেয়া হয়। তারা পাঠ শেষে ফিরে আসে। শিশুদের ইনডোর আউটডোর গেমসে পারদর্শী করে তোলা হয়। অবসরে এরা খেলে। শিশুদের ১৮ বছর পর্যন্তই থাকার নিয়ম। কেউ উচ্চতর ডিগ্রী নিতে চাইলে তাদের সহযোগিতা দেয়া হয়। ভাল বর পেলে নিবাসীদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। বিয়ের পর তাদের রোজগারের জন্য যে কারিগরি শিক্ষা পেয়েছে তা কিনে দেয়া হয়। কারিগরি শিক্ষার মধ্যে দর্জি প্রশিক্ষণ, উল বুনন, এ্যাম্ব্রয়ডরির সঙ্গে বর্তমানে কম্পিউটার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিজন নিবাসীর জন্য মাসে বরাদ্দ আছে ২ হাজার ৬শ’ টাকা। এর মধ্যে খাবারের জন্য বরাদ্দ ২ হাজার টাকা। বাকি অর্থ শিশুদের অন্যান্য খরচের জন্য বরাদ্দ। প্রতিদিন সকাল ও বিকেলের নাস্তা, দুপুর ও রাতে ভাত খাবার দেয়া হয়। শিশুরা যাতে পুষ্টিযুক্ত খাবার পায় সে জন্য মাছ মুরগি দুধ সবজিসহ উন্নতমানের খাবার দেয়া হয়। চিকিৎসার জন্য খন্ডকালীন একজন চিকিৎসক আছেন। বগুড়ার সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক শহীদুল ইসলাম খান জানালেন এই শিশু পরিবারে বগুড়ার বাইরের জেলা থেকেও অনেক শিশু আসছে। বগুড়া শিশু পরিবার উন্নতমানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×