ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুভাষ সিংহ রায়

বই এবং বই নিয়ে মেলা

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

বই এবং বই নিয়ে মেলা

বই লেখা আর পাঠকের হাতে তা পৌঁছানো, এর মাঝে অনেক স্তর আছে। প্রথমেই প্রয়োজন টাকার। বই ছাপানোর টাকা কোন লেখকের ছিল, কারও বা ছিল না। এগিয়ে এলেন কিছু মানুষ। তাঁরা হলেন পৃষ্ঠপোষক। তখন পৃষ্ঠপোষক শুধু ব্যক্তি নন, প্রতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতাও ছিল অসহায় লেখকের ভরসা। ব্যক্তিগতভাবে একক বা যৌথ, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সভা-সমিতি বা রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা দেখা গেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পোর্ট উইলিয়াম কলেজ, ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি, বিভিন্ন সভা-সমিতি, বর্ধমান রাজসভা এবং অন্যান্য অনেক রাজা-মহারাজা বাংলা বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁরা নানারকমভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। কখনও বই বেরনোর আগেই কয়েক শ’ কপি কিনবেন বলে আগাম প্রতিশ্রুতি দিতেন অথবা বই বেরনোর পর বেশকিছু কপি কিনতেন। কখনও বই ছাপানোর পুরো খরচটাই দিতেন অথবা লেখকদের অর্থ সাহায্য করতেন। আধুনিক যুগে বইয়ের প্রকাশকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। আর এখনকার সময়ে বইমেলা এসব ক্ষেত্রে বড় রকমের পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগ করে দেয়। মুদ্রণের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দান হলো জ্ঞানের মুক্তি। মুদ্রণ-পূর্ব যুগে জ্ঞানের একমাত্র উপকরণ কয়েকটি পুঁথি কয়েকজনের করায়ত্ত ছিল। তাঁরা ছিলেন বিদ্যার পুঁজিপতি। শিষ্যগুরুকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে বিদ্যালাভ করা সম্ভব না। শিক্ষার্থীদের জাত বিচার করা হতো, সকলের পড়াশোনার অধিকারও যারা পেত তাদেরও অবাধে পুঁথির ব্যবহার করতে দেয়া হতো না। গুরু পড়ে যেতেন, শিষ্যরা শুনে মুখস্থ করত। এই ছিল সাধারণ রীতি। গুরুর অনুমতি ছাড়া পুুঁথি কেউ নকল করে নিতে পারত না এবং এই অনুমতি ছিল দুর্লভ। মিথিলা থেকে ন্যায়ের পুঁথি নকল করে আনার অনুমতি না পেয়ে ন্যায় শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে মিথিলা হীনপ্রভ হয়ে পড়ল, খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল নবদ্বীপের। সকলের কাছে যদি পুঁথি সহজলভ্য হয় তা হলে জ্ঞানের রাজ্যে গুরুর আধিপত্য ক্ষুণœ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ॥ দুই ॥ আমাদের বইমেলার ইতিহাস নিয়ে একটু কথা বলা যেতে পারে। শুধু দেশের মানুষ নয় , প্রবাসী বাঙালীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অপেক্ষা করে এই বই মেলার জন্যে। পৃথিবীর কোথাও এত দিনব্যাপী বই মেলা হয় না। এবারও ২৮ দিনের বই মেলা। নানান দেশের নানান রকমের বইমেলার কথা জানি। প্রায় সবক’টিই আন্তর্জাতিক বইমেলা। যেমন দিল্লীর আন্তর্জাতিক বইমেলা হয় নয় দিনের; এবারের হয়েছে ৬ জানুয়ারি থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত হয়েছে। কলকাতার বইমেলা শুরু হবে ৩০ জানুয়ারি এবং ১১ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে। লন্ডনের তিন দিনের বই মেলা এপ্রিলের ১২ তারিখ থেকে ১৪ পর্যন্ত হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা হয় জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট শহরে, যা প্রতিবছর ১৯ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত ৫ দিনে শেষ হয়। তেহরানে আন্তর্জাতিক বইমেলা হয় ১১ দিনের; এবার শুরু হবে ৩ মে আর চলবে ১৩ মে পর্যন্ত। দুবাই এর আন্তর্জাতিক বইমেলা ২৬ এপ্রিল শুরু হবে এবং ৭ দিন চলবে। আগরতলার বইমেলা চলে ১২ দিনব্যাপী। অর্থাৎ আমাদের মতো মাসব্যাপী বইমেলা পৃথিবীর কোন দেশে হয় না। বাংলাদেশের সবার আগে বইমেলা হয় যশোর জেলায়। ১৯৬৭ সাল থেকে যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরিতে বইমেলা হয়। সেই সময়কার এই মেলার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম রওশন আলী। কেননা তিনি টানা ২০ বছর যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন (১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল)। সেই আয়োজনে যশোরের বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একদিন করে বইয়ের প্রদর্শনী ও আলোচনা সভার ব্যবস্থা করত। কিন্তু ‘বইমেলা’ বলতে যা বোঝায় বড় পরিসরে জাতীয়ভাবে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে। ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ ১৯৭২ উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ঢাকায় আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক মরহুম সরদার জয়েনউদ্দীন অতুলনীয় সাংগঠনিক দক্ষতা অত্যন্ত সীমিত সম্পদকে পুঁজি করে ঢাকায় প্রথম আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। ১৯৭৩ সালে সরদার জয়েনউদ্দীন ফ্রাঙ্কফুট আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার সরকারিভাবে যোগদান শেষে ওই মেলার বিভিন্ন সুভেনির ও বিভিন্ন কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার জাতীয় গ্রন্থমেলা ও গ্রন্থপ্রদর্শনীর জন্য বার্ষিক ১ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়। এ দুইয়ের সমন্বয়ে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় গ্রন্থমেলা সেগুনবাগিচায় আর্ট কাউন্সিল ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় গ্রন্থমেলার নিয়মাবলী ও স্টল নির্মাণে ওই ফ্রাঙ্কফুট আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলাকে অনুকরণ ও অনুসরণ করা হয়। জাতীয়/ঢাকা আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারীদের তৈরি স্টল বরাদ্দ, মেলায় বিদেশেীদের অংশগ্রহণ এবং প্রকাশক ছাড়াও গ্রন্থ সংশ্লিষ্ট উপকরণ বিক্রি ও প্রদর্শনীর সুযোগের ব্যবস্থা তারই ফল। মেলা অনুষ্ঠিত হয় ১৪ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত। এতেও দেশের ১৯টি প্রকাশনা সংস্থা, ৬টি বিদেশী দূতাবাস ও সংস্থা যোগদান করে। এ আয়োজন আজও বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতে একটি অনন্য ঘটনা হিসাবে পরিচিত। ড. মুহম্মদ এনামুল হক, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, শওকত ওসমান, আবদুল গণি হাজারী, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সচিব অধ্যাপক আহমদ হোসেনসহ দেশের তৎকালীন সম্মুখভাগের বুদ্ধিজীবীদের আন্তরিক সহযোগিতায় ৪ মেলা অত্যন্ত সাফল্য লাভ করে। গ্রন্থমেলাটির আয়োজন হয়েছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে, ২০ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো মেলাপ্রাঙ্গণ যেমন মুখরিত রেখেছিল, পাশাপাশি তেমনই মেলাবন্ধন ঘটেছিল লেখক-প্রকাশকসহ গ্রন্থপ্রেমী সংস্কৃতিসেবীদের। মেলায় অংশ নেয় সে সময়কার প্রায় সকল উল্লেখযোগ্য প্রকাশক, ভারতের ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, ঢাকায় অবস্থিত সোভিয়েত ব্লকের প্রায় সকল দূতাবাস, ব্রিটিশ কাউন্সিল ও আমেরিকান দূতাবাস। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বেসরকারীভাবে বই বিক্রির সূত্রপাত ঘটে অনানুষ্ঠানিকভাবে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি বিশেষ মাত্রা পায়। এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রচুর জনসমাগম হয়। মুক্তধারার শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা ওই উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় প্রকাশিত বিভিন্ন বইসহ কতিপয় সদ্য প্রকাশিত বই বাংলা একাডেমির মাঠে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি মহান একুশে মেলা উপলক্ষে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে নিজস্ব বই বিক্রির ব্যবস্থা করে, পাশাপাশি মুক্তধারা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স, এবং দেখাদেখি আরও কেউ কেউ বাংলা একাডেমির মাঠে নিজেদের বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। ১৯৭২ কিংবা ১৯৭৩ সালে এ জন্য কোন স্টল তৈরি হয়নি। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু ওই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। ওই উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রফেসর আবু মহাম্মেদ হবীবুল্লাহ। ওই গণজমায়েতকে সামনে রেখে ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশক বাংলা একাডেমির পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় যে যার মতো কিছু স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৯ সালে মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা, ইউপিএলের মহিউদ্দিন আহমেদ, আহমদ পাবলিশিং হাউসের মহিউদ্দিন আহমদ, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমীন নিজামী, নওরোজ কিতাবিস্তানের কাদির খান, খান ব্রাদার্সের ফিরোজ খান, প্রমুখ কতিপয় প্রকাশক বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে বই বিক্রির আয়োজনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বইমেলায় রূপান্তরিত করার জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক ফজলে রাব্বির কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ রাখেন। ওই মেলা শেষে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাসিক ‘বই’ পত্রিকার এপ্রিল, ১৯৭৯ সংখ্যায় লেখা হয়: ‘এ বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একুশে দিনের এক গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হলো। ... এবার একুশে উপলক্ষে ঢাকায় গ্রন্থমেলা আয়োজকের মূল উদ্যোক্তা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, সহযোগিতা করেছেন, বাংলা একাডেমি এবং স্থানীয় প্রকাশকরা। মেলা শুরু হয় ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে। এদিন সকাল দশটায় ছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর আবদুল হালিম চৌধুরী। রোজই দুপুর তিনটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লোকজন এসেছেন। স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছেন এবং প্রতি স্টলেই কমবেশি বই বিক্রয় হয়েছে। ২২টি স্টল ছাড়াও মেলা প্রাঙ্গণের টেবিল পেতে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শন ও বিক্রির ব্যবস্থা করেছিল উৎসাহী সাহিত্যামোদী তরুণরা। আয়তনের দিক থেকে বড় স্টল ছিল মুক্তধারার। ২১ দিনে মুক্তধারা বই বিক্রি করেছে প্রায় ৫২ হাজার টাকার। বিক্রির দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে আহমদ পাবলিশিং হাউসের। দু’একটি শৌখিন এবং স্বল্পসংখ্যক বইসম্পন্ন স্টল ছাড়া প্রতিটি স্টলেই দশ হাজার টাকার উর্ধে বই বিক্রি হয়েছে। ২১ দিনের এই মেলায় বিক্রির পরিমাণ আনুমানিক প্রায় চার লাখ টাকা। চলবে... লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×