ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্যার...

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

স্যার...

গত শতকের মধ্য-ষাটের দশকে একটি মাসিক সাহিত্য (পত্রিকা) নাম ‘পুবালী’ বাড়িতে নিয়মিত আসে, ডাকযোগে। প্রাপক জিয়া হায়দার। পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। অগ্রজ রশীদের কাছে জানলুম মূলত কবি তিনি। প্রাবন্ধিকও। এও জানা গেল তাঁর শ্বশুর বিখ্যাত সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। পূর্ব পাকিস্তানে তখন সাহিত্য পত্রিকার ঢল নামেনি, সাকুল্যে দু’তিনটি, তাও অনিয়মিত। পুবালীও টেকেনি বেশি দিন। পুবালীর কয়েক সংখ্যায় দেখি পাতাজুড়ে একটি বইয়ের বিজ্ঞাপন। ‘পিঙ্গল আকাশ’। লেখক শওকত আলি। অভিনব বিজ্ঞাপন। কিংবা বলা উচিত, আধুনিক বিজ্ঞাপন। উপন্যাস (পিঙ্গল আকাশ) নিয়ে কার কী মন্তব্য। মুনীর চৌধুরীসহ আরো সাহিত্যবোদ্ধা, বিজ্ঞজনের। সবই প্রশংসামূলক। কৌতূহল হয়। বাজার থেকে চুরি করা টাকায় (দুই মাসের চুরি গুছিয়ে) কিনলুম। অনেক রাত অবধি, স্কুলের পড়া না পড়ে পড়লুম ‘পিঙ্গল আকাশ’। পৃষ্ঠা তিরিশ। মাথায় ঢুকলো না। ধ্যেৎ। ‘পিঙ্গল’ মানেই জানি না। ‘জ্ঞানীদের মন্তব্যে’ সন্দেহ হলো। হবেই। পড়ার দৌড় (তথা বিদ্যে) ‘দস্যু বনহুর’। বড়ো জোর ‘শ্রীকান্ত’। ওই বয়সে (অন্যের জ্ঞানগম্যি অজানা), কৈশোরও উত্তীর্ণ নয়, এ্যাডভেঞ্চার-ট্যাডভেঞ্চারই জমজমাট (গল্প/উপন্যাস)। সমাজ-রাজনীতি-ইতিহাস-প্রেমট্রেমের কূটকাচালি, ফিলোসফি, তত্ত্বকথার ঘোরপ্যাঁচ মগজে ঢোকে না। ঢোকেনি।) চুরি করা টাকা গচ্চা গেল, ভেবে মেজাজ তিরিক্ষে। এও বাহ্য। লোয়াভাই (অগ্রজ মাকিদ) বলেন, “শহীদুল্লাহ (ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) হইছিস, ‘পিঙ্গল আকাশ’ পড়িস?” হেনা (ফরিদা হায়দার। দুই বছরের বড়ো। অতিশয় পাকা। ‘শেষের কবিতা’ পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।) কয়, ‘পিঙ্গল আকাশ’ পড়লেম, সব বুঝলেম না, মনে হয় ভালোই ল্যাগেছে। বিয়ের পর আবার পড়বো, তুই-ও বিয়ের পর পড়লি বুঝবো।” - তো, বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করতেই হয়। বিপ্লবী হওয়ার খুব হাউস (শখ) ছিল। যদিও সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে পড়াকালীনই মাক্সবাদে দীক্ষা, ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত, ‘তরুণ কমরেড’, ‘পান্ডা’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি। শুনেছিলুম, জগন্নাথ কলেজ ‘ছাত্র বিপ্লবের আখড়া’। শোনা-কথা সত্যি নয় কখনো-কখনো। এক দঙ্গল ছাত্র। ছাত্রীর সংখ্যা কম। ছাত্ররা না-রাজনীতিক, না বিপ্লবী। অযথা দাঙ্গা হাঙ্গামায় পারঙ্গম। ইস্যু কিংবা অইস্যু ছাড়াই। জগন্নাথ কলেজে, প্রথম দিনে, ক্লাসে অধ্যাপক হারুন-উর রশীদ। (পরে চট্টগ্রাাম বিশ্ববিদ্যালয়ে?- নাকি জাহাঙ্গীর?- মনে পড়ছে না। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদেও আসীন। বিএনপি-ঘেঁষা)। ইংরেজির অধ্যাপক। শেক্সপীয়রের একটি সনেট (কত সংখ্যক। মনে পড়ছে না) গদ্্গদ কণ্ঠে পাঠ করে ব্যাখ্যা করলেন। না বুঝে নোট নিলুম। পরবর্তী ক্লাস বাংলা। ক্লাসে এলেন অধ্যাপক। দীপ্তিমুখর চেহারা। কালো। ছাত্রছাত্রীকে পরিচয় দিলেন, “আমার নাম শওকত আলি। রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ পড়বো। তোমাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবে।” (হুবহু এই রকমই বলেছিলেন কী?- ভুল হতে পারে)। রবীন্দ্রনাথের ভাষা, ভাষার গাঁথুনি, গল্পের মুন্সিয়ানা, গল্পের চাতুর্য ও গল্পের শিল্প বিষয়ে বলছিলেন। জানান, বাংলা গল্প, ছোট গল্প, বাংলা গদ্য ও বাংলা ভাষা রবীন্দ্রনাথের হাতেই মুক্তি। বাংলা ভাষায় যে কথা বলি, পরিশীলিত কথা বলি, পরিশীলিত গদ্য সাহিত্যে, রবীন্দ্রনাথের রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ব্যতিরেকে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য নয়। রবীন্দ্রনাথই মাথার উপরে, গনগনে সূর্য। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার দুই কদম চলার পথ নেই। -আরো কী কী বলছিলেন, সব মনে নেই পঞ্চাশ বছর পরে। যেহেতু লেখাপড়ায় অজ্ঞ, আচমকা প্রশ্ন করি, “স্যার, ‘কিন্তু তথাপি’ একই বাক্যবন্ধে সঠিক কী? লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, ছোট গল্পেই। দশ লাইনের কথকতায় ছয়বার ‘কিন্তু’, পাঁচ বার, ‘করিয়া’, চারবার ‘সে’, চারবার ‘তাহার’। এও বাহুল্য। গদ্যে ‘সাথে’ এবং ‘সঙ্গে’ মিশ্রণ। বিস্তর গল্পে তথা গদ্যে এই ‘ভাষা’। ভুলও। রবীন্দ্রগদ্য নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়া কতটা সম্মত? স্যারের প্রশ্ন, ‘কে হে তুমি? রবীন্দ্রনাথের বাংলা নিয়ে প্রশ্ন করছো? কে হে তুমি? কতটা প-িত হে? কি জানো বাংলা ভাষার? কী নাম তোমার?’ মুখ কাচুমাচু করে, স্যারের দিকে চোখ না তুলে বলি, নাম।-হায়দার? জিয়া হায়দার, রশীদ হায়দারের নাম শুনেছ? কেউ হয় তোমার? ধমকে ভ্যাবাচাকা। অস্বীকার। বলি, ‘না’। রবীন্দ্রনাথ ছোট গল্পে, নানা কথায়, সংলাপে, বর্ণনায় বিস্তর ভুল লিখেছেন বাংলায়। ব্যাকরণ বিচারে। তর্ক করবেন না। পাকামো করবেন না। মানতে হবে শতাধিক বছর আগের রবীন্দ্রনাথ। আজকের বাংলা ভাষার হালহকিকতে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্নবোধক। - ঠিক এই কথাই মানছিলেন স্যার (শওকত আলি)। অবশ্য, ওঁর যুক্তিও ছিল নানা সঙ্গ-অনুসঙ্গে। মানা-অমানা। স্যারের লেখা পড়ে কতটা আন্দোলিত, ছাত্রের বলা অনুচিত। বন্ধুমহলে আলোচনা, ‘শওকত আলি বাংলাাদেশের সাহিত্যে নবদিগন্ত।’ কতটা নবদিগন্ত?- এই নিয়ে, বাংলাদেশের কবিতা-গল্প-উপন্যাস বিষয়ে কলকাতার এশিয়া সোসাইটিকে তিনদিন লেকচার দিয়েছিলুম (লেকচার নিয়ে দ্য স্টেটসম্যান-এর রিপোর্ট প্রকাশিত)। উপন্যাস প্রসঙ্গে শওকত আলি। শ্রোতাদের অনেকেই জানতে চান, কোথায় পাবো শওকত আলির উপন্যাস? শওকত আলির গদ্য, ভাষা, কাহিনী, গল্প, উপন্যাস বিষয়ে যা বলেছেন, নিশ্চয় মহত্তম লেখক।’ লেখক মানে গল্প বা উপন্যাসের। শওকত আলি আরো কিছু। দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য সম্পাদকতায় যুক্ত, হরেক পরিকল্পনা, রণেশদা (রণেশ দাশগুপ্ত) বললেন, “শওকত আলিকে বলো কবিতা লিখতে। শওকত ভালো কবি।” স্যারকে বলি। রাজি হন। এক গুচ্ছ কবিতা পাঠান। প্রকাশিত করি। ১০০ টাকা দিই। খুশি হন। বলি, ‘স্যার, ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে হবে। প্রতি কিস্তির জন্যে ৫০ টাকা দেব।’ আঁতকে ওঠেন। “সংবাদ ৫০ টাকা দেবে?” বলি, ‘যুগ্ম সম্পাদক বজলুর রহমান আপনাকে দিয়ে সাপ্তাহিক কলামও লেখাবেন, রাজি হবেন?’ স্যার বলেন, “তুমি জিয়া-রশীদের ভাই, না, সব আবদার নয়।” - স্যার শওকত আলি, কবি-ঔপন্যাসিক, তাঁর গুণপনায় নিজেকে ধন্যমানি, বহু অভিধায়। ২৬ জানুয়ারি, ২০১৮ বার্লিন, জার্মানি
×