ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংলাপ এখন বিলাপে পরিণত হয়েছে

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

সংলাপ এখন বিলাপে পরিণত হয়েছে

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট (ক’টা দল নিয়ে জোট তা কেউ জানে না) দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সঙ্গে ‘সংলাপ’-এ বসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সভা-সমাবেশ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, সংবাদ সম্মেলন, কর্মী সম্মেলন সবখানে এক কথা ‘সংলাপ চাই’ ‘সংলাপ চাই’। একটু ভালভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তাদের এই ‘সংলাপ’ এখন ‘বিলাপে’ পরিণত হয়েছে। কেন এই সংলাপ, কি কারণে এই সংলাপ, তা কিন্তু জনগণের কাছে পরিষ্কার নয়। যত দূর তাদের কথাবার্তায় বোঝা যায়, তা হলো যে কোনভাবেই হোক প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা সংলাপে বসে খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন। কেবল তা হলেই সংলাপ সফল হয়েছে বলে প্রচার পাবে, গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হবে। আসলে যতদিন পর্যন্ত খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হবেন না বা বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় যাবে না ততদিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে ন॥ মোটামুটি আওয়ামী লীগ বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংলাপের নামে খালেদার সঙ্গে এক টেবিলে বসাতে পারলে তারা জাতে উঠতে পারবেন। ছেলেবেলার পাঠ্যবইয়ের সেই গল্পটির মতো বিএনপি আহা বেশ বেশ বলে একটি জবাব তৈরি করতে পারবে... গল্পটির লেখক বা গল্পকারের নাম মনে নেই, কোন্ ক্লাসে পড়ানো হতো তাও ভুলে গেছি। তবে গল্পটা ভুলে যাইনি। খুবই মজার গল্প। নন্দিগ্রাম আর অষ্টগ্রাম (গ্রামের নাম কাল্পনিক)। শিক্ষার কিছু আলো পড়েছে দুই গ্রামেই, অর্থ-সম্পদের দিক দিয়েও কেউ কারও কাছে কম যায় না। দুই গ্রামই কে বড় কে ছোট এটা প্রমাণ করতে মরিয়া। এক গ্রাম ফুটবল খেলার আয়োজন করে তো অন্য গ্রাম হাডুডু টুর্নামেন্ট ঘোষণা করে। এক গ্রাম বাজার থেকে বড় রুই মাছটা কিনলে অন্য গ্রাম সবচেয়ে বড় চিতল মাছটা নিয়ে হেইয়া হো ধ্বনি দিয়ে কাঁধে করে অপর গ্রামের পাশ দিয়ে বাড়ি ফেরে। নন্দিগ্রাম ভাবল গ্রামের উন্নয়ন করতে হলে সবাইকে শিক্ষিত হতে হবে এবং তাতে করে অষ্টগ্রামকে হারাতেও বেগ পেতে হবে না। দেখা গেল তাদের সঙ্গে সঙ্গে অষ্টগ্রামও স্কুল বানাতে শুরু করেছে। অল্পদিনেই দুই গ্রামে স্কুল গড়ে উঠেছে এবং শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কোন্ গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার বেশি লেখাপড়া জানে। এই বিতর্ক চরম পর্যায়ে উঠে দুই গ্রামের মধ্যে ঝগড়াঝাটির পর্যায়ে চলে যায়। তখন দুই গ্রামের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন বললেন- ঠিক আছে, প্রকাশ্যে দুই হেডমাস্টারের বিতর্ক হবে। তখনই বোঝা যাবে কে বেশি শিক্ষিত। তবেই ঝগড়াও থেমে যাবে। তারিখ হলো দুই গ্রামের মাঝের সীমানায় একদিকে নন্দিগ্রামের স্কুলের হেডমাস্টারের নেতৃত্বে ঐ গ্রামের জনগণ, অপরদিকে অষ্টগ্রামের হেডমাস্টারের নেতৃত্বে ঐ গ্রামের জনগণ পরস্পর মুখোমুখি। সিদ্ধান্ত হলো দুই হেডমাস্টার একে অপরকে প্রশ্ন করবেন। লটারির মাধ্যমে স্থির হলো প্রথম প্রশ্ন করবেন নন্দিগ্রামের হেডমাস্টার। তিনি সোজাসাপটা একটা অঙ্কের প্রশ্ন করলেন। অষ্টগ্রামের হেডমাস্টার সঠিক উত্তর দিলেন। এবার অষ্টগ্রামের প্রশ্ন করার পালা। অষ্টগ্রামের হেডমাস্টার লেখাপড়া জানেন কম, কিন্তু গ্রাম্য চালাকিটা জানেন বেশ। নন্দিগ্রামের হেডমাস্টার লেখাপড়া বেশ জানেন ঠিকই; কিন্তু চালাকি জানেন না। তিনি প্রশ্ন করলেন, বলুন তো দেখি ‘ও ফড়হ’ঃ শহড়’ি অর্থ কী? নন্দিগ্রামের হেডমাস্টার সরল মনে সঠিক উত্তরটিই দিলেন ‘আমি জানি না’। ব্যস, অষ্টগ্রাম সমস্বরে চিৎকার করে উঠল ‘নন্দিগ্রাম জানে না’, ‘নন্দিগ্রাম জানে না’, স্লোগান দিতে দিতে গ্রাম ঘুরে বেড়াল। নন্দিগ্রামের হেডমাস্টারকে তার ব্যাখ্যা দেবার সুযোগও দিল না। অষ্টগ্রাম তো জানলই, এমনকি নন্দিগ্রামের কেউ কেউ কথাটা বিশ্বাস করল এবং হার মেনে নিল। কিন্তু এটা আমাদের বাপ-দাদাদের আমলও নয়, আমাদের ছেলেবেলাও নয়। এই চালাকি চলবে না। যেমন করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার প্রায় ২০ ঘণ্টা পর মিলিটারি জিয়াকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাঠ করানোর পর জিয়াপতœীসহ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং স্বাধীনতাবিরোধীরা ‘জিয়া ঘোষণা করল, দেশ স্বাধীন হলো’ বলে খালি মাঠে গোল দেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। কেননা, এখনকার অর্থাৎ পঁচাত্তর পরবর্তী সমাজ অষ্টগ্রাম নয়, অষ্টগ্রামের হেডমাস্টারের মতো অশিক্ষিত-স্বশিক্ষিত বটে, কিন্তু চালাকিতে শরৎ বাবুর মেসোমশাই। এখনকার সিনাথ বহুরূপী ও লেজবিহীন। তাকে কাবু করার জন্য শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রনাথকে ডাকতে হলো। পিসিমা বললেন, বাড়িসুদ্ধ এতগুলো লোক, রোজ হাঁড়ির পর হাঁড়ির ভাত শেষ হয় অথচ সিনাথ বহুরূপীর ভয়ে সবাই চাঙ্গে উঠেছে। ইন্দ্রনাথ না এলে কি যে হতো? শোনা যায় ইন্দ্রনাথ নাকি ছাত্রলীগ করত! আমাদের বাপ-দাদাদের আমল অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আমাদের আমল শেষ না হলেও স্কুল-কলেজ জীবনটা এখন আর নেই। তবে সিনাথ বহুরূপীর সংখ্যাও দিন দিন কমতে কমতে নিঃশেষ হওয়ার পথে এসে লাভজনক একটা পন্থা খুঁজে পেয়েছে। এমনিতেই বহুরূপী, কাজেই রং বদলাতে সময় লাগে না। এখন কখনও সুশীল সমাজ, কখনও লেখক গবেষক, কখনও বুদ্ধির ফেরিওয়ালাÑ এমনি নানান নাম ধারণ করে সমাজে বেশ আরাম-আয়েশই আছেন এরা। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দেয়া প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলের সুবাদে কামাই-রোজগারও কম হচ্ছে না। কেউ কেউ আবার ঝকঝকা-তকতকা রঙিন পোশাক নিয়ে স্ক্রিনে হাজির হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তারা নাকি অন্ধ, কিছু দেখতে পান না; বধির, কিছু শুনতে পান না। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে যেমনটি বলেনÑ সমস্ত পৃথিবী আজ স্বীকার করছে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। অথচ আমাদের ওনারা সুশীল না অসুশীল জানি না, তারা কিছুই দেখেন না, কিছুই শোনেন না। তারা চোখ থাকতে অন্ধ, কান থাকতে বধির। সংসদ সদস্য ফজিলাতুন্নিসার সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রশ্নকর্তাই জবাব দিয়ে দিয়েছেন। তাদের কথাবার্তা শুনলে এক বিশেষ প্রাণীর কথা মনে পড়ে। এই সুশীল বাবুদের ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ আছে, কিন্তু জনগণের কাছে গিয়ে ভোট চাওয়ার সাহস নেই। কারণ তারা জানে এদের মধ্যে সব মেসোমশাই, একটাও ইন্দ্রনাথ নেই। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এক সার্কাসের গাধার গল্প শোনান। সার্কাস পার্টিতে এক সুন্দরী কন্যা তার এ্যাক্রোবেট দেখাতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তখন সার্কাস পার্টির মালিক মাস্টার তাকে ধমকে বললেন, এরপর যদি তুমি ব্যর্থ হও তাহলে তোমাকে ঐ গাধার সঙ্গে বিয়ে দেব। গাধা সার্কাস মাস্টারের কথা শুনে ফেলেছে এবং নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করে সার্কাস মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে কখন মেয়েটি নিচে পড়বে এবং সে বিয়ে করবে। কিন্তু মেয়েটিও আর পড়ে না, গাধাও বিয়ে করতে পারছে না। আমাদের সুশীল বাবুদের অবস্থাও তাই। শুরু করেছিলাম নন্দিগ্রাম আর অষ্টগ্রাম নিয়ে। সেই আদিকালের গল্প। সেই গল্পেরই আরেকরূপ দেখা যাচ্ছে সংলাপ এবং এই সংলাপ এখন বিলাপে পরিণত হয়েছে। বিলাপ থামছে না, কারণ বিএনপি-জামায়াত জানে কোন রকমে একবার সংলাপে বসানো গেলে বিএনপি আবার সমানে সমান হয়ে যাবে এবং অষ্টগ্রামের অর্ধশিক্ষিত অথচ ধূর্ত শিয়ালের মতো বলতে পারবে, এই দেখুন না খালেদা জিয়া বলেছিলেন সংলাপ করতে, ওবায়দুল কাদের তা মানতে বাধ্য হয়েছেন। অষ্টগ্রামের হেডমাস্টারের মতো বিএনপির হেড মিস্ট্রেসও দেশব্যাপী বলে বেড়াতে পারবেন, ভুয়া তথ্যের ওপর আমরা জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়েছি (?), এবার সংলাপের দাবি মানতে বাধ্য করিয়ে গাধাকে ঘোড়ার সমান বানাব! কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। তাদের কোন সিনাথ বহুরূপী ধোকা দিতে পারবে না। খুব বেশি দিনের কথা নয়, বাংলাদেশের জনগণ সংলাপ কম দেখেনি- তারানকোর সংলাপ দেখেছে, মান্নান ভূঁইয়া, আবদুল জলিলের সংলাপ দেখেছে। পরিণামে এ বিগ জিরো। আরেকটি সংলাপও বাংলাদেশের জনগণ শুনেছে। সেটি অবশ্য টেলিফোন সংলাপ। প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে বলেছিলেন, আসুন, আমরা বসি, একসঙ্গে বসে ডাল-ভাত খাব এবং আমাদের জাতীয় সঙ্কটগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজব। শেখ হাসিনা তাকে গণভবনে নৈশভোজের নিমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার আন্তরিকতার জবাব কি ভাষায় দিয়েছিলেন টেলিফোনের সেই কথাবার্তা বাংলার মানুষ শুনেছে- সালামের জবাবে গালি। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেন, শেখ হাসিনা সমবেদনা জানাতে খালেদা জিয়ার বাসস্থানে গেলেন, কিন্তু খালেদা তাকে স্বাগত তো জানালেনই না, দরজাও খুললেন না। আমাদের বাঙালী সমাজে রেওয়াজ আছে প্রতিবেশীর সঙ্গে যত ঝগড়াই থাকুক প্রতিবেশীর কেউ প্রয়াত হলে অপর প্রতিবেশী ছুটে যান, সমবেদনা জ্ঞাপন করেন, দাফন-কাফনে সহায়তা করেন। এটির ব্যত্যয় অভদ্রতা এবং এমন ব্যবহার বিএনপি নামক দলটির পক্ষেই সম্ভব। বিএনপি নেত্রী, বিশেষ করে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং তার পরের মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কখনও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, কখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেন, কখনও বলেন সহায়ক সরকারের কথা। কিন্তু এর কোন রূপরেখা জাতির কাছে উপস্থাপন করেননি বা করতে পারেননি। তবে তাদের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের চেহারা জাতি দেখেছে। তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা মিলিটারি জিয়া লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে অন্য কাউকেও ইলেকশন করতে দেননি- হ্যাঁ তে শতকরা ১০০ ভাগেরও অধিক ভোট পকেটে তুলে নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে এই উর্দিপরা ভদ্রলোকই প্রথম ইনক্লুসিভ ইলেকশনের নামে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিষিদ্ধ জামায়াত-শিবির-মুসলিম লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী গণহত্যাকারী নারী ধর্ষণকারীদের রাজনীতিতে নামিয়েছিলেন, সংসদে পর্যন্ত বসিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া তো আজ আচলেই বেঁধে নিয়েছেন। এদের নিয়েই খালেদা জিয়া সংলাপ করতে চান, জাতে উঠতে চান। ঘোড়ার গাড়িতে গাধা জুড়লে গাধারই মর্যাদা বাড়ে। এ জন্যেই সংলাপ সংলাপ করছেন, কিন্তু রূপরেখা দিচ্ছেন না বা দিতে পারছেন না। আমি মনে করি যতদিন না কেউ এসে খালেদা জিয়াকে ক্ষমতার হট চেয়ারে বসাবেন ততদিন সংলাপের দাবি চলবে এবং কেবল তখনই দেশে গণতন্ত্র হবে। নইলে নয়। মাঝে-মধ্যে শুনি সরকার নাকি বেশি উন্নয়ন, কম গণতন্ত্র করছেন, কিন্তু কে কথাটা বলেছেন মির্জা সাহেব বলতে পারছেন না। তবে হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের কেউ বলুক বা না বলুক, মির্জা সাহেবরা এ কথা বলে নিজের পায়েই কুড়াল মারলেন। গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন একটি অপরটির পরিপূরক। বর্তমান বাংলাদেশের চিত্র এটাই। ঢাকা ॥ ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×