ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্যমেলায় মানুষের ঢল

ছুটির দিনে সব স্টল প্যাভিলিয়নেই জমজমাট কেনাকাটা

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

 ছুটির দিনে সব স্টল প্যাভিলিয়নেই জমজমাট কেনাকাটা

ওয়াজেদ হীরা ॥ ছুটির দিন মানেই একটু স্বস্তি। কর্মজীবীদের নেই অফিসে যাওয়ার তাড়া। আর শিক্ষার্থীদেরও নেই স্কুল-কলেজ। কারোই যেন বাড়তি কাজের ঝামেলা নেই ছুটির দিনে। সপ্তাহ শেষে শুক্রবারের দিনটিতে একটু স্বস্তি আর বিনোদন করতে মুখিয়ে থাকে রাজধানীবাসী। আর সেই বিনোদনের খোঁজে পরিবার-পরিজন নিয়ে নগরবাসীর লাখো মানুষের ঢল নামল ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায়। ছোট-বড়, তরুণ-তরুণী, যুবক-বৃদ্ধ মিলেমিশে শেরেবাংলা নগর হয়ে উঠল মানুষের মিলনমেলা। মেলার সময় বাড়ানো না হলে এটিই ছিল শেষ শুক্রবার। যদিও মেলার সময় বাড়ানোর আবেদন জমা পড়েছে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোতে। তবে দর্শনার্থীরা ধরেই নিয়েছেন ছুটির দিন আর হয়ত পাওয়া যাবে না। তাই শেষ সময়ের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা আর সবাই মিলে মেলা উপভোগ করতে সবাই ছুটে আসেন বাণিজ্যমেলায়। মেলার ২৬তম দিন ছিল এটি। বাণিজ্যমেলা শুরুর পর থেকে সর্বশেষ দুটি শুক্রবারেই ভিড় ছিল সবচেয়ে বেশি। এর আগের শুক্রবারও জনাকীর্ণ ছিল মেলাস্থল। দুই শুক্রবারেই মেলায় দর্শনার্থীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে লাখের ওপর বলে জানিয়েছেন মেলার ইজারাদার প্রতিষ্ঠান। ৩১.৫৩ একর জায়গাজুড়ে দেখা গেছে শুধু মানুষ আর মানুষ। ইতোমধ্যেই মেলা শেষের দিকে হওয়ার কারণে ভাঙনের সুর লেগে রয়েছে আবার দর্শনার্থীদের চাপে জমজমাট বিকিকিনিও হচ্ছে। সকাল থেকেই দলবেধে দর্শনার্থী আসতে থাকে মেলায়। দুপুরের দিকে প্রতিটি কাউন্টারের সামনে প্রবেশ টিকেট কাটতে লম্বা লাইন দেখা গেছে। বিকেলের মধ্যেই মেলা এক জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সন্ধ্যার পর অতিরিক্ত ভিড়ে মেলার ভেতরে হাঁটতেও কষ্ট হয়েছে দর্শনার্থীদের। এছাড়াও অনেকেই টিকেট কেটেও প্রবেশ করতে পারেনি। চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও। এত মানুষের চাপে বেচাকেনা নিয়ে বিক্রেতাদের মুখে ছিল সন্তুষ্টির হাসি। বাবার হাত ধরে মেলায় এসেছে ছোট্ট শিশু আবির। মেলায় সুন্দরবন, শিশুপার্ক দেখে মুগ্ধ শিশুটি। সরকারী চাকরে বাবা সালেকিন আহম্মেদ জানালেন, ছুটি ছাড়া আমাদের ঘুরার আর সময় কই। তবে ছুটির দিনেই সবাই আসে ভিড়ও বাড়ে। তবুও পরিবারের আবদারে আসতেই হয়। মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, মেলার ভেতরে দর্শণার্থীদের উপচেপড়া ভিড়ে সামনে পা ফেলে হাঁটা কঠিন হয়ে পড়েছে। মেলার ভেতরেও বিন্দুমাত্র বসার জায়গা নেই। দুপুরের নামাজের পর থেকেই চাপ ক্রমাগতভাবে বেড়েছেই। মেলায় মানুষের ভিড়ে যানজট হয়েছে আশপাশের রাস্তায়ও। মেলার পূর্বপার্শে মিরপুর-ফার্মগেট সড়ক এবং পশ্চিমে গাবতলি-আড়ং সড়কটিতে প্রচুর যানজট সৃষ্টি হয়। প্রধান সড়ক থেকে মানুষ হেঁটে মেলায় আসেন। এছাড়াও গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে মেলার সামনে আরও বড় জটলা তৈরি হয়। মেলার আসার সময় হেঁটে আসা গেলেও মেলা ফেরত মানুষের কষ্ট ছিল আরও বেশি। প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে গাড়ি না পেয়ে পণ্যসহ হাঁটতে হয়েছে দর্শনার্থীদের। মেলায় ৬০টি উন্মুক্ত বেঞ্চ থাকলেও বসে বিশ্রাম নিতে পারেনি অনেক দর্শনার্থীরাই। কোন দর্শনার্থী একবার একটু বিশ্রাম নিতে বসলে সহজে জায়গা থেকে উঠেনি ফলে অন্যদেরও সুযোগ খুব একটা মেলেনি। ছুটির দিনে কোন নির্দিষ্ট পণ্য নয় বরং সব স্টল প্যাভিলিয়নেই ছিল মানুষের উপস্থিতি। ঘুরে দেখার চেয়ে কেনাকাটাই বেশি হয়েছে এদিন। কারও হাত যেন খালি নেই। কোন কোন পণ্য নিয়ে হাঁটছেন মেলায়। ক্রোকারিজ, প্লাস্টিক, আইসক্রিম, বিস্কুট, হোম এ্যাপ্লায়েন্স ও ফার্নিচারসহ সব ধরনের প্যাভিলিয়েনে ক্রেতাদের ভিড়ে ঢোকা ছিল মুশকিল। শেষ সময়ের কেনাকাটায় নানা ছাড়ের পণ্যগুলোতেও আকৃষ্ট হয় ক্রেতারা। তরুণরা নানা ডিজাইনের ব্লেজারের স্টলে ছুটেছেন। কৌসিক মাহমুদ জানান, ব্লেজারের দাম কম তাই একজোড়া কিনেছি। আমার বন্ধুরা কিনেছে। এতদিন এক হাজার ৬০০ থেকে আড়াই হাজার টাকায় ব্লেজার বিক্রি করলেও এদিন প্রায় অধিকাংশ স্টলেই ১০০০ থেকে ১৪০০ টাকায় ব্লেজার বিক্রি করতে দেখা গেছে। মেলায় নারী ও তরুণীদের উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। নারীদের ভিড়ে অনেক স্টলে পুরুষ ক্রেতারা প্রবেশই করতে পারেনি। নারী ও তরুণীদের কেনাকাটাও যেন একটু বেশি। শাড়ি থেকে থ্রিপিস। গয়না থেকে সাজসজ্জার স্টল সর্বত্রই ছুটেছেন তরুণীরা। গহনা, শাল ও চাদর, প্রসাধনসামগ্রীর স্টলগুলোতে উপচে পড়া ভিড় ছিল তরুণীতের। এছাড়াও ঘরে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে নারীরা প্লাস্টিক ও গৃহস্থালি স্টলেও ভিড় করেছেন। এসব স্টল এক মুহূর্তের জন্য ফাঁকা দেখা যায়নি। সুহানা জামান বলেন, মেলায় আর হয় তো আসতে পারব না। তাই যা প্রয়োজন কিনে নিলাম। একই জায়গায় এত প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাচ্ছে সুযোগ হাত ছাড়া করলাম না। শখের জুয়েলারি কিনেছেন সাবরিনা আক্তার। মেলায় একটু ব্যতিক্রম কালেকশন থাকে জানালেন এই শিক্ষার্থী। মেলায় বিদেশী প্যাভিলিয়নগুলোতেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। বিশেষ করে বিদেশী মসলা কিনেছেন সবাই। ইরানী ঝিরা ও অন্যান্য মসলা কিনে সাজ্জাত আলম বলেন, সব সময় তো দেশী মসলা খাই। এবার একটু ভিন্ন স্বাদ পেতে কিনলাম। এছাড়াও ইলেক্ট্রনিকস পণ্যের স্টলগুলোতেও শেষ সময়ে ছাড়ের সুযোগে পছন্দের পণ্য কিনতে ছিল ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে। দেশী-বিদেশী এসব স্টল থেকে ওভেন, টিভি, ফ্রিজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটার ধুম পড়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের ১৭ দেশের ৪৩ প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে এই মেলায়। এছাড়াও দেশের প্রতিষ্ঠানতো আছেই। মেলায় অন্য পণ্যের সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে কয়েদিদের কারুপণ্য। এবারই প্রথম কয়েদিদের হাতে উৎপাদিত পণ্য নিয়ে বাণিজ্য মেলায় হাজির হয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। পুঁথি, তাঁত, পাট, বাঁশ, কাঠ ও প্লস্টিকের তৈরি ৩৮ ধরনের কারুপণ্য পাওয়া যাচ্ছে এবারের মেলায়। এসব পণ্যে ক্রেতা আকর্ষণও বেশ। পণ্য কেনাকাটার পাশাপাশি খাবারের স্টলগুলোতেও ছিল ভিড়। খাওয়ার জন্য আর বিশ্রামের জন্য ক্লান্ত দর্শনার্থীরা হুরমুড় করে প্রবেশ করেছেন খাবারের স্টলে। এ বছর দাম নিয়ে খুব একটা অভিযোগ আসেনি। মেলায় টাঙানো মূল্য তালিকা অনুযায়ীই দাম রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন একাধিক খাবারের স্টলের মালিকরা। সন্ধ্যার পর মেলায় বিভিন্ন স্টল প্যাভিলিয়নের রঙিন আলোয় সেলফি উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পরেন দর্শনার্থীরা। এছাড়াও অতিরিক্ত দর্শনার্থীদের ভিড়ে একটু পর পরই বিভিন্ন বাচ্চা হারানোর খবর জানিয়ে দিচ্ছিল মেলা প্রচার কেন্দ্র থেকে। একই সঙ্গে নিজ নিজ বাচ্চাকে সাবধানে রাখতেও বলা হচ্ছিল। কেউ হারিয়ে গেলে বা কোন দ্রব্য হারিয়ে গেলে তা প্রচার কেন্দ্রে দিয়ে আসলেই সেখান থেকে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয়া হচ্ছিল। একাধিক টিকেটের বুথ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে এই ছুটির দিনেও লাখের উপর দর্শনার্থী এসেছে মেলায়। ছুটির দিনে ছোট স্টলগুলোর মতো বড় বড় প্যাভিলিয়নের ছিল মানুষের ধাক্কাধাক্কির ভিড়। প্যাভিলিয়নে নানা অফারে মুগ্ধ ক্রেতারা। বিভিন্ন ফার্নিচার, ইলেক্ট্রনিক পণ্য নিতে দেখা গেছে ক্রেতাদের। এছাড়াও মেলার শেষবেলায় বিক্রি বাড়াতে ছাড়, নানা অফার দিচ্ছেন ক্রেতারাও। ক্রেতারাও লুফে নিচ্ছেন। বিভিন্ন সবজি কাটার যত্রাংশ বেচাকেনা ও দেখার দৃশ্য ছিল মনোরম। সৌখিন ক্রেতারা ছুটেছেন পাটজাত পণ্য কিনতে। এছাড়াও বাসার বিভিন্ন দরজা জানালার পর্দা কার্পেট কিনতেও দেখা গেছে। ১০০ সিসিটিভির মাধ্যমে পুরো মেলা তদারকি করা হয়। মেলায় পুলিশের সঙ্গে আনসার, র‌্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ানও নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও দর্শণার্থীদের কোন অভিযোগের তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেটও দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিদিন সকাল ১০ থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
×