ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে ব্যবসায়ীকে হত্যা

এবার নারীর ওপর দিয়েই প্রাইভেট চালাল ছিনতাইকারী

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

এবার নারীর ওপর দিয়েই প্রাইভেট চালাল ছিনতাইকারী

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে ছিনতাইকারীরা। তাদের হাতে একের পর এক প্রাণ হারাচ্ছে নারী, শিশুসহ নানা শ্রেণীর পেশার মানুষ। হত্যাকান্ডসহ নানা ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে তারা। শুক্রবার ছিনতাইকারীরা এক নারী ও এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করেছে। নারীর ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার সময় হেঁচকা টানে ওই নারী পড়ে গেলে তার মাথার ওপর দিয়েই ছিনতাইকারীরা প্রাইভেটকার নিয়ে পালিয়ে যায়। মুহূর্তেই ওই নারীর মাথা থেতলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। দিনদুপুরে এমন ঘটনা রীতিমত আবারও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। একই দিন ছিনতাইকারীরা টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় সকালে এক ব্যবসায়ীকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে দিনদুপুরে মানুষের সামনেই হত্যা করে। হত্যার পর ফিল্মিস্টাইলে পালিয়ে যায়। এর আগে মায়ের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার সময় কোল থেকে পড়ে এক শিশু মৃত্যুর ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ওই ছিনতাইকারী গ্রেফতার হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে ছিনতাইকারীর উৎপাত বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ মাদক। ইয়াবার মত মাদকের ব্যাপক বিস্তার ঘটার ফলে রাজধানীতে এ ধরনের অপরাধ বেড়েছে। শুক্রবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি থানাধীন ৭ নম্বর সড়কে অবস্থিত বেক্সিমকো ও ঢাকা ব্যাংকের মোড়ে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে এক নারীর লোমহর্ষক মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে। ধানমন্ডি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোঃ পারভেজ ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে গ্রামের বাড়ি বরিশালে গিয়েছিলেন হেলেনা বেগম (৩৫)। গ্রামের বাড়ি বরিশালে ছুটি কাটিয়ে শুক্রবার ভোরে স্বামী মনিরুল ইসলামের (৪৫) সঙ্গে লঞ্চে করে ঢাকায় ফেরেন হেলেনা বেগম (৩৮)। সদরঘাট থেকে বাসযোগে ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডের কাছে নামেন। একদিকে শুক্রবার সরকারী ছুটি, আরেকদিকে ভোর হওয়ার কারণে তখন রাস্তা ছিল একেবারেই ফাঁকা। তারা নেমে যথারীতি রাস্তা পার হচ্ছিলেন। তারা গ্রীন স্কয়ারের ভাড়া বাসায় যাচ্ছিলেন। রাস্তা পার হওয়ার সময় তাদের কাছ দিয়ে দ্রুতগতিতে একটি প্রাইভেটকার যাচ্ছিল। গাড়িটি তাদের কাছাকাছি এসে আচমকা হেলেনার হাতে থাকা ট্রাভেল ব্যাগ ধরে জোরে টান দেয়। ব্যাগটি নিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। আচমকা টানে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে হেলেনা প্রাইভেটকারের পাশেই পড়ে যান। ছিনতাইকারীরা তার ওপর দিয়েই প্রাইভেটকার চালিয়ে দেয়। গাড়ির পেছনের চাকা হেলেনার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। মুহূর্তেই বিকট শব্দে মাথার খুলি ফেটে থেতলে যায়। পিচঢালা কালো রাস্তা সঙ্গে সঙ্গে রক্তে লাল হয়ে যায়। হেলেনার চিৎকারে আশপাশে থাকা মানুষজন সেখানে জড়ো হয়। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হেলেনা। এমন লোমহর্ষক ঘটনা দেখে আশপাশের মানুষ গাড়িটির পিছু নেয়। ততক্ষণে সাদা রংয়ের প্রাইভেটকারটি মিরপুরের রাস্তার দিকে পালিয়ে যায়। ব্যাগে কাপড় চোপড়ের সঙ্গে তাদের দুইটি জাতীয় পরিচয়পত্র ও একটি মোবাইল ফোন ছিল। ধানমন্ডি মডেল থানার ওসি মোঃ আব্দুল লতিফ জনকণ্ঠকে জানান, নিহতের বাড়ি বরিশাল জেলা সদরের বন্দর থানাধীন কড়াপুর গ্রামে। কলাবাগানের গ্রীন রোডের ১৬৮/২ নম্বর বাসায় তারা পরিবার নিয়ে ভাড়ায় থাকতেন। হেলেনা গ্রীন লাইফ হাসপাতালের আয়া হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার স্বামী মনিরুল ইসলাম একটি বেসরকারী কোম্পানীর লিফটম্যান হিসেবে চাকরি করেন। তাদের এক মেয়ে রয়েছে। মেয়েটি গ্রীন লাইফ হাসপাতালের আয়া। এছাড়া তাদের দুই ছেলে রয়েছে। তারা ছাত্র। পোস্টমর্টেম শেষে লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গ থেকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে অজ্ঞাত ছিনতাইকারীদের আসামী করে মামলা হয়েছে। হত্যাকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। একই দিন শুক্রবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে যাত্রাবাড়ী থানাধীন স্বামীবাগে সায়েদাবাদ রেললাইনের পাশের গলিতে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে ইব্রাহিম (৩৬) নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। নিহতের বাড়ি খুলনার সোনাডাঙ্গা থানাধীন শেখপাড়ায়। পিতার নাম বজলুর রহমান। নিহত ইব্রাহিম ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী ছিলেন। ওয়ারী থানার ওসি মোঃ রফিকুল ইসলাম নিহত ইব্রাহিমের বোন জামাই ও সালাহউদ্দিন মেডিকেল কলেজের লোকজন এবং চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ইব্রাহিম ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী। তিনি চট্টগ্রাম থাকেন। ঢাকায় এসেছিলেন জাহাজের টুকটাক মালামাল কিনতে। ইব্রাহিম চট্টগ্রাম থেকে সায়দাবাদে বাস টার্মিনালে নামেন। এরপর সেখান থেকে রেললাইনের পাশের গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাত করলে রক্তাক্ত অবস্থায় নিজেই দৌড়ে পার্শ্ববর্তী সালাউদ্দিন হাসপাতালে যান। হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে ভোর ৬টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে ছিনতাইকারী বা অন্য কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ঠিক কোন জায়গায় ইব্রাহিমকে ছুরিকাঘাত করেছে, সে সর্ম্পকে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে ইব্রাহিমের বোনজামাই মামলা দায়ের করছেন। ইব্রাহিমের পকেট থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকাও উদ্ধার হয়েছে। এতে করে ইব্রাহিমের মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। ছিনতাইকারীদের হাতে ইব্রাহিমের মৃত্যু হলে, স্বাভাবিকভাবেই ছিনতাইকারীদের টাকা নিয়ে নেয়ার কথা। আবার মানুষজন জড়ো হওয়ায় টাকা ফেলেও ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যেতে পারে। আবারও এমনও হতে পারে, এক পকেটের টাকা নিয়েছে, অন্য পকেটে থাকা টাকা হাতিয়ে নেয়ার আর সময় পায়নি। ঘটনার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে। এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চলছে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করতে। লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রাখা হয়েছে। এর আগে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ভোর সোয়া ছয়টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন দয়াগঞ্জ রেলসেতুর মাত্র একশ’ গজ পূর্ব দিকে ছিনতাইকারী এক মায়ের ব্যাগ জোরে টান দিয়ে ছিনিয়ে নিলে মায়ের কোল থেকে পড়ে পাঁচ মাস বয়সী আরাফাত নামের এক শিশু পড়ে গিয়ে মারা যায়। ঘটনার সময় আরাফাত, তার ভাই আল আমিনকে সঙ্গে নিয়ে পিতা শাহ আলম গাজী ও মা আকলিমা বেগম রিক্সায় করে যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়ায় বোনের বাসায় যাচ্ছিলেন। এ ঘটনার পর যাত্রাবাড়ী থানার এএসআই বদরুল হোসেনকে প্রত্যাহার করে পুলিশের ওয়ারী বিভাগ। বদরুল সেখানে শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়েছে, সেখানে থাকা একটি পুলিশ চেকপোস্টের দায়িত্বে ছিলেন। দায়িত্বে অবহেলার জন্য তাকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে ওই ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। এছাড়া চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে থেকে ডিবি পরিচয়ে দিনদুপুরে ৪০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ছিনতাইকৃত টাকার মধ্যে ছয় লাখ টাকাসহ ৩ ছিনতাইকারী গ্রেফতার হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশ বলছে, এ ধরনের মূল কারণ মাদক। আর মাদকের সঙ্গে জড়িতরা নেশার টাকা জোগাড় করতে ছিনতাই, ডাকাতি, চুরিসহ নানা ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ দূর করা কঠিন বলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন। মাদক ব্যবসায়ীদের বিশাল সিন্ডিকেটের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। এজন্য মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেফতার হলেও আবার তারা জামিনে ছাড়া পেয়ে মাদক ব্যবসা করছে। এমনকি মাদক ব্যবসার জেরে খুনের ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি টঙ্গীতে মাদক ব্যবসার জেরে দুই ভাইকে একই দিনে একই জায়গায় হত্যার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে র‌্যাব।
×