ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় কথাশিল্পী শওকত আলী

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

বিদায় কথাশিল্পী শওকত আলী

বিশিষ্ট কথাশিল্পী শওকত আলীর লেখনী থেমে গেল। বৃহস্পতিবার সকালে তিনি ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। বিগত কয়েক বছর শারীরিকভাবে তিনি ভাল ছিলেন না। তাই তাঁর সৃষ্টিও অনেকটা থেমে গিয়েছিল। তবু কখনও কখনও তার সাক্ষাতকার সাহিত্য পাতায় পাওয়া যেত আর তাতে অবধারিতভাবে থাকত নতুন প্রজন্মের লেখকদের জন্যে এক পরোক্ষ অনুপ্রেরণা। বছরে এক আধবার সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগ দিতেন কষ্ট করে হলেও। এতে সমগ্র অনুষ্ঠান পেত উজ্জ্বল মাত্রা। সব বয়সের সাহিত্যিকরা তাঁকে ঘিরে ধরতেন। আমাদের সাহিত্য সমাজে অনেকটা বটবৃক্ষের মতোই তিনি বিরাজ করছিলেন, যার ছায়ায় স্বস্তি, শান্তি আর মমতা পেতেন নবীন লেখকরা। মানুষ যখন নশ্বর তখন তাঁর শারীরিক প্রয়াণ আমরা কিছুতেই এড়াতে পারি না; ব্যক্তি যত পরমনির্ভর সদাকাক্সিক্ষত স্বজন হোন না কেন, তাঁকে বিদায় জানাতেই হয়। আজ যাঁকে চোখের জলে বিদায় জানাতে বাধ্য হচ্ছে বাঙালী সাহিত্যপাঠক তাঁকে যে এসব শোকার্ত মানুষ তাঁদের হৃদয়ে আসন দিয়ে রেখেছেনÑ এই সত্যটি শোকের ভেতর সামান্য সান্ত¡না হয়ে উঠছে মাত্র। শওকত আলী তো কেবল একজন কালজয়ী কথাসাহিত্যিকই ছিলেন না, ছিলেন উদার শিক্ষক, সমাজের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের কথাকার, সহমর্মী বান্ধব; সেই কথাটি আজ পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছেন সচেতন মানুষ। এমন একজন বড় মাপের সাহিত্যিকের প্রস্থান তাই সত্যিকারার্থে এক অপূরণীয় ক্ষতি; এই ক্ষতি বড় বেদনার মতো বেজে চলেছে মানবপ্রেমী মানুষের মনে। শওকত আলী ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর দিনাজপুর জেলার থানা শহর রায়গঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, ‘অপেক্ষা’, ‘ওয়ারিশ’, ‘গন্তব্যে অতঃপর’, ‘উত্তরের খেপ’, ‘জননী’, ‘পিঙ্গল আকাশ’ অন্যতম। বরেণ্য এই লেখক বাংলা একাডেমি পুরস্কার, হুমায়ূন কবির স্মৃতি পুরস্কার, অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। বাংলাদেশের শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে শওকত আলী যেখানে বিশিষ্টতা অর্জন করেছিলেন, তা হলো প্রচলিত গড্ডলিকা প্রবাহে কখনই তিনি গা ভাসাননি। লেখালেখির নিজস্ব একটি ভুবন গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে সর্বদাই স্থান পেয়েছে নি¤œবিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাধারণ মানুষ, সাঁওতাল সম্প্রদায়, দেশবিভাগের অনিবার্য পরিণতিতে উদ্বাস্তু উন্মূল ভাগ্যপীড়িতজন; সর্বোপরি প্রতিনিয়ত জীবন-জীবিকার জন্য সংগ্রামরত নরনারী ও স্বজন। সাধারণের জীবন সর্বদাই সাধারণের ভাষায় তুলে এনেছেন তিনি, তাতে কখনই কল্পনার রং ও ফানুস ওড়াতে চেষ্টা করেননি। ফলে তার গল্প-উপন্যাস সর্বদাই হয়ে উঠেছে আমাদেরই দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রতিলিপি, প্রতিচ্ছবি। প্রদোষে প্রাকৃতজন, দলিল, ইত্যাদি উপন্যাসে তিমির ইতিহাস ও সমাজের বাঁকবদল, বিবর্তন ও পরিবর্তনকে তুলে এনেছেন নিজের মতো করে, নিজের মনন ও ওজস্বীতায়। কোন সন্দেহ নেই যে শওকত আলীর গল্প-উপন্যাস সচেতন পাঠকমাত্রকেই ভাবায়, নানা জিজ্ঞাসা ও প্রশ্নের মুখোমুখি করে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রবল আশাবাদ ও ইতিবাচক জীবনের দিকে আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। কথাসাহিত্যের প্রচলিত ধারাকে প্রায় উপেক্ষা করে তিনি তৈরি করেছিলেন একটি স্বতন্ত্র ও অনন্যসাধারণ পাঠকসমাজ, যারা সতত তাঁকে স্মরণ করবে একজন ব্যতিক্রমী লেখক হিসেবে। আর এখানেই তাঁর অনন্যতা ও উচ্চতা। এই মহান লেখকের প্রতি জানাই আমাদের গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।
×