ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মতিন বৈরাগী

কামাল চৌধুরীর কবিতা ॥ ভ্রমণের আরেক আনন্দ

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

কামাল চৌধুরীর কবিতা ॥ ভ্রমণের আরেক আনন্দ

‘পথ হাঁটল, পথ বেঁকে গেল কেউ বলল, এটাই নিয়ম সারারাত ভাবল প্রেমিক ভালবাসা ছিল কিছু কম? ঝড় উঠল, ফের থেমে গেল রাত্রি এল খুব স্বাভাবিক একা যে নদীর তীরে বসে তার জন্য জাগাই সঠিক। রাত জাগা সামান্য আকাশ হেসে উঠল নিয়মের ফাঁকে সারারাত উজান পদ্মায় দেখি জল, জল বাড়তে থাকে।’ [ নিয়ম ] মাত্র ১২ পঙ্ক্তি মোট শব্দ সংখ্যা ১২০ নিশ^াস উঠবার পড়বার আগে ‘জল বাড়তে থাকে’ এসে থেমে গেলে তারপরও এক ভ্রমণ, কি পড়ছিলাম! কি বলতে চেয়েছেন কবি? সময়ের ক্যানভাসে যে আঁচড় সে কি ছিল কোন ইঙ্গিত? কোন শব্দযোজনা এক ভাবনার? রয়েছে কি একটি দলিল সুদীর্ঘ সময়ের যার পাঠ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে যা গৌণ নয়, যার পটভূমি এক বাস্তবতা অবাস্তব নয়। প্রকাশ আছে আবার নেই যা বলা হয়েছে অথচ কিছুই বলা হয়নি; এমন এক সংশয় নিয়ে এক ভ্রমণের মধ্যদিয়ে যাওয়া। পথে কুড়িয়ে পাওয়া নানা শব্দ উত্থিত ইঙ্গিত কিংবা হঠাৎ একঝলক চিকন আলোক রেখা অনুমেয় ভাবনায় যার বিস্তার কখনও এক রৈখিক কখনও নানা উৎসমুখে... এক চলমান ভ্রমণ। হাঁটা এবং এগিয়ে যাওয়া জীবন সম্পর্কের নিত্য নিয়ত দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া অগ্র এবং পশ্চাতের, সভ্যতার অগ্রযাত্রার একরূপ উত্তোরণ এবং পশ্চাদাপসারণ। জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র বিশ^াস এসবের নিয়ত ভাঙন নিয়মে নতুন করে গড়ে ওঠার ইতিহাসে সহজ গতিময় আবার শ্লথ। গতিহীন আস্থা ও অনাস্থার এক লড়াই। কিন্তু নিত্য সময়ে মানুষের কর্ম ভ্রমণে যেমন প্রেরণা রয়েছে, রয়েছে হতাশাও আর ‘রাত্রি এল খুব স্বাভাবিক’ এই ভঙ্গি বলে দেয় ‘উৎক্রমণের ছেদ’ আর সেখানে প্রতীক্ষা ‘নদী তীরে বসে’ এই নদী জীবন কালের প্রবহমান গতির প্রতীক, হতে পারে খুব সহজ একটা প্রত্যাশা প্রাপ্তির; যার জন্য এই ভূখ-ের মানুষের দীর্ঘ সময়ের প্রতীক্ষা। যে অপেক্ষা করে সে এবং তাঁর ও তাদের প্রতীক্ষা তো স্বাভাবিকই ‘জাগাই সঠিক’। আর এই নিয়মের ফাঁকে ‘সারারাত উজান পদ্মায় দেখি জল’ তারপর ‘জল বাড়তে থাকে’ দিয়ে ছেদ। যদি বিস্ময় হতো যদি প্রশ্ন হতো কিংবা যদি... ড্যাস হতো, তাহলে এই সরল কবিতাটি ভ্রমণে এক অডিসিউস দিকহারা যাত্রার ইঙ্গিতকেই স্পষ্ট করত। কিন্তু না কবি ছেদ চিহ্নদ্বারা একটা পরিসমাপ্তির দিক টানলেও কবিতাটির মধ্যের পঙ্ক্তি বাঁধন এবং ব্যঞ্জনার উদ্ভাসগুলোর গতিমুখে কিছু প্রশ্ন কিছু কাক্সক্ষাচিত্র কিছু স্থবির অচল সমঝোতার ছায়াপাত আমরা দেখতে পাই, যাকে শেষ পর্ব ছুঁয়ে যাবার আগপর্যন্ত একটা নিশ্চিতির মধ্যে আনা যায় না। কবিতাটিতে কি বলা হয়েছে? সাদামাটাভাবে যেন এক বন্ধন শব্দের, ভাবের এবং সহজ বিকাশের উৎকর্ষতায় পৌঁছবার কিন্তু টোটাল অবয়ব, ভ্রমণে তা আর থাকে না। একটা সংবাদ একটা মেসেজ সে দিচ্ছে, জানাতে চাচ্ছে অপেক্ষা, সমঝোতা, রীতি ছেদহীনতা, ভালবাসার অনুরাগ, এর নানা প্রশ্ন এবং দার্ঢ্যতা কিংবা কর্তব্য প্রেমিকের, প্রত্যাশা কারীর, প্রাপকের ‘একা যে নদীর তীরে বসে/তার জন্য জাগাই স্বাভাবিক’, এই প্রক্রিয়ায় কোন উসকানি নেই কোন অন্তর্ঘাত নেই, কোন কাপুরুষতা নেই, আছে ধৈর্য এবং প্রতিজ্ঞার এক লাগাতার সচেষ্ট মানসিকতা। তাই ছোট কবিতাটি সামান্য একটা ক্ষীণ দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও এর সুন্দরের শুদ্ধি নন্দন পাঠ কাব্যপিপাসুর চেতনায় এক বোধ তৈরি করে যাতে সম্পর্কের ভাঙাগড়া, স্থিরতা ও ভাঙনরোধী এক ক্রিয়াÑবিচক্ষণতার। রয়েছে আজকের সময়ের বহমানতায় সমাধান কল্পের এক সাধনা, ধৈর্যের ইশারার। কবিতা নানা রকমের। কবির মানসিকতায় যে উদ্দীপনা আপত দৃষ্টিতে স্থূল হলেও কবির প্রজ্ঞায় তা জারিত হয় এবং ইমেজটুকুর সদ্ব্যবহার টায় টায় নয় বুদ্ধির আলোকে প্রতিফলিত করতে পারলে কবিতা হয়ে ওঠে কল্যাণকামী। ‘নিয়ম’ কবিতায় শুরুর টেকস্ট থেকে সাব টেকস্টগুলোতে এ বন্ধন রয়েছে যা বিচ্ছিন্ন নয় পরিকল্পিত এবং নির্মাণ সে কারণে হয়ে উঠেছে নান্দনিক। কবিতা নিয়ে কত তত্ত্ব রয়েছে। কবিতা মূলত প্রত্যেক কবির অভিজ্ঞতা, বিশ^াস-অবিশ^াস থেকে উৎসারিত এক ঝরনা যার বিস্তৃতির বিস্তার আমরা পেয়ে যাই কবির প্রকাশে। কবি আসলে কিছুই লুকাতে পারেন না, তিনি থেকে যান তার প্রকাশেÑপ্রকাশ সর্বদাই চৈতন্যলগ্ন আর চেতনা নিয়ন্ত্রিত হয় সামাজিক অবস্থান দ্বারাÑব্যক্তি চেতনাকে অস্বীকার না করেও। সামাজিক চৈতন্যের মধ্যে ন্যায় বিচারের বোধ, নীতিজ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্ম ও দর্শন সকলই অন্তর্ভুক্ত। এর রূপগত ভিন্নতা থাকলেও পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বমূলক ঐক্য রয়েছে। শিল্প সাহিত্য কেবল ভাবমূলক নয় এর মধ্যের উপাদান উপ্ত বা সুপ্ত তা জীবনকে জানতে বুঝতে উপলব্ধি করতে ইন্ধন জোগায়। এ কারণে শিল্প সাহিত্য পাঠ থেকে সে কাল থেকে একালে দাঁড়িয়ে আমরা যে তথ্যগুলো পাই তা এত বাস্তব এত অর্থপূর্ণ এত স্পষ্ট যে ইতিহাস অর্থনীতি কোনটাই এত সুন্দরভাবে আমাদের বুঝতে সাহায্য করে না। এ রকম মন্তব্য মার্কসের। ফুটপাথ কবিতাটি এ রকম ‘ একটা ফুটপাথ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ফুটপাথ সিগারেট ফুকছে নির্জন গাছের নিচে রাত বারোটায় বোহেমিয়ান বাতাসে ধুলি উড়তে দেখলাম ফুটপাথ বদল হতে দেখলাম মেয়ে মানুষের হাত ধরে রিকশায় হুড তুলে একটা ফুটপাথ কোথায় যে হারিয়ে গেল শুধু চাঁদ জানে...’ কবিতাটি পড়তে পড়তে একবার জীবনানন্দের কথা মনে পড়ে আরেকবার শক্তির। জীবনানন্দ উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শক্তি। জীবনান্দের কবিতার বিনির্মাণ ছিল শক্তিতে আর শক্তির কবিতার বিনির্মাণ কামাল চৌধুরীর কবিতা। তাতে কিন্তু কবিতাটির সৌন্দর্য উল্লেখিত দুই কবির কবিতার মধ্যে মিশে যায় নি। বরং নতুন এক ব্যঞ্জনা নিয়ে কবিতাটি দাঁড়িয়ে গেছে অগ্রজদের দুই কবিতার সার কবির নিজের মতো আত্মীকরণের মধ্যে। দৃশ্যমান হয়েছে একটা ফুটপাথ। ‘একটা ফুটপাথ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে’ আর একটা ফুটপাথ সিগারেট ফুকছে নির্জন গাছের নিচে বিষয়ের উপস্থাপনা এক অদ্ভুত দ্যোতনাময়, চমৎকার আরেক ধরা ও অধরা দৃশ্যের মগ্নতা। নির্জনতার এক ভ্রমণে এ রকম অন্তর চেতনায় একটা দৃশ্য অন্য একটা দৃশ্যে রূপান্তরিত হয়ে নতুন আরেক দৃশ্যে ব্যক্তির মনজগতকে আলোড়িত করে। নানা ভাবনার মধ্যদিয়ে হঠাৎ নতুন একক ভাবনার উপস্থিতি সকল ভাবনায় জটপাকিয়ে বিভ্রমের প্রান্তে উপস্থিত করতে পারে উদ্দীপনার নতুন আলোক। ব্যক্তির চেতনা জগতে অবচেতনের বিষয়গুলো দৃশ্যমান হয়ে যেতে পারে। ‘একটা ফুটপাথ সিগারেট ফুঁকছে নির্জন গাছের নিচে’ আর তখন এই দৃশ্যের দৃশ্যমানতার একটা লজিক তৈরি হয় ব্যক্তিতে যা ভাঙা আর যখন ‘রাত বারোটার বোহেমিয়ান বাতাসে ধূলি উড়াতে দেখলাম’ দৃশ্য বাস্তবতার যে মানসিক প্রস্তুতি কবির মনে তাকে নিশ্চিত করল ধুলির ওড়াউড়ি এবং পরবর্তিতে ‘মেয়ে মানুষের হাত ধরে রিকশার হুড তুলে’ চলে যাবার দৃশ্য কবিকে, দ্রষ্টাকে এক ঝলকে একটা যুক্তির মধ্যে এনে দিলেও সমাধান দেয় না যে সে কোথায় গেল, কেবল এক অনুমানের মধ্যের বিভাষটুকু একটা ভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একটা অবলম্বন খুঁজবার জন্য এবং তখন তার একটা নিষ্কৃতি মেলে একজন সাক্ষ্যদানকারীর আবির্ভাবে সে গাছ, নদী, পাহাড়, বনহরিণী, চিতা, ঘরের দেয়াল. এসবই স্বপ্নের প্রতীক তার উপস্থিতির এবং সে চাঁদ হয়ে জানবার একটা সাক্ষী কবি মনে তার বিবৃতির তার ভাষ্যের। কবিতাটিতে অন্তরজগত এবং বহির্জগতের রূপ পরিবর্তন নতুন রূপের রূপদান লজিকগুলোর সংকোচন নতুন এক দ্যোতনা নিয়ে পাঠককে মুগ্ধ করে। কবিতা সরাসরিও হতে পারে, আড়াল-আবডালের মধ্যেরও হতে পারে, সেটা নির্ভর করে কবির মনস্তাত্ত্বিক গঠনের ওপর। তবে আমাদের দীর্ঘ সময়ের কবিতার মেজাজ তার যে আঙ্গিক আমাদের পাঠে রয়েছে সেটা খানিকটা পাঠক মনকে সীমাবদ্ধতার মধ্যে সীমিতই রেখেছে । আজকের সময়টা আর সে কালের নয়, সংস্কৃতি আর একক কোন আদিপ্রবণতায় নেই তার এখন এক যৌথ শরীর গড়ে উঠছে। বিশ^পুঁজি গ্রাস করছে সব কিছু এবং মিশ্র সংস্কৃতির বুলি আজকের উচ্চারিত হলেও তার লক্ষ্য একক আধিপত্যবাদী বিকাশের দিকে যেখানে পুঁজির নিয়ন্ত্রকরা রাষ্ট্র সমাজ মানুষকে এক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছে। আর এর লড়াইটা জনগণকে লড়তে হবে সে জন্য কবির কাজ রয়েছে কেবল আনন্দ নয়, কেবল শিল্পের জন্য শিল্প নয়, কেবল বিমূর্ততার ভেতরে ডুবে যাওয়া নয়, বরং একটা নির্ধারিত লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্মাণ। মানুষের আনন্দ এবং উপলব্ধির জগতে তার হৃদয়বৃত্তির সুস্থ চালনার মধ্যদিয়ে নবতর নির্মাণে। সেখানে ঐতিহ্য যেমন থাকবে এবং থাকবে টায় টায় নয়, নবায়িত রপের যাতে একটা ভারসাম্য রক্ষিত হয়। কারণ মানুষ প্রাগকাল থেকে অগ্রমুখী এবং চক্রান্ত বিরোধি। কিন্তু সব কিছুর পরও এই কথাটি বেদ সত্যের ন্যায় যে শিল্পকে শিল্প হতেই হবে, তার স্বার্থে কোনভাবে অন্যের স্বার্থের নয়। কারণ বৃহৎই হলো নগণ্যের নির্ভরতা বৃহতের স্বার্থ রক্ষিত হলে নগণ্যের সংরক্ষণ আর সজাগ চেতন সূত্রই পারে নতুন নির্মাণকে স্বাগত জানাতে। ‘তোমার চোখের দিকে তাকাতে পরি না। ভয়! মনে হয়, দীর্ঘ এক রাতজাগা ট্রেন দোয়েলের শিস বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছে দারুচিনি দ্বীপে মাঝখানে ক্যাসেন্ড্রা ক্রসিং, আমাদের পুলসেরাত, নড়বড়েসাঁকো মনে হয় ভেঙে যাবে তাকালেই ধসে যাবে কাঠামো সমেত নিচে অগ্নি নিচে জল নিচে স্বর্গ নিচেই নরক।’ [দৃষ্টি] এই যে তোমার এই যে তুমি সে কেবল জৈবিক আমি/তুমি নয় সে কেবল দয়িক দয়িতা নয় সে হতে পারে অসম্পূর্ণ এক মাত্রা হতে পারে পরিমাপহীন এক প্রতিচ্ছায়া হতে পারে অপার লগ্নতাছিন্ন এক ভাবনা শরীর যা কবি মননে রীতিকে, নিষ্ঠাকে, নির্বাণকে দ্যোতিত করে যার অবয়ব গঠন করে ভাবনায় এক সারসত্তা নিয়ে যেখানে স্থিতি আছে, বিশ্রাম আছে, নির্ভরতা আছে তার দিকে তার চোখের দিকে সেই কল্পিত চোখ যার রং নেই আয়তন ও দৈর্ঘ্য নেই বিস্তার ও বিস্তৃতি নেই কিন্তু অস্তিত্বমান এক আমি সে তুমি হয়ে যাচ্ছে সে হয়ে যাচ্ছে আবারও আমির এক অহং বিস্তারিত হচ্ছে হৃদি ও হৃদয়ের ভাষা হয়ে, প্রাণিত করছে এক অনুভবের দিকে যেখানে অনেক সময় দেহকা- মানুষ তাকাতে পারে না, দিতে পারে না সেই তুমির জবাব অর্থাৎ বাস্তব কর্ম এবং বিবেক এই দুয়ের সংঘাত সর্বদাই অমীমাংসিত যদি দ্বৈতসত্তার সম্মিলনে সম্পাদিত নয়, তবে থেকেই যায় এক বৈরিতা নিজের মধ্যে। আর তার ভ্রমণ হয়ে ওঠে নানামুখী সকল সত্য নানা প্রতীকে বস্তুতে প্রকৃতির বিষয়াবলিতে অনুসন্ধান লিপ্ত হয়ে প্রশমন প্রার্থনা করে এক বহুমুখী সিদ্ধান্তের ভাংচুর সেখানেই স্থিত হয়ে নিশ্চিত করে সকল মনোকাঠামো যে ‘নিচে অগ্নি নিচে জল নিচে স্বর্গ নিচেই নরক’ এই অনুসন্ধান পূর্ণাঙ্গ নয় ভাঙা এর যুক্তিও ভাঙা তবু তার মাঝে এক স্থিতি রয়েছে এই কবিতাটিতে। কামাল চৌধুরী কবিতা প্রকৌশল ভিন্নতর বিশেষ করে পেলবতাযুক্ত নির্মাণ। কবি কামাল চৌধুরীর কাব্যকৃতি নিয়ে কবি ফরিদ আহমদ দুলাল তার প্রবন্ধে ‘মেধাবী কবির পোট্রট’ এই নামে একটা প্রবন্ধ সংকলিত করেছেন তাঁর ‘বাংলাদেশের কবি ও কবিতা’ নামক গ্রন্থে। যেখানে কবির কাব্যকৃতি নিয়ে সুন্দর একটি আলোচনা রয়েছে। কবি ফরিদ -এর এই আলোচনায় এ কথাটি বলতে চেয়েছেন যে সত্তরের কবিদের মধ্যের কবি কামাল চৌধুরী মেধার দিক থেকে অনেক বেশি উজ্জ্বল এবং নির্মাণদক্ষ। এই আলোচনায় কবির একটি কবিতাংশ-এর উদ্ধৃতি রয়েছে যা আমি খানিকটা উদ্ধৃত করছিÑ তোমার জন্মের কাছে সেই দিন নতজানু হবো যদি তুমি কথা দাও যদি তুমি কথা দাও মুগ্ধ কিষাণের কাছে মাটির মমতা হবো তোমার জন্মের কাছে সেই দিন নতমুখী হবো সেই দিন ঋণী হবো স্বভাবে শরীরে যদি তুমি কথা দাও, যদি তুমি কথা রাখো যদি তুমি শস্য হও, শিল্প হও যদি তুমি কথা বলো নৈঃশব্দ্যের প্রগাঢ় ভেতরে তোমার স্লোগানে যদি পৃথিবীতে রোদ আসে অন্ধকার আলো হয়, বৃষ্টি হয়, বৃষ্টি নামে দারুণ খরায় আমি নত হবো, আমি নতজানু হবো তোমার জন্মের নামে সেই দিন পতাকা ওড়াব। [মিছিলের সমান বয়সী] প্রথম কাব্য। প্রকাশ ১৯৮১ আমরা সময়টাকে ধরে এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়তে পারি। ১৯৭৫ সালে এক হৃদয় বিদারক ঘটনার মধ্যদিয়ে দেশে যে দুঃখজনক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং আর যারা প্রায় পরিণতির প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছিল সেই সময়ের কবিতা। এর মধ্যে সেই মাতৃভূমির কাছে প্রার্থনা তার মঙ্গল কামনা তার কাক্সিক্ষত অবস্থান কল্পনায় এবং সেখানে যে প্রমিজ থাকবার কথা তার বিবৃতি রয়েছে স্লোগানে নয় একেবারে কাব্যিক রসায়নে। বাড়তি নেই একেবারে পরিমিতির মধ্যে। ‘যদি তুমি শস্য হও, শিল্প হও’ এই প্রার্থনায়। আর তা স্লোগান হবে অবশ্যই হবে যদি তাতে রোদ মানে আলো মানে উত্তাপ মানে মুক্তি যার অনুষঙ্গ বৃষ্টি যে খরাকে দুর্ভোগকে, দুর্দশাকে ধুয়ে দেবে এমনই কাক্সক্ষা অন্ধকারের বিপরীত। একটা সময় ধরা আছে এই কবিতায় কবিতা হয়ে। আর এক গতিময় আবেগ অশে^র মতো দ্রুতগামীÑভাষ্যবন্ধে। এমনি নানা বুনন আছে কবি কামাল চৌধুরীর কবিতায়। রয়েছে এক মসৃণ নির্মাণ। সুন্দর যে বস্তু বা বিষয়ে বিরাজ করে, আলো বাতাস জল উত্তাপ, মৃত্তিকা এদের সৌন্দর্য সন্ধান পাওয়া যায় নিবিড় অবলোকনে। কবিতা বিষয় থেকে কেবল বিষয়কেই উপস্থাপন করে না করে যা আছে তা নয় যা একজন কবির মনে বিশেষ সংবেদন তৈরি করে; তারই প্রকাশ। নানা তত্ত্ব নিয়ে সৌন্দর্য শাস্ত্র সে সব আলোচনায় এই প্রবন্ধে যুক্ত না করে আমি আমার মুগ্ধতার কথাগুলোই বললাম। এবং এই সঙ্গে এও বলে রাখতে চাই যে কবি কামাল চৌধুরী সত্যিই একজন মেধাবী নির্মাণ দক্ষ কবি, যার শক্তিটুকু অন্য থেকে স্বতন্ত্রই।
×