ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

প্রভাবশালী ৫ শিল্প মতবাদ

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

প্রভাবশালী ৫ শিল্প মতবাদ

(পূর্ব প্রকাশের পর) এ আন্দোলনটি সুইজারল্যান্ডে শুরু হলেও পরবর্তীতে ফ্রান্স, আমেরিকা, জার্মানি, রোমানিয়া, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি মতবাদ নতুন আরেকটি মতবাদ উদ্ভবে সহযোগিতা করে। সময়ের আবর্তনে ডাডাইজমও পরবাস্তববাদসহ পরবর্তী শিল্প আন্দোলনগুলোতে মিশে গিয়েছিল। সে সময়ে ডাডা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী হুগো বল বলেছিলেন, ‘ডাডা শিল্পের একটি নতুন প্রবণতা। এখনো পর্যন্ত এটা সম্পর্কে কেউ জানে না। কিন্তু ভবিষ্যতের জুরিখে ডাডাইজম নিয়ে মানুষ আলোচনা করবে।’ ২০১৬ সালে বিশ^বাসী ডাডাবাদের শতবর্ষ উদ্যাপন করেছে। কেবলমাত্র জুরিখেই ডাডাবাদের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে দেড় শতাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই উদ্যাপনই প্রমাণ করে হুগো বলের ভবিষ্যৎবাণী বৃথা যায়নি; বরং একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শতবর্ষ পূর্বের এ আন্দোলন শিল্পরসিকদের দৃষ্টি ও মনোযোগ দাবি করছে। সুররিয়ালিজম কোন বিশেষ সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অভিঘাতকে কেন্দ্র করে এক-একটি শিল্প আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে। সেই বিশেষ অভিঘাতের পরিবর্তন হলে অথবা নতুন কোন প্রেক্ষাপট সামনে চলে আসলে পূর্ববতী আন্দোলনের প্রবাহটি ক্ষীণ হয়ে উঠে। জুরিখে শুরু হওয়া ডাডাইজমের ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছিল। ১৯১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া ডাডাইজম ১৯২৪ সালে এসে ঝিমিয়ে পড়ে। সামাজিক প্রেক্ষাপটে ডাডা আন্দোলনের গতি ম্লান হওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল। তবে ডাডাইজম একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বরং পরবর্তীতে এ মতবাদটি প্যারিসের শুরু হওয়া সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ আন্দোলনের সঙ্গে মিশে যায়। ডাডাবাদী অনেক শিল্পীই তখন সুররিয়াজিম ধারার সঙ্গে যুক্ত হন। সে কারণে প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর যখন সুররিয়ালিজমের উদ্ভব ঘটেÑতখন ডাডাইজমের বিভিন্ন চিন্তাও এই মতবাদটির মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত হয়। বিশেষত, ডাডাবাদী শিল্পীরা যে বাস্তবতাকে অস্বীকার করে উদ্ভটতা ও যুক্তিহীনতার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন; সুররিয়ালিজম নিঃসঙ্কোচে সেই ‘বাস্তব ও যুক্তহীনতা’কে গ্রহণ করেছিল। একই কারণে পুঁজিবাদী সভ্যতার ওপর ডাডাইজমের মতো সুররিয়ালিজম ধারার শিল্পীদের বিরূপ ধারণা ও ক্ষোভ ছিল। কিন্তু সার্বিক বিষয় নিয়ে পৃথিবীর প্রতি তাঁরা ইতিবাচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন। সুররিয়ালিজম ধারার আদি পুুরুষ ধরা হয় ফরাসি কবি গিয়োম অ্যাপোলিনিয়ারকে। তাঁর কবিতায় প্রাথমিকভাবে সুররিয়ালিজমের উপস্থাপন হয়েছিল। তিনিই ১৯১৭ সালে দঝঁৎৎবধষরংস’ শব্দটি পল ডিরমি’র কাছে লেখা এক পত্রে প্রথম ব্যবহার করেন। দঝঁৎৎবধষরংঃ’ শব্দটিও তাঁর দেয়া। তাঁর দঞযব ইৎবধংঃং ড়ভ ঞরৎবংরধং’ নাটকে এ্যাপোলিনিয়ার এ শব্দটির ব্যবহার করেন। এ নাটকটি ১৯১৭ সালে মঞ্চস্থ হলেও এ্যাপোলিনিয়ার এটি ১৯০৩ সালে লিখেছিলেন। অন্যদিকে এ মতবাদটি প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে কবি আন্দ্রে ব্রেতোঁ স্মরণযোগ্য অবদান রেখেছেন। এ ধারায় অর্থবহ অবদানের জন্যে তাঁকে ‘দি পোপ অব সুররিয়ালিজম’ বলা হয়। যদিও সুররিয়ালিজমের প্রথম ইস্তেহার প্রকাশ করেন ইয়ান গল। এ ইস্তেহারটি ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পরেই ১৫ অক্টোবর আন্দ্রে ব্রেতোঁ সুররিয়ালিজমের দ্বিতীয় ইস্তেহারটি প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৩০ সালে এ ধারার তৃতীয় ইস্তেহারটিও প্রকাশ করেন। ইয়ান গল ও আন্দ্রে ব্রেতোঁÑদুজনে দু’দল সুররিয়ালিস্ট শিল্পীর নেতৃত্ব দিতেন। ইয়ান গলের নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, ট্রিস্টান জারা, মার্সেল আর্লেন্ড, জোসেফ ডেলটিল, পিয়েরে অ্যালবার্ট বিরোট প্রমুখ। আন্দ্রে ব্রেতোঁর নেতৃত্বে ছিলেন লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার্দ, রবার্ট ডেসনোস, জ্যাক বারোন, জর্জ ম্যালকিন প্রমুখ। এ দুটি দলেই ডাডাইজম আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। অবশ্য ইয়ান গল ও আন্দ্রে ব্রেতোঁ এ শিল্প আন্দোলন নিয়ে প্রকাশ্য-দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। সুররিয়ালিজম বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ডাডাইজম থেকে নিলেও এ মতবাদটি ‘শিল্পের উৎস ও উপকরণ’ বিবেচনায় অন্যটির চেয়ে স্বতন্ত্র্য। সুররিয়ালিজম আন্দোলনের সামনের ভাগে ছিলেন ফরাসি কবি আন্দ্রে ব্রেতোঁ। তিনি শিল্প রচনায় ‘অবচেতন মনের ওপর গুরুত্ব’ দেয়ার জন্য শিল্পীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি মনে করেন, ‘অবচেতন মন হতে পারে কল্পনার অশেষ উৎস।’ তিনি অবচেতন মনের ধারণাটি নিঃসন্দেহে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ডাডাবাদী শিল্পীরা শিল্পের উৎস ও উপকরণ আহরণে ‘অবচেতন’ মনের ধারণার ওপর সচেতন ছিলেন না। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা এসে অবচেতন মনের উৎস থেকে শিল্প রচনার প্রতি গুরুত্ব দেন এবং সফলতাও লাভ করেন। আন্দ্রে ব্রেতোঁ মনে করতেন, ‘যা বিস্ময়কর, তা সবসময়ই সুন্দর’। অবচেতন মনের গহীনেই বিস্ময়কর সুন্দরের বসবাস। তার সন্ধান করাই হতে পারে শিল্পীর যথার্থ কাজ। অবচেতন মনের কারণেই সুররিয়ালিজমের শিল্পীরা গভীর আত্মঅনুসন্ধানে নামেন। মনের গহীন থেকে স্বপ্নময় দৃশ্যগুলো হাতড়ে বের করতে এবং মনের অন্তর্গত সত্য উন্মোচনে তাঁরা আগ্রহী ছিলেন। যার কারণে চেতন ও অবচেতনের মধ্যে শিল্পীরা বন্ধন স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা অবচেতন মনের সেই সব উপলব্ধিকে দৃশ্যে রূপ দিলেন যা পূর্বে কেউ কখনো করেনি। অবচেতনের ভূমিতে দাঁড়িয়ে বাস্তব উপস্থাপনের কারণে খুব দ্রুতই এ মতবাদটি বিশ^ শিল্পকলায় ‘অভিনবত্ব’ যোগ করতে সমর্থ হয়। সুররিয়ালিজমকে ‘নির্দিষ্ট’ ছকে ফেলা কঠিন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীরা একই ছাতার নিচে থেকে ছবি আঁকলেও তাঁদের দৃষ্টি ও উপলব্ধির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ফলে এ মতবাদটি সম্পর্কে একেকজন একেক রকম করে ভেবেছেন। সালভাদর দালি মনে করতেন, ‘সুররিয়ালিজম একটি ধ্বংসাত্মক বিষয় এবং এটি কেবল তা-ই ধ্বংস করে যা দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখে।’ অন্যদিকে জন লেলন বলেছেন, ‘সুররিয়ালিজম আমার কাছে বিশেষ প্রভাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কেননা, আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার কল্পনা উন্মাদনা নয়। বরং সুররিয়ালিজমই আমার বাস্তবতা।’ ব্রেতোঁ বলতেন, ‘ভাবনার যথাযথ পদ্ধতি অনুধাবনের জন্য সুররিয়ালিজম আবশ্যক’। এ ধারায় স্বপ্ন ও বাস্তবতার মিশ্রণ হয় বলে সুররিয়ালিজমকে স্বপ্নবাস্তবতাও বলা হয়ে থাকে। সুররিয়ালিজমের ঢেউ খুব অল্প সময়েই শিল্পের সবগুলো শাখায় আঁচড়ে পড়ে। কবিতা, গান থেকে শুরু করে নাটক, সিনেমা পর্যন্ত সুররিয়ালিস্টদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সুররিয়ালিজম ধারায় অন্তত ৬টি সিনেমা নির্মিত হয়। এ ধারার প্রধান শিল্পীরা হলেন জ্যাঁ আর্প, ম্যাক্স আর্নেস্ট, আন্দ্রে মেসন, সালভাদর দালি, রেনে ম্যাগরেট, পিয়েরো রয়, জোয়ান মিরো, পল ডেলভাক্স, ফ্রিদা কাহলো প্রমুখ। এ ধারার চিত্রকর্মের মধ্যে ১৯৩১ সালে আঁকা সালভাদর দালির ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ সবচেয়ে আলোচিত ছবি। এটি কেবল এ ধারার মধ্যেই আলোচিত চিত্রকর্মই নয়, এটি দালিরও অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভার নিদর্শন। ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’-তে দালি ‘সময়ের’ বিচিত্র অবস্থাকে ফ্রেমবন্দী করতে চেষ্টা করেছেন। ‘মেটামরফসিস অব নার্সিসাস’, ‘নভিলিটি অব টাইম’, ‘প্রোফাইল অব টাইম’ও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সুররিয়ালিজম ধারার প্রধানতম চিত্রকর্মের মধ্যে রেনে ম্যাগরেট-এর ‘দ্য সন অব ম্যান’, ‘দিস ইজ নট এ পাইপ’, জর্জিও দি চিরিকো-এর ‘দ্য রেড টাওয়ার’, ‘ম্যাক্স আর্নেস্ট-এর ‘দি এলিফ্যান্ট সিলিবেস’, ণাবং ঞধহমুঁ-এর ‘রিপ্লাই টু রেড’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষ হলে সুররিয়ালিজম আন্দোলন থেমে যায়। শিল্পবোদ্ধারা মনে করেন, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের শেষের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনটির অনানুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘটে। কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্প আন্দোলনের মতো সুররিয়ালিজমের চর্চা বর্তমানেও হচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনেও সুররিয়ালিজমের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। (শেষ)
×