ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) পর্ব : ৪ জীবনের একটি সময় আসে যখন অতি সহজেই কোন কথা বলা যায় না। সবকিছু বলার আগে অথবা করার আগেই চিন্তা-ভাবনা করতে হয় এবং সুচিন্তিতভাবে কথা বলতে হয়। এই বিষয়টি যদি জীবনের সূচনা থেকে শুরু হত তাহলে হয়তো অনেক মসৃণ হতো জীবন। কিন্তু কেবল মসৃণ হবার জন্য তো জীবন নয়। জীবনের অর্থই হচ্ছে তার ওঠা-নামা, বিপথগামী হওয়া অথবা আবার সঠিক পথে ফিরে আসা। এই সব কিছু নিয়েই জীবনযাপন। এটি একভাবে দেখলে একটি উৎসব বলেই মনে হয়। অর্থাৎ আমি যদি বলি যে জীবন একটি উৎসব, তাহলে বোধহয় ভুল বলা হবে না। বোধগম্যতার শুরু থেকে এই উৎসবের শুরু এবং জীবন শেষে ঘুমিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে উৎসবের শেষ। এই যে সময়টুকু, এই সময়টুকুকে কীভাবে পার করলাম, কীভাবে উদ্যাপন করলাম, কীভাবে ধারণ করলাম তার উপর নির্ভর করছে জীবনের সার্থকতা। এইসব নিয়ে আমরা কয়জন ভাবি! আদৌও হয়তো ভাবিই না। অথচ এই হচ্ছে সত্য। জীবনের এই পরিণত অধ্যায়ে এসে, আমি যেখানে পৌঁছেছি সেখানে কিছু বিষয় ভাবিত করে আমাকে। আমার তারুণ্যের শুরু এই ঢাকা শহরেই, সেই পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে। কুষ্টিয়া, যেখানে সরকারী আধিকারিক হিসেবে বাবার শেষ পোস্টিং, আমার কৈশোর সেখানে কেটেছে মহাআনন্দে। চারদিকে বৃক্ষরাজি : আম, জাম, কাঁঠাল, সফেদা এবং আরও অনেক ফলদ-বনজ বৃক্ষ। একধার দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী গড়াই নদী। বর্ষায় প্রমত্ত, শীতে অতি ক্ষীণ ধারা বক্ষে ধারণ করে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে। আমরা যেখানে থাকতাম সেখান থেকে কয়েক মাইল পশ্চিমে মোহিনী মিলস্, তখনকার পূর্ববঙ্গের প্রথিতযশা কাপড় কল, যার মালিক কানুবাবু ছিলেন শিল্পরসিক এবং গরিবের প্রতি বদান্য এক ব্যক্তি। এই রকম একটি মনোরম ছোট্ট শহরে হয়েছিল আমার কৈশোরের দিনাতিপাত। এখানে পুজোয়, বিশেষ করে দুর্গা পুজোয়, সমাবেশ ঘটত বাংলার প্রবাদ প্রতিম সব শিল্পীদের : হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখার্জী, আল্পনা বন্দোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র এঁরা। নিতান্ত সেই কৈশোরে উৎসুক ছিলাম ভাল গানের প্রতি। এর পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন আমার দিদি, আমার সবচেয়ে বড় বোন। যাঁর অনুপ্রেরণায় আমরা এইসব গান শুনেছি। শুনেছি সেই সব অমর অজর গান যা পুজোর সময় রেকর্ড হিসেবে বেরুতো। বিচিত্র প্রাণস্পর্শী কথা, অসাধারণ সব সুর । ভোলা যায় না। দিদির হাত ধরে পুজোর সময় মোহিনী মিল্সে গান শুনতে যেতাম এবং মন্ত্রমুগ্ধের মতো গান শুনে বাড়ি ফিরতাম। এহেন একটি অতি আকর্ষণীয় জীবন ধারা হঠাৎ করে থেমে গেল। আমরা চলে এলাম ঢাকায়। এখানে এসে কিছুদিন আমার খালার বাড়িতে থাকবার পর চলে আসি গে-ারিয়ায়। এই গে-ারিয়ার আবাসেই আমার যৌবনের শুরু। মানুষের কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হবার সময়টি অনেক সময় বড় তাৎপর্যপূর্ণ হয়। নানা রকম মানসিক এবং শারীরিক পরিবর্তন দেখা দেয়। এর কোন ব্যত্যয় ঘটেনি আমার বেলাতেও। একেক সময় যৌবনের যা ধর্ম- সেই রিপুর আন্দোলনে আমি উদ্বেলিত হয়েছি। কিন্তু এখন যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন মনে হয় সেই অস্থিরতা কখনই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে পারেনি। আজকাল আমার পরিচিত, আমার সন্তানসম অনেক তরুণকে আমি জানি যারা যৌবনে পৌঁছেই যৌবনের স্বভাব সুলভ যে উন্মাদনাগুলো আছে সেইগুলোর রসাস্বাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের সর্বত্র সকল সমাজে এটাই ঘটে। মানুষের শারীরিক বা মানসিক যে প্রয়োজন যৌবনের সঙ্গে যার স্ফুরণ, তা তো মেটাতেই হবে। এটা সত্য যে সামাজিক কিছু অনুশাসনের জন্য আমরা বিরত থাকি আমাদের ইচ্ছেগুলোকে লাগাম ছাড়া করতে। কিন্তু সেই অনুশাসনও আজকের এই আধুনিক বাংলাদেশে ক্রমেই অনেক শ্লথ হয়ে এসেছে। অনেক সহজ হয়ে এসেছে। অনেক বেশি ঢ়বৎসরংংরাব হয়ে এসেছে। যার ফলে এখন দুইজন তরুণ-তরুণী একে অপরের প্রতি আকর্ষিত হলে তাদের মিলনে বাধা হতে পারে না কোন কিছুই। আমাদের যৌবনে বেশ কিছু কারণের জন্য এই বিষয়গুলো বেশ ভিন্ন ছিল। এই কারণগুলোর মধ্যে প্রধান কারণ ছিল অবশ্যই সামাজিক অনুশাসন, বাবা-মা’র অনুশাসন, সংসারের অনুশাসন কিংবা প্রয়োজন। এইগুলো প্রাথমিক বাধা হিসেবে দেখা দিত। এরও পেছনে সবচেয়ে বড় কারন হল এই যে, তখন সমাজ যেমন অনেক বেশি একীভূত ছিল, প্রত্যেক বাড়ির মানুষেরা অন্য বড়ির মানুষকে চিনত, প্রত্যেক ব্যক্তি তার সমাজের প্রয়োজনে নিজের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করত, তেমনি পরিবারগুলোও অনেক বেশি সংঘবদ্ধ ছিল- একত্রিত ছিল। আমার যৌবনে আমি কখনও এ রকম দেখিনি যে দিনে অন্তত একটি বেলায় আমরা সবাই এক সঙ্গে বসে খাব না। হয় প্রাতঃরাশ কিংবা রাতের নৈশভোজ যে কোন একটি বেলায় একটি টেবিলের চারদিকে ঘিরে বসতাম আমরা সবাই। আমাদের সারা দিনের যেসব অভিজ্ঞতা একে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতাম। আমার বাবা কি আমার মা, তারাও সমান আগ্রহী ছিলেন আমাদের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে জানতে। ফলে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একটি পারিবারিক বন্ধন আমাদের বহির্মুখী হতে দেয়নি। পরিবারের যে অনুশাসন সেটি মানতে হত বলে আমরা কখনই আমাদের ষড়রিপুকে এই পারিবারিক অনুশাসনের বাইরে আমাদের উপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে দেইনি। পরিবার ছিল প্রধান এবং পারিবারিক আচরণের মধ্য থেকেই আমাদের প্রাত্যহিক জীবন নিয়ন্ত্রিত হতো। আরও একটি বিষয় এখানে না বললেই নয়, সেই যে প্রকৃতির প্রতি ভালবাসার সৃষ্টি হয়েছিল কৈশোরে যা আমাকে বহির্মুখী করেছিল, যা আমাকে টেনে নিয়ে যেত বৃক্ষরাজির মাঝে কি নদীর পাড়ে, সেই প্রকৃতি বা নিসর্গ প্রেম আমার যৌবনেও সমধিকভাবে আমার উপর কাজ করেছে। গে-ারিয়ার অদূরে রেল লাইন পেরুলে পরেই তখন ছিল বিস্তীর্ণ গ্রাম। প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই আমরা কয়েক বন্ধু মিলে সেই গ্রামের দিকে চলে যেতাম। ডাহুকের ডাক, ঘুঘুর ধ্বনি কিংবা বকের উড়ে চলা এমনভাবে উদ্বেলিত করত আমাকে। কখনও ভাবিনি যে এই সব ফেলে দিয়ে অন্য কিছুও করা সম্ভব। যৌবনের শারীরিক যে উদ্বেলতা সেটি ছিল। কিন্তু সেটি কখনই এই প্রকৃতি প্রেমের উপরে স্থান পায়নি, আরোপিত হয়নি। আমি জানি না কি করে তখন সেটি সম্ভব হয়েছিল। এখনকার এই সময়ে যেটি সম্ভব নয়। এমনও হতে পারে যে একটি ক্রমবর্ধমান শহরে নাগরিক জীবন, যেখানে নিসর্গের ছোঁয়া কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না, সেখানে একজন যুবক কিংবা যুবতীর আকর্ষণই কেবল তাদের মধ্যে ঘোরাফেরা করে এবং ঘনীভূত হয়ে আসে সে আকর্ষণ একে অন্যের সংস্পর্শে। যদি তারা বাইরের দিকে চোখ ফেরাতে পারতেন, যদি তারা নিসর্গের সঙ্গে প্রাত্যহিকভাবে একটা সংযোগ স্থাপন করতে পারতেন তাহলে হয়ত জীবনটা অনেকটা আমাদের মতোই হতো। এই খানে পাঠকের জন্য একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে আমি বোধ করি। আমি কোন মূল্যবোধের বিচার করার ইচ্ছে নিয়ে এই কথাগুলো বলছি না। মূল্যবোধ বদলায় সমাজ বদলের সঙ্গে সঙ্গে। মূল্যবোধের অনেক পরিবর্তন হয় নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে। মানুষের ধ্যন-ধারণা ভিন্ন রকম হয়। আমি কেবল আমার নিজস্ব কথা বলছি যেটা আজকের তরুণের কথার থেকে অবশ্যই ভিন্ন হবে। তার চিন্তা-চেতনার থেকে অন্য রকম হবে। এটি বলা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তবে একটি কথা, এই যে একজন যুবকের ভিন্ন জীবন তাকে কেবল সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী নারী চিন্তায় ব্যাপৃত করেনি সেইটি বোধ হয় অনেকদিক দিয়ে আমাকে আরও অনেক বড় বিষয়ে ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি প্রায়ই দেখি এবং এই বিষয়ে আমি লেখালেখিও করেছি যে আজকের তরুণরা অবলীলায় বলে আমি রাজনীতিতে আগ্রহী নই। রাজনীতির কোন কথা বললে, অবশ্যই দলীয় রাজনীতি বহির্ভূত কথা, তারা বলে সময় নষ্ট হচ্ছে। ইংরেজীতে একটি কথা আছে চড়ষরঃরপধষ চযরষড়ংড়ঢ়যু. আমি এখন ভাবতে পারি না যে একজন চিন্তাশীল যুবক এই রাজনৈতিক দর্শন ছাড়া কীভাবে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে। আমার ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক চিন্তা, এই রাজনৈতিক বিকাশ, এই মূল্যবোধের দর্শন ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যেটি আমাকে সকল সময় নারীর প্রতি আকর্ষিত হবার সময় দেয়নি। এর আগের বাক্যটি একটু ভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করি। আমার রাজনৈতিক দর্শন এতই প্রগাঢ় ছিল যে অনেক সময় সেই চিন্তা আমার করোটিতে অনবরত উদ্বেগের সৃষ্টি করত। যার ফলে হয়ত একজন যুবকের নারীর প্রতি যে আকর্ষণ তা অগ্রগণ্য থাকেনি। এই বিষয়টি যে কেবল আমার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল তা নয়। আমার সমসাময়িক যে তরুণরা যারা ছিলেন তাদের সকলের জন্যই এই কথা প্রযোজ্য। আমরা তো সেই কৈশোর থেকেই দেখে এসেছি যে আমাদের দেশটি একটি ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে চলেছে। একটি ভিনদেশী শাসক আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের জীবন বোধ এবং এমনকি আমাদের রোমান্টিকতাকেও অনবরত আঘাত করে চলেছে। এই বোধ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এক ধরনের রাজনীতি। যে রাজনীতির সঙ্গে কোন দলের যে সম্পর্ক ছিল শুরু থেকেই তা নয়। তবে একটি স্বকীয়তা এর ছিল। এবং এই স্বকীয়তা কে স্বীকৃতি দিয়ে যেই সব রাজনৈতিক দল এগিয়ে এসেছিল তাদের সঙ্গেই আমরা একাত্মতা ঘোষণা করতাম বা একাত্ম হবার জন্য আগ্রহী হতাম। সেই দেশ চিন্তা, জাতি চিন্তা, সংস্কৃতি চিন্তা, ভাষা চিন্তা এগুলো এত সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী ছিল যে আমাদের শারীরিক কিংবা মানসিক যে আবেদনগুলো, যে চাওয়াগুলো সেগুলো একটু দূরে সরে গিয়েছিল। আমি মনে করি এটি একটি বিরাট কারণ যাতে করে হয়ত তারুণ্যের উন্মেষে আমরা নারীর প্রতি ঠিক একইভাবে আকর্ষিত হইনি আজকের তরুণরা যেভাবে হয়। আমাদের জীবনটা ছিল প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত ওই একই চিন্তা : কীভাবে দেশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা যায়। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মে আমরা শুনেছি এই রকম অনেকে ছিলেন। ধরা যাক কোন একজনকে, যেমন- নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, তিনিও নারী সংস্পর্শে যেতে সময় পাননি, আগ্রহী হননি। কারণ তার মাথায় সর্বাগ্রে খেলা করেছে দেশ চিন্তা, দেশকে মুক্ত করবার যে আগ্রহ সেই আগ্রহ। এইভাবে জীবন চলেছে এবং এইভাবে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। তবে একটা কথা সত্য যৌবনের স্বভাব সুলভ যে চিন্তা অর্থাৎ নারীকে যেখানে প্রধান হিসেবে দেখা হয়, সেই নারী সম্বন্ধেও চিন্তা আমাদের মাথায় এসেছে বৈকি। (চলবে)
×