ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ সার্টিফিকেট

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

গল্প ॥ সার্টিফিকেট

কাছের কিছু বন্ধুদের একের পর এক চাকরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাহার এখনও চাকরি হচ্ছে না। সরকারী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা প্রায় শেষের দিকে তার। দিনের সূর্যটা যখন পশ্চিমে যায় তখনই তার স্বপ্নগুলো অন্ধকারে আবদ্ধ হওয়ার অভাস পায় রাহা। সরকারী চাকরির পরীক্ষায় রিটার্ন, ভাইবা কতগুলো যে দিয়েছে তার কোন হিসার নেই। ভাল পরীক্ষা দিয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে রেজান্টের জন্য অপেক্ষা বসে থাকে। কিন্তু সে আশায় বসে থাকার স্বার্থকতা নেই। আশা আর পূরণ হয় না। চাতক পাখির যেমন একটু পানির জন্য আকাশে ঘুরে বেড়ায় তেমনি রাহা একটা চাকরির জন্য ছটফট করে। কোনভাবে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে ঘুরতে সোনার হরিণের গাড়ির কাছে পৌঁছাতে পারছে না। নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে মাঝে মাঝে সে। সরকারী চাকরি না পাওয়ার জন্য রাহা তার মামা খালুকে দায়ী করে না। দায়ী করে তার জন্মদাতা বাবাকে। রাহার বাবার কারণে সরকারী চাকরি হচ্ছে না। বাবার জন্য চাকরি হচ্ছে না! এ কেমন কথা। তার বাবা কী করেছেন। যে অপরাধে সন্তানের চাকরি হচ্ছে না। সব বাবাই তো সন্তানের ভাল চায়। তাহলে রাহার বাবা কি তার সন্তানের জন্য ভাল চান না? রাহার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নেই। তার বাবা যদি মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতেন তাহলে এতদিনে রাহার একটা ভাল চাকরি হয়ে যেত। হতাশায় ভুগত না প্রতিনিয়ত। হতাশায় মাঝে মাঝে সার্টিফিকেট না থাকার কারণে রাহা বাবার প্রতি ভীষণ রাগ করে। বাবা কেন একটা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করলেন না। সার্টিফিকেট সংগ্রহ করলে আমার কবে সরকারী চাকরি হয়ে যেত। আমাদের পরিবারের সবার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যেত। রাহা মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে নিজের যোগ্যতার প্রশ্নের সম্মুখীন হন। কিছুই যেন সে ভেবে কুল পায় না। তবে কুল পায় তার বাবার একটা কথা মনে করে। তার কাছে বাবার কথাটা বেশ মূল্যবান। কথাটা বলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট সম্পর্কে- ‘আমি দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সার্টিফিকের জন্য যুদ্ধ নয়।’ রাহার বাবার এই কথাটা মনে পড়লে হতাশার মাঝেও তার ইচ্ছাশক্তি ও সাহস বাড়ে। নিজেকে নিয়ে অবশ্য গর্ববোধ করে। কারণ তার বাবা একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। বাবার প্রতি তার মনে মনে যে রাগ করে। তবুও বাবার প্রতি তার শ্রদ্ধা, সম্মান ভালবাসা সব আছে। এটা তো একজন সন্তান হিসেবে বাবার প্রতি থাকবেই। তারপর তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবুও বর্তমান পরিস্থিতে দেখে সার্টিফিকেটের প্রচ- অভাববোধ করে রাহা। রাহা ভাবে- আজ যদি বাবার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিটেক থাকত তাহলে কবেই বিসিএস ক্যাডার হয়ে যেতাম। নিজের ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারতাম। আর আমার প্রতি অনেকের চাওয়া পাওয়া আছে সেগুলো পূরণ করতে পারতাম। কিন্তু এখন আমি কিছুই করতে পারছি না। আর পারারও কথা না। আমার একটা চাকরি দরকার। অথচ আমাদের পাশের গ্রাম সরাই হাজীপুর। সে গ্রামের আমার বাল্যবন্ধু মাসুদ। তার বাবা নাকি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। এলাকার অনেকের মুখে শোনা যায়। আমি বন্ধু মাসুদের কাছ থেকে শুনেছি, তার বাবা কি করে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করলেন। মাসুদের বড় ভাই মামুন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়েন তখন মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা করে। সেই তালিকায় মাসুদের বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। মামুন ভাই বুদ্ধিটা বাবাকে দিয়ে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের নতুন করে তালিকা হবে। আপনি যেমন করে হোক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আপনার নামটা অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েন। টাকা লাগলেও করে নিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে আমাদের লাভ হবে। আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে চাকরিসহ নানা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাব। তাই বলছি, যেমন করে হোক সাটির্ফিকেটের জন্য মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নামটা রাখতে হবে। মাসুদের বাবা তাই করলেন। তিনি বিভিন্ন চেষ্টায় একটা মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিটেক সংগ্রহ করলেন। কিছুদিন পর আমার মাসুদের বড় মামুন ৪র্থ বর্ষ পরীক্ষা শেষ করে বিসিএস দিলেন। চাকরি হয়ে গেল। তিনি প্রশাসন ক্যাডার পেলেন। হলেন ম্যাজিস্ট্রেট। মেঝো ভাই হলেন পুলিশের এসআই। আর আমার বন্ধু মাসুদ রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে জব পেয়েছেন। সবই কিন্তু ওই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিটের কল্যাণে হলো তাদের। মাসুদের বাবার জন্য তাদের সংসার কত সুন্দর করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু আর আমার বাবার জন্য আমাদের কি হলো। কিছুই হলো না। রাহা মনে মনে রাগ করলেও বাবার কথাটাকে সান্ত¡না দিয়ে নিজেকে আবার চাকরি যুদ্ধে নামার সাহস সঞ্চরণ করে। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে হলে তো এখন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবেই। রাহা নানা কিছু ভাবছেÑ প্রতিনিয়ত তার ভাবনায় ভর করে নানা দুশ্চিন্তা। হায় হায় করে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটের জন্য। কিন্তু কোন লাভ হয় না তার। হঠাৎ রাহা বন্ধু শামীম ফোন করে। মোবাইলের স্ক্রিনে শামীমের নামটা দেখে কলটা যদিও রিসিভ করতে চাইল না। তবু কলটা ধরে হ্যালো বলল, রাহা। শামীম বলল, ‘রাহা, একটা নিয়োগ হয়েছে। আয় একসঙ্গে আবেদন করি।’ রাহা বলল, ‘আর কত আবেদন করবি রে শামীম।’ শামীম বলল, ‘এটা হয়তো আমার আর তো চাকরি আবেদনের শেষ আবেদন। তাই বলছি। আয় দুজন শেষ আবেদনটা করি এক সঙ্গে।’ রাহা বলল, ‘ঠিক আছে, তুই থাক আমি নীলক্ষেতে আসছি।’ ‘ওকে।’ সরকারী চাকরির শেষ আবেদন করেছে রাহা। কিন্তু এত দিনে কি তার সরকারী চাকরি হয়েছে? নাকি অনেকের মতো রাহা আজও বেকার জীবনযাপন করছে।
×