ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জলে জোছনায় জীবনের আবাহন ॥ সম্ভাবনার নতুন কাগজ

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

জলে জোছনায় জীবনের আবাহন ॥ সম্ভাবনার নতুন কাগজ

বাংলাদেশে গড়পরতা লিটল ম্যাগের অভাব নেই। এ কথা যেমন সত্য তেমনি মানসম্মত এবং প্রতিনিধিত্বশীল ছোট কাগজ চোখে পড়ে না। একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আশি-নব্বইয়ে কিছু ছোট কাগজ সুনিদির্ষ্ট উদ্দেশ্য আর পরিকল্পিত চিন্তার অনুসন্ধানে এই কাগজের যাত্রা নির্ণিত হয়েছিল। তারপরও ছোট কাগজের কদর কমেনি- কাগজের সেই চরিত্র ধরন আর আয়ুষ্কাল আর যাই হোক আধুনিক প্রকাশনার জগতে এর মান বৃদ্ধি কতটুকু হয়েছে তা কেউ বলতে না পারলেও দর্শনসৌন্দর্য বেড়েছে অনেক এ কথা সকলে জানে। তাই এ সময়ে এসে আর যেনতেন কাগজ বের হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে- কাগজগুলো পাঠক মনে-মননে রেখাপাত করছে কীভাবে-কতটুকু? দেখা যাচ্ছে অনেক অদক্ষ সম্পাদক এই কাগজের কনসেপ্ট ও চরিত্র গুলিয়ে ফেলছে আর সাহিত্যের মূলধারা থেকে সরে যাচ্ছেন। আর আবদ্ধ হচ্ছেন চরম গোষ্ঠীবদ্ধতায়। সাহিত্যের এহেন দোলাচলের সঙ্কটে জলধি তার স্বরূপ নিয়ে পাঠকের কাছে উপস্থিত হয়েছে। আমরা লাখ করেছি জলধির সূচনা সংখ্যাটি যথেষ্ট গোলমেলে ও অপরিকল্পিত-দুর্বল সম্পাদনার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর বহন করে। অথচ দ্বিতীয় সংখ্যাটি তার সঠিক অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টায় ছাপ চোখে লাগে এবং পরিশ্রমী মনে হয়েছে। একই সঙ্গে সম্পাদক নাহিদা আশরাফী সামনে এক বিশাল প্রশ্ন! আমরা কেনই বা জলধিকে ছোট কাগজ বলব? জলে জোছনার জীবরের আবাহনে কল্পনা সূত্রকে আশ্রয় করে প্রকাশ হয়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক ত্রৈমাসিক জলধি। এই কাগজের লক্ষণযোগ্য বিষয় হলো তার উপদেষ্টাম-লী পর্বটি। ভারতের স্বনামধন্য কবি মৃণালবসু চৌধুরী বাংলদেশের মুহাম্মদ নূরুল হুদা, ইসহাক খান, আতাউর রহমান মিলাদ, মজিদ মাহমুদ মাসুদ মুস্তাফিজের নাম অঙ্কিত হয়েছে। মোট উপদেষ্টা ৬ জন। যা গত সংখ্যার থেকে ২ জন বেশি। সম্পাদনা পরিষদের এমন দীর্ঘ উপদেষ্টাম-লী একদিন হয়ত পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে দারুণভাবে। জলধিতে চোখে পড়ার মতো কবিতাবিষয়ক গদ্য অত্যন্ত মূল্যবান অসীম গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ গদ্য লিখেছেন- ‘জলবাসরে সূর্যের বৈভবÑশব্দভানে শ্রীচরণেষু’ শিরোনামে মাসুদ মুস্তাফিজ। এই মুক্তগদ্যটি পাঠে কবিতাবোঝা বোদ্ধাপাঠক মাত্রই নান্দনিকচিন্তার খোরাক যোগাবে। কবিতা লিখিয়েদের ভাবনা আরও প্রসারিত করবে আর উপলব্দির জানালা-দরজায় কবিতাস্বর্গের ঐশ্বরিক বাতাস নড়িয়ে দেবে বলে বিশ্বাস করি। জলধির কাছে এমন সুখকর কবিতাবিষয়ক গদ্য আরও আশা করতেই পারে। পাঠক মননে স্থান পেয়েছে আরেকটি গদ্য মাহবুবুল আলম রচিত‘ কবিতার স্বরূপ। এছাড়া গদ্য লিখেছেন- এলিজা খাতুন। দুই পর্বে কবিতা লিখেছেন মোট ৪৮ জন কবি। এদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, আযাদ কালাম, পাবলো শাহি, মুজিব ইরম, পরিতোষ হালদার, মাসুদার রহমান, জাকির জাফরান, দন্তন্য ইসলাম, মনজুর কাদের, রিষিণ পরিমল, নুরুল হক আরেক পর্বে রেজাউদ্দিন ষ্টালিন, মতিন বৈরাগী, চাণক্য বাড়ৈ এদের কবিতায় একটা আলাদা চমক আছে। আরও কবিতা লিখেছেনÑ আলমগীর রেজা চৌধুরী, কাজল রশীদ, রাহমান ওয়াহিদ, মোহাম্মদ আমজাদ আলী, সরকার মাহবুব, মাহমুদ নোমান, রহিমা আক্তার কল্পনা, প্রদ্যেত কাজী লাবণ্য, ইভান অনিরুদ্ধ, আদিত্য নজরুল, কুতুব আজাদ, অরণ্য রেজা, ইফতেখার হালিম, শামসুদ্দিন হীরা, প্রতিমা সরকার, জয়নুল শামীম, মানিক মুহাম্মদ রাজ্জাক, মতি গাজ্জালী, রাশেদ রউফ, রওশন ঝুনু, হাসান কল্লোল, সোহান সিদ্দিকী, তামীম চৌধুরী, সৌগত রানা কবিয়াল, সুরাইয়া বেগম, এবিএম জাকির হোসেন বেলাল, নিউ হ্যাপি চাকমা, শফিকুল আলম। ৪টি অসাধারণ প্রবন্ধ মুদ্রিত হয়েছে এই সংখ্যায়। সমকালীন সাহিত্যের ধারা ও গতি নিরুপনে এই প্রবন্ধটি বিশেষ করে আমেরিকান সাহিত্য জানতে অত্যন্ত ভাল প্রবন্ধ লিখেছেনÑ হোসেন উদ্দীন হোসেন অন্যদিকে শহীদুল জহিরকে এ সময়ে অনেকখানি প্রাসঙ্গিক করে একটি গুরুপ্তপূর্ণ রচনা ‘চাঁদ বদনী’র নান্দনিক বয়ান লিখেছেনÑ শহীদ ইকবাল অন্যদিকে বাংলা নাটকের উজ্জ্বল কিংবদন্তিÑ সেলিম আল দীনকে স্মরণগদ্য লিখেছেন- সফিক আজিজ এছাড়া বাবলু ভট্টাচার্য সাহিত্যের অত্যন্ত জনপ্রিয় শাখা হলো গল্প। বাংলা গল্পের ধারা-বিবর্তন-বিনির্মাণ এবং রূপায়ণ শৈলীর অনেক পরিবর্তন ঘটেছে এই শাখায়। বাঁক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে গল্পের টেক্স ও কনটেক্সের রূপ বদল হয়ে আধুনিক চিন্তামনস্ক ইজমে প্রকরণগত জটিলতা ভেঙে নতুন প্রত্যয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক গল্পের স্বরূপ অন্বেষণে পাঠক বরাবরেই উৎসুক এবং মরিয়া। আসলে ৯০ দশকের পরে গল্পের তেমন কোন কাজ হয়নিÑ হয়নি উল্লেখযোগ্য ভাংচুর। এ সংখ্যায় এ সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল গল্পকারের লেখা ছাপা হয়েছে এ সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল গল্পকার আনিফ রুবেদ, অনুপম হাসান, মনি হায়দারের গল্প। এছাড়া গল্প লিখেছেনÑ শেখ আতাউর রহমান, মঈনুল হাসার, আহমেদ মুসা, আনিস হক, কাকন আবু বকর, সানোয়ার রাসেল, সকাল রয়, শাশ্বত নিপ্পন, অপরাহৃ সুসমিতো, সুপন শাহরিয়ার, সুপ্রিয় কুমার চক্রবর্তী জলধির সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্বটি হলো রহমার হেনরীর ৫টি ভিনভাষী কবিতার বাংলায়ন। আমরা জানি অনূদিত সাহিত্য সমৃদ্ধ না হলে মূলধারার সাহিত্য কখনও সমৃদ্ধ হয় না। তাই যে কোন প্রকাশনায় কাক্সিক্ষত চাহিদা হচ্ছে অনুবাদ সাহিত্য। জলধির দীর্ঘ কবিতার আয়োজনটি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়নি। এ পর্বে সমকালীন ভাবনার অবতাড়িত হয়েছে আমিনুল ইসলাম এবং অনন্ত সুজনের কবিতায়। এছাড়া দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন- কামরুল বাহার আরিফ, ফারুক সুমন এবং তাপস চক্রবর্তী। যতদূর জানি ছোট কাগজের চরিত্রে ছড়া পর্বটি বেশ বেমানান। বাংলাদেশে এখনও ছড়াসাহিত্যে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। এ পর্বে ছড়া লিখেছেনÑ রহীম শাহ্, সোহেল মল্লিক, সোহেল মীর, মাহফুজুর রহমান আকন্দ, নাসিমা বানু এবং রমা সিমলাই। এবাদে ড. রাশিদা আশকারীর-বাংলাদেশের নারী, মোজাফ্ফর হোসেনের-নারীবাদী কেটপা এবং এক ঘণ্টার গল্পের তাত্ত্বিক পাঠ, নুরুজ্জামান হালিমেরÑ বিধবা বিবাহ ও বিদ্যাসাগর নামক নিবন্ধ মুদ্রিত হয়েছ্।ে শেষে তরুণ গল্পকার সফিক হাসানের-প্রতিদিন একটি খুন গ্রন্থের আলোচনা লিখেছেন-মনোজিৎ কুমার দাস। আগস্ট-অক্টোবর-২০১৭, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, দাম-১০০ টাকা, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ২৪১ পৃষ্ঠার এই ছোট কাগজটির কাব্য কারিমের প্রচ্ছদে দৃষ্টিনন্দন ঝকঝকে ছাপার অক্ষরে সম্পাদকের পরিশ্রম ফুটে ওঠে। তবে বানানশৈলীতে আরও মনোযোগ দাবি করে। সম্পাদক নাহিদা আশরাফী পাঠকের প্রিয় লেখাটি উপহার দেয়ার দায়িত্ব নেন জলধিকথায়। আমরা শুধু অপেক্ষা করবো রবীন্দ্র-নজরুলের জলধিপ্রপঞ্চটি যেন কোনদিনই জলাশয়ে পরিণত না হয়। ছোট কাগজের সারিতে জলধি মাথা উঁচু করে দাঁড়াক।
×