ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

মহাপ্রভুর ধামে

প্রকাশিত: ০৭:০২, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

মহাপ্রভুর ধামে

আমরা এসে পৌঁছালাম মহাপ্রভুর পৈত্রিক নিবাসে। গাড়ি থেকে নেমে পদব্রজে যাত্রা শুরু করলাম। মন্দিরে ঢোকার সময় হাতের ডান পাশে দেখা পেলাম প্রায় সংস্কারহীন ভগ্ন প্রবেশ দ্বার। সেখানে একজনের কাছে জানতে চাইলাম এটাই কি মূল মন্দিরের প্রবেশ পথ। উনি বললেন, না এটি চৈতন্য মহাপ্রভু দিদিমার বাড়ি। আরেকটু সামনে গেলেই মহাপ্রভুর বাড়ি মানব মনের ক্লান্তি দূর করতে ভ্রমণের বিকল্প লেই। গত তিন সপ্তাহ হলো কোথাও ঘুরতে বের হওয়া হয় না। অফিসে কাজ এর চাপ ও খুব কোথাও ছুট দিতে মন চাইছিল। কিন্তু সঙ্গী, সময় কোনটাই পাচ্ছিলাম না। এর মাঝে ছোট মাসির ফোন। মাসি আসবেন ঘুরতে সিলেটে অনেক দিন হয় সিলেটে আসেন না। আমি মনে মনে খুশিই হলাম যাই হোক মাসির আসা উপলক্ষে কোথাও ঘুরতে বের হওয়া যাবে। মাসি ঘুরতে আসবেন ভাল কথা কিন্তু কোথায় যাব ঘুরাতে? রাতারগুল, জাফলং, লালাখাল, ডিবির বিল এই সব জায়গায় ঘুরে এসেছেন মাসি। আমি ভাবতে লাগলাম নতুন কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়। মাথায় প্রথমেই এলো উপমহাদেশের বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রী চৈতন্য দেবের পৈত্রিক নিবাস ঢাকা দক্ষিণের নাম। অনেক নাম শুনেছি কিন্তু কখনও যাওয়া হয়নি। অষ্টাদশ শতকের মন্দির এটি, ঐতিহ্য গত দিক থেকে এই মন্দিরের গুরুত্ব অনেক। দেখতে দেখতে আমাদের নতুন ভ্রমণ গন্তব্যে যাবার সময় ঘনিয়ে এলো। গতকাল রাতে মাসি এসেছেন ঢাকা থেকে সঙ্গে দুই ভাইকে নিয়ে। সকাল হতেই সবাই প্রস্তুত নতুন গন্তব্যে যাবার জন্য। কিন্তু আমাদের চার চাকার পাইলট সাহেবের দেখা নেই। ফোন দেই ধরে না বেশ কয়েকবার ফোন দেয়ার পর পাইলট সাহেব ফোন ধরলেন। ফোন না ধরার কারণ হিসেবে উনি বললেন নিদ্রায় শায়িত ছিলেন তাই ফোন ধরতে পারেননি। আর সিলেট থেকে ঢাকা দক্ষিণ যেতে খুব একটা বেশি সময় লাগে না তাই উনি ভেবেছেন আমরা দেরি করে বের হবো। যাই হোক পাইলট মহোদয় সকাল সাতটার জায়গায় সকাল নয়টায় উপস্থিত গাড়ি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত আমরা গন্তব্য পানে যাত্রা শুরু করলাম। সূর্য দেবের তির্যক রশ্মির প্রভায় আলোকিত চারিপাশ এর মাঝেই আমরা এগিয়ে চলছি। গাড়িতে চলছে পুরনো দিনের গান ‘এ পথ যদি না শেষ হয়... তবে কেমন হতো...’। এদিকে আমাদের অন্য ভ্রমণ সঙ্গী পৃথু, পিকু এই পুরনো দিনের গান শুনতে শুনতে নাখোশ। তাদের চাই হিন্দী গান পুরনো দিনের গান কি আর চলে। যাই হোক পরে সমঝতার ভিত্তিতে সবার পছন্দ মতো গান ছাড়া হলো। মাঝে মাঝে বেরসিক রাস্তার দরুন শরীরের সব কল-কব্জা ঢিলে হবার জোগার। এর পরেও নতুন গন্তব্যে যাবার আনন্দে সব কিছু তুচ্ছ করে আমরা এগিয়ে চলছি। বিপত্তি ঘটল গোলাপগঞ্জ বাজার এসে এখান থেকে কোন দিকে যেতে হবে কেউই জানে না। কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করলাম শ্রী চৈতন্য দেবের পৈত্রিক নিবাস যাব কোন দিকে রাস্তা কেউ বলতে পারছে না। আমাদের হাল ছাড়ার জোগার এর মাঝে এক জন প্রবীণ লোক এর দেখা পেলাম তার কাছে জানতে চাইলাম চৈতন্য দেবের পৈত্রিক বাড়ি কোন দিকে উনি বললেন চৈতন্য দেবের বাড়ি বললে কেউ চিনবে না। মহাপ্রভুর বাড়ি বললে চিনবে সবাই। শেষ পর্যন্ত পথের দিশা পেলাম আমরা। আমরা এগিয়ে চলছি চৈতন্য মহাপ্রভুর ধামের দিকে। চারদিকের প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের কে মোহিত করছে। প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা বলে বেশ কিছু কারুকার্য খচিত বাসভবনের দেখা পেলাম আমরা। এবার আমরা এসে পৌঁছালাম ছোট্ট বাজারে সেখান থেকে দুই দিকে রাস্তা কোন দিকে যাই...? পড়লাম ভারি মুস্কিলে শেষ পর্যন্ত পথের বন্ধুর সহায়তা নিতে হলো। মহাপ্রভুর আশ্রম কোন দিকে বলতেই দেখিয়ে দিল এই সামনে গেলে একটি পুকুর পার পাবেন। এর একটু সামনে গেলেই মহাপ্রভুর আশ্রম। আমরা এসে পৌঁছালাম মহাপ্রভুর পৈত্রিক নিবাসে। গাড়ি থেকে নেমে পদব্রজে যাত্রা শুরু করলাম। মন্দিরে ঢোকার সময় হাতের ডান পাশে দেখা পেলাম প্রায় সংস্কারহীন ভগ্ন প্রবেশ দ্বার। সেখানে একজনের কাছে জানতে চাইলাম এটাই কি মূল মন্দিরের ঢোকার প্রবেশ পথ। উনি বললেন না এটি চৈতন্য মহাপ্রভু দিদিমার বাড়ি। আরেকটু সামনে গেলেই মহাপ্রভুর বাড়ি। সবাই বলল তাহলে আমরা প্রথমে মহাপ্রভুর মূল মন্দির থেকে ঘুরে আসি পরে মহাপ্রভু দিদিমার বাড়ি দেখতে যাব। আমরা খালি পায়ে মন্দিরের দিকে প্রবেশ করলাম। ভক্তের পদচারণায় মুখর মন্দির প্রাঙ্গণ। চারপাশের আগরবাতির গন্ধে মোহিত করছে মানুষ, প্রকৃতি সব কূলকেই। আমরা মন্দির ঘুরে দেখছি, হঠাৎ শুনি আমার মাকে একজন মহিলা ডাকছেন। পাশে আসতেই পরিচয় পেলাম উনি মার অফিস কলিগ সুমিতা মাসি। আমি মনে মনে খুব খুশি হলাম। সুমিতা মাসির কাছ থেকে মন্দিরের ইতিহাস জানা যাবে। আর সঙ্গে দুপুরের ভোজন পর্বটা এখানেই শেষ করতে পারব। সুমিতা মাসি নিজের থেকেই বললেন শ্রী চৈতন্য দেবের দাদা শ্রী উপেন্দ্র মিশ্রের বাড়ি ছিল ঢাকা দক্ষিণের মিশ্রপাড়ায় যেখানে তার পিতা শ্রী জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতা শচীদেবী বিবাহ পরবর্তী সময়ে বসবাস করতেন। বিবাহের কিছুদিন পর শচীদেবী গর্ভবতী হলে তার দিদিমা স্বপ্নে দেখেন যে এই সন্তান হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান; তবে শচীদেবীর সন্তান যেন অন্যত্র ভূমিষ্ঠ হয়। তাই তিনি শ্রী জগন্নাথ মিশ্র এবং শচীদেবীকে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দেন ও বলেন যেন তার নাতি তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ফলে শ্রী চৈতন্য দিদিমার কথা রক্ষার্থে ঢাকা দক্ষিণে এসেছিলেন। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু তার দিদিমার কথা রক্ষার জন্য ঢাকা দক্ষিণে আসেন এবং সেখানে ২ দিন অবস্থান করেন। যদিও কেউ তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলতে পারেন না যে তিনি ঠিক কবে এখানে এসেছিলেন; তবে ধারণা করা হয় যে সেটি চৈত্র মাসের কোন এক রবিবার ছিল। তাই প্রতি বছর চৈত্র মাসে তার আগমন উপলক্ষে এখানে উৎসবের আয়োজন করা হয়। মাসব্যাপী চলমান এই উৎসবে মেলা, সঙ্কীর্তন, পূজা প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হয়। তাছাড়া মহাপ্রভুর ঢাকা দক্ষিণে আগমনের পর হতেই অর্থাৎ ১৫১০ খ্রীস্টাব্দ থেকেই এখানে শ্রীগৌর-সুন্দর ও শ্রীকৃষ্ণের অতি প্রাচীন এক বিরল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়ে অর্চিত হয়ে আসছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে শ্রীবিগ্রহটি অসমের শিলচরে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭১-১৯৭৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত এই মন্দিরে ঐ বিগ্রহের চিত্রপট অর্চিত হয়ে আসছিলেন। বর্তমান বিগ্রহটি ১৯৭৭ খ্রীস্টাব্দে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে অর্চিত হয়ে আসছেন। বর্তমানে শ্রীগৌর-সুন্দর ও শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহ মন্দিরের পাশাপাশি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মন্দিরে উপেন্দ্র মিশ্র ও শোভাদেবী, জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর বিগ্রহ ২০০৬ খ্রীস্টাব্দ এবং পঞ্চতত্ত্ব বিগ্রহ ২০০৭ খ্রীস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অদ্যাবধি সাড়ম্বরে সকল বিগ্রহ অর্চিত হয়ে আসছে। সুমিতা মাসি পুরো মন্দির ঘুরিয়ে দেখালেন। এ এক অন্য রকম অনুভূতি। সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের এক মিলন মেলা যেন। আমি বেশ কিছু ছবি তুললাম। সুমিতা মাসি বললো এবার চলো তোমাদের শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর দিদিমার বাড়িতে নিয়ে যাই। এর মধ্যে মহাপ্রভুর ভোগ নিবেদন হয়ে যাবে তখন প্রসাদ নিয়ে যেতে পারবে। মাসির কথা শুনে তো আমার জিভে জল আসার যোগাড়। গরম গরম খিচুড়ি আর লাবড়া ভাবতেই পেটের খিদা যেন আরও বেড়ে গেল। যাই হোক আমরা চৈতন্য দেবের দিদিমার বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। চারপাশে ঘন জঞ্জল সঙ্গে পুরনো দিনের ভগ্ন প্রায় তোরণ। আমরা সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে গেলাম। খুব সাবধানে পা বাড়ালাম আমরা বেশ কয়েকটা সিঁড়িই ভাঙ্গা। সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে দেখা পেলাম ভগ্ন প্রায় একটি বাড়ির এখনেই শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর দিদিমা থাকতেন। এখন যতœ হীন অবস্থায় পড়ে আছে। আমরা চার দিয়ে ঘুরে দেখলাম ছবি তুললাম। তবে ভেবে খারাপ লাগল অযতœ আর অবহেলায় এক ঐতিহাসিক স্থানকে আমরা হারাতে বসেছি। আমাদের ছবি তোলা শেষ হলে মাসি বলল চলো এবার প্রসাদ নিবে। আমি এই সময় টার অপেক্ষাই করছিলাম। আমাদের সবাই কে গরম গরম খিচুড়ি পরিবেশন করা হলো সঙ্গে লাবড়া। অসাধারণ স্বাদ পেট খালি ছিল তার জন্য ও হয়তো এমনটা হতে পারে। আহার পর্ব শেষ করে আমরা আমাদের ডেরা তে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি মাসি কাছে যেই বিদায় নেব তখন মাসি বললেন এবার ওনার বাসায় যেতে হবে। তার বাসা একদম কাছেই তার বাসায় না গেলে খুব কষ্ট পাবেন। মাও বলল চল মাসির বাসায় ঘুরে আসি না গেলে মন খারাপ করবে। আমরা সুমিতা মাসির বাসায় গেলাম সেখানে যাওয়ার পর আবার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছে মাসি। এবার চা, বিস্কিট, কেক আর মার প্রিয় পান দিয়ে। দেখতে দেখতে সূর্যদেবের বিদায়ের পালা চলে এলো আমরা সুমিতা মাসির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম শহর পানে। যাবেন কীভাবে দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে বাস/ট্রেন/বিমানযোগে প্রথমে আসতে হবে সিলেটে ভাড়া নেবে ২৫০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা। এর পর সিলেট শহরের কদমতলি বাস টার্মিনাল থেকে যেতে হবে সিলেটের গোলাপগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের মিশ্রপাড়া গ্রামে। এখানে ভাড়া নেবে ৫০ থেকে ১০০ টাকার ভেতর।
×