ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

সুস্থ মস্তিষ্ক ॥ বিস্মৃতি থেকে মুক্তি

প্রকাশিত: ০৭:০১, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

সুস্থ মস্তিষ্ক ॥ বিস্মৃতি থেকে মুক্তি

আমরা অনেক সময় একজনের নাম মনে করতে পারি না অনেক কথা বা শব্দ আমাদের জিভে আসে কিন্তু বলতে পারি না এর কারণ আমাদের মস্তিষ্কের মেমোরি ঠিকমতো কাজ না করা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমতে শুরু করে তাই কয়েকটি পদ্ধতি অবলম্বন করে আমরা আমাদের স্মৃতি শক্তিকে ধরে রাখতে পারি আর এই নিয়মগুলো মেনে চললে স্মৃতিলোপ থেকে আমরা আমাদের রক্ষা করতে পারি। নিচে এ রকম কিছু বিষয় আসুন জেনে নেয়া যাক যা আমাদের বিস্মৃতি থেকে মুক্তি দিয়ে ব্রেনটা তরতাজা রাখবে এবং অনেক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থেকেও আমরা নিরাপদ থাকব। হাঁটা প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটুন। হাঁটলে আমাদের পেশিকোষ শক্তিশালী হয় আর পেশিগুলো ঠিকমতো কাজ করলে তা মস্তিষ্ককেও চাঙ্গা রাখে। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির মেমোরি ডিজঅর্ডার প্রোগামের ডিরেক্টর আর স্কোট টার্নারের বলেন প্রতিদিন শারীরিক ব্যায়াম আমাদের দেখিয়েছে এটা সবচেয়ে ভালভাবে আমাদের স্মৃতি সংরক্ষণে ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। শারীরিক ব্যায়ামের সুফলগুলো হলো যে সমস্ত কারণে ব্যাপকভাবে আমাদের স্মৃতিলোপ পেতে পারে সেগুলো থেকে আমাদের সুরক্ষা দান করা; যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শরীরে উঁচু মাত্রার কোলেস্টেরল জমা হওয়া, অবিসিটি বা স্থূলতা রোগ এবং স্টোকের ঝুঁকি থেকে আমাদের শারীরিক ব্যায়াম নিরাপদ রাখে; আর যে ব্যাপারগুলো আমাদের মস্তিষ্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তা হ্রাস করে। ব্যায়াম শরীরে রক্ত চলাচল বাড়ায় ও মস্তিষ্ককে সচল রাখে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে ব্যায়াম ও শারীরিক ক্রিয়ার ফলে ইউঘঋ( ইৎধরহ-ফবৎরাবফ হবঁৎড়ঃৎড়ঢ়যরপ ভধপঃড়ৎ) নামে প্রোটিনের নিঃস্বরণ ঘটে যার ফলে ব্রেনের নার্ভগুলো আরও সুস্বাস্থ্য সম্পন্ন হয়। খাদ্যাভ্যাস গবফরঃবৎৎধহবধহ ফরবঃ বা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সমৃদ্ধ খাবার যেমন প্রচুর শাকসবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি ফলমূল, প্রচুর মাছ, বাদাম, শিম বীজ, অলিভ তেল মস্তিষ্কের ব্রেন সেল উৎপাদনে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে এছাড়া অল্প পরিমাণ মাংস খাওয়া এবং সঙ্গে ব্যায়াম আমাদের মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখবে। সমীক্ষায় দেখা গেছে সবজি জাতীয় খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখলে আমাদের ব্রেন ২০% বেশি কার্যক্ষম হয় ও চিন্তার ভারসাম্য থাকে। বেশি চর্বি, চিনি ও কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। এন্টি-অক্সিডেন্ট যুক্ত খাবার মস্তিষ্ককে সবল রাখে। তাই আমাদের খাবার তালিকায় এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার থাকতে হবে। বেগুনি, লাল, সবুজ ফলমূল শাকসবজিতে প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট থাকে। এন্টি-অক্সিডেন্টের মধ্যে আছে ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই ও বিটা- ক্যারোটিন। এসব আমরা পালংশাক, কপি, শিম ফলমূলের মাঝে কমলা, আপেল, আমলকী, জলপাই, পেয়ারা ইত্যাদি থেকে পেতে পারি। মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখুন শারীরিক পরিশ্রমের মতো মস্তিষ্কের পরিশ্রম বা ব্যায়াম আমাদের জন্য উপকারী বলেন ডিউক ইউনিভার্সিটির বার্ধক্য মনস্তত্ত্ববিষয়ক ডাক্তার মুস্তফা হুসেন। তিনি বলেন অবসরে কার্ড খেলা, লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়া, বন্ধুদের সঙ্গে প্রিয় খেলা দেখা, মোবাইলে বুদ্ধিদীপ্ত গেম খেলা অথবা মানসিকভাবে যে কোন চ্যালেঞ্জিং কর্ম আমাদের মস্তিষ্ককে সুস্থ ও তীক্ষè রাখে তা নিয়মিত করলে মস্তিষ্ক সুস্থ থাকবে। সমাজবান্ধব থাকুন বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলা, ফুটবল খেলা উপভোগ করা আপনাকে সামাজিকভাবে সক্রিয় রাখে যেটা আপনার মস্তিষ্কের জন্য ইতিবাচক। ডাক্তার টার্নার বলেন ‘যে ব্যক্তির যত বেশি সামাজিক যোগাযোগ আছে সে তত বেশি তার মানসিক ক্রিয়া ও স্মৃতি সংরক্ষণ করে।’ সামাজিক মেলামেশা আপনার মন ভাল রাখে তাই মস্তিষ্কের ওপর এটির ভাল প্রভাব আছে। অন্যদিকে ডাক্তার হুসেন বলেন ডিপ্রেশন বা অহেতুক দুচিন্তা আমাদের মাঝে স্মৃতিভ্রংশ রোগের সৃষ্টি করতে পারে। ঠিকমতো ঘুমান তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠা আপনার ব্রেনকে স্থিতিশীল রাখবে। ডাক্তার হুসেন ঘুমের ব্যাপারে কিছু টিপস দেন। তার মতে রাতে ঘুমানোর আগে একেবারে পেট পুড়ে খাওয়া ঠিক নয়; বিশেষ করে হাই প্রেশারের পেসেন্টদের জন্য। প্রতি রাতে একই সময় ঘুমাতে যাওয়া ও একই সময় ঘুম থেকে ওঠা ভাল অভ্যাস। ঘুমের আগে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাওয়া থেকে বিরত থাকুন এটা মস্তিষ্ককে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কফি, চা, মদ, ধূমপান, নিকোটিন বা এই জাতীয় খাবারগুলো ঘুমের আগে একেবারে পরিহার করুন। মানসিক চাপ এড়িয়ে যান যত বেশিই মানসিক চাপ থাকুক সেটিকে আপনার চিন্তার ওপর প্রভাব ফেলতে দেবেন না। স্ট্রেস আপনার ব্রেনের ওপর খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বেদনাকেও এড়িয়ে চলুন; যা হওয়ার হবেই আপনি মন দিয়ে যত চান তার কোন ব্যত্যয় ঘটাতে পারবেন না এটি ভেবে সব সময় নির্ভার থাকুন। স্ট্রেস হরমোনের অতিরিক্ত নিঃস্বরণ আপনার মস্তিষ্কের স্মৃতি কোষ থেকে তথ্য বের হতে বাধার সৃষ্টি করে। মেডিটেশন, ধ্যান, যোগ ব্যায়াম, শারীরিক ম্যাসাজ আপনার শরীরকেও যেমন সতেজ রাখবে মস্তিষ্কেও সচল রাখবে। সিগারেট পরিহার করুন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধূমপান মস্তিষ্কের জন্য বেশি ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। ডাক্তার টার্নারের মতে অন্য অভ্যাস দিয়ে ধূমপানের বদ অভ্যাসটি দূর করতে হবে। অন্য ওষুধ খেয়ে, নিকোটিনের বিকল্প কিছু দিয়ে বা পরামর্শের মাধ্যমে সিগারেটকে চিরদিনের জন্য বিদায় জানাতে হবে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান স্বাস্থ্যগত কারণেও আমাদের স্মৃতিলোপ পেতে পারে এর মাঝে ডায়াবেটিস, বিষাদগ্রস্ততা, থাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ, ভিটামিন স্বল্পতা, বেশি মাত্রায় ওষুধ গ্রহণ যেমন ঘুমের, হতাশা, উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কারণে, স্নায়ুবিক রোগের ওষুধ গ্রহণ আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিলোপ করতে পারে। তাই এ সমস্ত ওষুধ গ্রহণকারীদের এবং স্মৃতি সমস্যায় আক্রান্তদের মেডিকেল চেকআপ করাতে হবে। অযথা বা বেশি ওষুধ আমাদের লিভার, কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি সাধন করে। মস্তিষ্কের বুদ্ধি খাটান যখন আপনার প্রতিদিনকার জীবনে বিভিন্ন বিষয় মনে রাখবার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা হচ্ছে। ব্রেনের এই সমস্যা ব্রেন খাটিয়ে উৎরাতে হবে। কারও নাম মনে রাখতে কষ্ট হচ্ছে; কোন পড়া মনে রাখতে পারছেন না তখন আপনার চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই সমস্যা হতে পরিত্রাণের প্রচেষ্টা করতে হবে। ধরুন একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো তার নাম শিউলি আপনি মনে রাখলেন তার নাম ফুলের নামে কিন্তু পরেরদিন দেখা হওয়ার পর কোন ফুলের নামে তা মনে করতে পারলেন না ফুলটা কী তাই তাকে ভুল করে শেফালি নামে ডেকে ফেললেন। তাই এই ভুল এড়ানোর জন্য আপনাকে অন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে। আপনি শিউলি নাম শোনার পরে ফুলের সঙ্গে শিউলি গাছকে মনে মনে কল্পনা করে রাখলেন তাই পরবর্তীতে যখন তার সামনে আসবেন তার নাম ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। কোন নাম বা বিষয়ের সঙ্গে তার একটি ছবি বা কাঠামো মনে এঁকে নিন তাহলে ফুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। তাছাড়াও মোবাইল এ্যাপসে, নোটবুকে বা খাতায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো লিখে রাখুন। যেমন আপনার ওষুধ খাবার সঠিক সময় কোন জরুরী মিটিংয়ের সময় এগুলো লিখে রাখুন। তাই স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন যেমন আপনাকে সুস্থ রাখবে তেমনি আপনার ব্রেন সেলগুলোকে উজ্জীবিত করবে। মনে রাখবেন এমনকি ৮০-৯০ বছর পর্যন্ত আমাদের ব্রেন সেল তৈরি হয়। নিউরনগুলো শেষ বয়স অবধি বৃদ্ধি পায় যাকে নিউরোপ্লাস্টিসিটি বলে। আমাদের ব্রেনের হিপোক্যাম্পাস বা স্মৃতিকেন্দ্র যেহেতু মৃত্যুর আগ অবধি বাড়তে থাকে তাই ভাল খাবার, ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম আপনার মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছেÑ মাঝে মাঝে পাকস্থলীকে বিশ্রাম দিলে অর্থাৎ মাঝে মাঝে ক্ষুধা লাগলেও না খেয়ে থাকলে আমাদের হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় শরীরের রক্ত চলাচল বাড়িয়ে ব্রেনকে আরও কর্মক্ষম করে তোলে। বেশি কাজে জড়িয়ে পড়া, গুরুত্বহীন চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়া আপনার স্মৃতিস্তরে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে আপনার অহেতুক বিস্মৃতি ডেকে আনতে পারে। কোন সৃজনশীল কাজ হোক বই পড়া, প্রতিদিনকার ডায়েরি লেখা, হাতের ছোট কাজ, চারুকারু শিল্প, মজার কোন কাজে বা পরোপকারী কোন কাজে জড়িয়ে পড়লে আপনি অবাঞ্ছিত চিন্তা হতে মুক্তি পাবেন আর মস্তিষ্ক আপন গতিতে চলবে ও আপনার সার্বিক শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করবে। গান শোনা, গাওয়া, বাজনা বাজানো, বাগান করা, আঁকা, কুটির শিল্পজাত কিছু করা আপনার অজান্তেই আপনার ব্রেনের উত্তেজক হিসেবে কাজ করবে ও আপনি সুখী থাকবেন পরিণামে আপনি একটি সবল মস্তিষ্ককে অধিকারী হবেন যা সুন্দর জীবনযাপনের পূর্বশর্ত।
×