ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

গৃহকর্মী নির্যাতন ॥ দায়বদ্ধতা

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

গৃহকর্মী নির্যাতন ॥ দায়বদ্ধতা

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের নিরন্তর ধারায় সামনের দিকে ছুটে চলেছে। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বলয়ের নিরবচ্ছিন্ন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দায়বদ্ধতা যেভাবে সমৃদ্ধির বেগবান গতিপথকে এগিয়ে দেবে তেমনি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবন ও নিরাপদ, নিশ্চিন্ত এবং নির্বিঘœ হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ব্যক্তিগত সফলতা সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিতই করে না ছোট্ট পারিবারিক অঙ্গটিতেও পড়ে এর ইতিবাচক প্রভাব। পরিবারে আর্থিক সাফল্য শুধু ব্যক্তিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকে না তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে সংসারের সর্বত্রই। গৃহকর্তা এবং কর্ত্রীসহ তাদের সন্তানদের নিয়ে যে ছোট পারিবারিক আঙ্গিনা তৈরি হয় সেখানে আর্থিক সামর্থ বিভিন্ন কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। এক সময় মেয়েরা ঘরের গৃহাস্থলীর কাজকর্মী সামলাতে একেবারে সিদ্ধহস্ত ছিল। সামান্য-সহায্য সহযোগিতা পেলে সংসারের ছোট্ট প্রয়োজনটুকু মিটে যেত। কিন্তু সময় পাল্টেছে, যুগের হাওয়া সংসারকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেই শুধু নয় মেয়েদের পদচারণা সীমাবদ্ধ গ-ি থেকে বাইরের জগৎকেও স্পর্শ করেছে। সমাজের প্রয়োজনে মেয়েরা আজ শুধু গৃহকর্ত্রীই নয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও বটে। এতে আর্থিক স্বাচ্ছল্য যেমন আসে তেমনি পারিবারিক কিছু সমস্যাও নিভৃতে তৈরি হয়ে যায়। অর্থাৎ সাংসারিক কাজকর্ম নিয়ে বেহাল অবস্থায় পড়া। ফলে দরকার হয় বহিরাগত তৃতীয় কোন সদস্যের উপস্থিতি। শুধু তাই নয় প্রতিনিয়তই তার সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যা এক সময় গৃহকর্ত্রী নিজেই মিনিটে নিতে পারত। ফলে একটি সংসারে আগমণ ঘটে একজন গৃহকর্মীর যারা খাওয়া-পরাসহ মাসোহারার বিনিময়ে কোন পরিবারের যুক্ত হয়ে যায়। শ্রমই তার সবচাইতে প্রয়োজনীয় এবং আবশ্যিক শক্তি যা বিনিয়োগ করে সে যেমন অন্যের সংসারে কর্ম সংস্থান করে একইভাবে নিজের ভরণ-পোষণ ও উপার্জিত অর্থে চালিয়ে নেয়। শ্রম বাজারে শ্রমজীবীদের যে ধরণের চাহিদা এবং প্রয়োজন গৃহশ্রমে ও তেমন কোন ব্যতিক্রম চোখে পড়ার মতো নয়। নির্দিষ্ট সময় আর অর্থের বিনিময়ে যে শ্রম সে দেয় সেখানে তার প্রাপ্য কতখানি হয়ত বা সে নিজেও জানে না। যেভাবে কৃষি এবং কারখানার শ্রমিকরাও তাদের অর্থমূল্য ভাবতে ও পারে না। মালিক যা ঠিক করে সেটাই নির্ধারিত এবং আইনগত। ফলে অত্যাচার, শাসন, শোষণ বলতে যা বুঝায় গৃহশ্রমেও তারথেকে আলাদা কিছু হয় না। তাই প্রতিনিয়তই এই গৃহকর্মীদের ওপর নিগ্রহের ঘটনা সব সময়ই জনসমপেক্ষ উঠে আসে। আর এই গৃহশ্রমিকদের সিংহভাগ নারী এবং শিশু। সংসারের দায়-দায়িত্ব গৃহকর্তার হাতে থাকলেও গৃহকর্মীর সিংহভাগ কর্তব্য এসে পড়ে গৃহকত্রীর ওপর। শ্রম বিনিয়োগের মাত্রার সঙ্গে অত্যাচারের পরিমান যখন দুঃসহ অবস্থায় গিয়ে ঠেকে তখনই গৃহকর্মীর ওপর শোষণ-নিপীড়নের ক্ষত স্পষ্ট হতে থাকে। যে গৃহকত্রী তার প্রতিমুহূর্তের সাহায্যকারী ছাড়া নড়তে পারেন না তিনিই এক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে চড়াও হন তার সহযোগীর ওপর। সামান্য কারণে, অতি তুচ্ছ ঘটনার রেশ ধরে অসহায় শিশু কিংবা বিশোরীর ওপর যেভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয় তা অমানবিক নৃশংসতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। সভ্যতার এমন বিকাশমান যুগে বন্য দশার মতো গৃহকর্মীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে জীবন চলার নিশানা হতে পারে না। এমনও দেখা যায় গৃহকর্মীর সময়সী সন্তানও থাকে অনেক সংসারে। নিজের সন্তানের মানসিক গড়নও তো বিপন্ন হয় এ ধরণের পাশবিক দৃশ্য অবলোকন করে। গৃহকর্ত্রী কি নিজেই সুস্থ থাকে এমন অসুস্থ কার্যকলাপ করে। সংবাদ মাধ্যমে গৃহকর্মীরা তাদের বক্তব্য উল্লেখ করে বলতে থাকে, গায়ে গরম পানি ঢেলে দেয়া, গরম খুন্তি দিয়ে ছেঁক দেয়া, মারধর করা খেতে না দেয়া-এই ধরণের অস্বাভাবিক কর্মকা- কোন বিবেকবান, স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সম্ভব কিনা বলা মুশকিল। বাস্তবে সেটাই ঘটে। এক সময় সবার সামনে তা দৃশ্যমান হয়। আসামিদের খুঁজে বের করা হয়। হাজতবাসও করতে হয় কিছুদিন। কিন্তু এক সময় বিচারের ফাঁক ফোকর দিয়ে তারা বেরও হয়ে আসনে। শাস্তির কাঠগড়া অবধি যেতে হয় না। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরণের অমানুষিক বীভৎসতাকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। প্রতিটি মানুষ স্বাধীনচেতা। সে তার স্বাধীনতা এবং অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। অন্যের স্বাধীনতা হরণ করে নিজেকে মুক্ত স্বাধীনতভাবার মধ্যে কোন গৌরব কিংবা কৃতিত্ব নেই। সুতরাং গৃহশ্রমিক যদি তার পছন্দের না হয় তাহলে তাকে বাদ দেয়াই শ্রেয়। তকে জোরজবরদস্তি রেখে দিয়ে তার থেকে অমানবিক উপায়ে তার মূল্যবান শ্রম আদায় করার কোন অধিকার গৃহকর্তা এবং কত্রীর থাকতে পারে না। আন্তর্জাকি শ্রমক আইন তা বরদাস্তও করে না। সুতরাং তাদেরকে দিয়ে প্রয়োজনীয় সমস্ত সুযোগ-সুবিধা আদায় করে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করা সভ্য মানুষের পর্যায়েই পড়ে না। সব মানুষের উচিত নিজের সঙ্গে সঙ্গে অন্যকেও তার সমস্ত মানবিক সম্মান এবং মর্যাদা দেয়া। এক সময়ের ঐতিহ্যিক একান্নবর্তী পরিবারের গৃহে নিয়োজিত কোন শ্রমিকের মর্যাদা ছিল মানবিক মূল্যবোধে বাধা। বড়রা তাদের সমীহ করতেন ছোটরা করত সম্মান। যে মর্যাদায় তারা নিজেদেরকে পরিবারেরই একজন মনে করতে সঙ্কোচ বোধ করত না। গৃহকর্তা আজীবন তাদের ভরণ-পোষণের ভার নিতেন। বৃদ্ধ বয়সে অকর্মণ্য কিংবা অক্ষম হয়ে গেলেও গৃহকর্তা তাদের সম্মান দিয়ে চিরদিনের মতো বাড়িতে রেখে দিতেন। সন্তানরা এসব গৃহকর্মীকে বাবা-মায়ের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত হতো না। পারিবারিক ভাবেও সে শিক্ষাই দেয়া হতো। শ্রম-নির্ভর আর্থ-সামাজিক কাঠামো সমাজ ব্যবস্থার রদ-বদল করেই ক্ষান্ত হয়নি শান্ত, স্নিগ্ধ গৃহকোণটিকেও অমানবিক কলুষতায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। এখন থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদা দেয়া তো দূরের কথা সন্তানের কাছেও নিজেদের মান-সম্মান কতদিন টিকে থাকবে তাভাবার ও সময় এসে গেছে। কারণ মানবিক শিক্ষাগুলো মানুষ পায় পরিবার থেকে।
×