ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন প্রান্তিক মানুষের কথাকার শওকত আলী

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

চলে গেলেন প্রান্তিক মানুষের কথাকার শওকত আলী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সাহিত্যের আশ্রয়ে তিনি বলেছেন প্রান্তিক মানুষের কথা। আবহমান বাংলার লোকজীবনের চিত্রায়নে লিখেছেন প্রদোষে প্রাকৃতজন নামের কালজয়ী উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের চেতনাকে নিপুণ দক্ষতায় মেলে ধরেছেন কথাসাহিত্যে। অনবদ্য লেখনীতে শিশুসাহিত্যেও সৃষ্টি করেছেন প্রাণের প্রবাহ। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ভূমিকা রেখেছেন ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে। বৃহস্পতিবার থেমে গেল সমাজমনস্ক সেই কথাশিল্পী শওকত আলীর প্রাণের স্পন্দন। এদিন সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একুশে পদকজয়ী এই কথাসাহিত্যিকের প্রস্থান ঘটে। সকাল সোয়া আটটায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। সমাজতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী এ লেখকের বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। রেখে গেছেন তিন ছেলে আরিফ শওকত পল্লব, আসিফ শওকত কল্লোল, গালিব শওকতসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও শুভাকাক্সক্ষী। শওকত আলীর মৃত্যুতে দেশের সাহিত্য ভুবনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। মানুষ ও সমাজের কথা বলা এ কথাশিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান এবং বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। বৃহস্পতিবার বেলা ৩টার পর সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনে কথাশিল্পীর শবদেহ নেয়া হয় ভাষাশহিদদের স্মৃতির স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এখানে বাংলাদেশ লেখক শিবির আয়োজিত শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব শেষে বাদ আসর টিকাটুলি জামে মসজিদে শওকত আলীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী জুরাইন কবরস্থানে স্ত্রী শওকত আরার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। এর আগে সকালে বিএসএমএমইউ থেকে শওকত আলীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর বাসস্থান টিকুটুিলর কে এম দাস লেনের ‘বিরতি ভিলা’য়। এখানেই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন প্রান্তিক মানুষের কথা বলা এ সাহিত্যিক। কথাশিল্পীর শবদেহ সেখানে নেওয়ার পর নেমে আসে বিষাদের ছায়া। প্রিয় মানুষটিকে শেষ দেখায় অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ে পরিবারের আপনজনদের নয়ন থেকে। স্বজনের আহাজারিতে সৃষ্টি হয় শোকার্ত পরিবেশ। আর স্বজনদের পাশাপাশি কথাশিল্পীকে ভালবাসা জানাতে হাজির হয়েছিলেন প্রতিবেশীরাও। শওকত আলীর পারিবারিক সূত্র জানায়, অসুস্থতার কারণে গত ৪ জানুয়ারি থেকে তিনি ল্যাব এইড হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। সে অবস্থায় দুইবার হার্ট ফেইলিওর হলে ৬ জানুয়ারি ভোর থেকে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। এরপর গত ১৬ জানুয়ারি তাঁকে বিএসএমএমইউতে স্থানান্তর করা হয়। বুধবার রাত থেকেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া আটটায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সংক্রমণের পাশাপাশি হৃদরোগ, কিডনিজনিত সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। বেলা ৩টার পর সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনে শওকত আলীর শবদেহ নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। মরদেহ রাখা হয় মিনারের উল্টোদিকের গগন শিরীষ বৃক্ষতলে। এখানে বাংলাদেশ লেখক শিবিরের তত্ত্বাবধানে নিবেদন করা হয় ফুলেল ভালবাসায় আবৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি। শওকত আলীকে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানান ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, নাট্যজন মামুনুর রশীদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, কমরেড টিপু বিশ্বাস, গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর, চলচ্চিত্র নির্মাতা মানজারে হাসীন মুরাদ প্রমুখ। গোলাম কুদ্দুছের নেতৃত্বে শুরুতেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, পাহাড়ি ছাত্র সংসদ, বিশ্ব সাহিত্য ভবন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, ছাত্র মৈত্রী, স্বভূমি লেখক শিল্পী কেন্দ্র, নাট্যদল বটতলা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, বাংলা একাডেমি, দৈনিক সমকাল প্রমুখ। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পালন করা হয় এক মিনিটের নীরবতা। এছাড়া শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ লেখক শিবিরের পক্ষ থেকে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি শওকত আলীর স্মরণসভার আয়োজন করা হবে। পিতা হিসেবে শওকত আলীকে মূল্যায়ন করে ছেলে আসিফ শওকত কল্লোল বলেন, কথাসাহিত্যিক পরিচয়ের বাইরে সংসারের জীবনে অন্যরকম এক মানুষ। আর এ সংসারের বন্ধনটিকে সব সময় আগলে রাখতে চেয়েছেন। পরিবারের বাইরে অন্য কোথাও খুব একটা আড্ডাও দিতেন না। সেই সূত্রে বাবাকে দেখেছি একজন আদর্শিক মানুষ হিসেবে। কখনো নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে দেখিনি। শওকত আলীর মূল্যায়ন করে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কথাসাহিত্যে প্রান্তিক মানুষের জীবন পরিবর্তনের কথা বলে গেছেন তিনি। তার সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে সেই পরিবর্তনটি নিজস্ব ভাষারীতিতে উপস্থাপন করে গেছেন। দার্শনিক অবস্থান থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বিদ্যমান অস্থির অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে জীবনকে আরও স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে হবে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, নিজস্ব পরিম-লে, নিজস্ব শৈলীতে তিনি সারাজীবনভর গণমানুষের কথা বলেছেন। সেটি তাকে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, প্রগতিশীল ও স্বচ্ছ দৃষ্টির এক লেখক ছিলেন শওকত আলী। একদিকে সাহিত্যে তুলে ধরেছেন সামাজিক অবক্ষয়কে। অন্যদিকে আবার মেলে ধরেছেন সমাজের চলমান অন্যায় ও মানুষের ওপর চলা উৎপীড়নের কথা। এভাবে সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে মূলত তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন সংগ্রামী চেতনা। আর যা কিছু লিখেছেন সবকিছুতেই ছিল উৎকর্ষ। আমার বিবেচনায় তিনি হচ্ছেন এ কালের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তার গল্প উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে সামাজিক অবিচার, অন্যায়ের কথা ফুটে উঠেছে। এসেছে গণমানুষের কথা। কথাশিল্পীর জীবনকথা ॥ শওকত আলী বাংলা কথাসাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় নাম। তৃণমূলের মানুষের জীবনকে সাহিত্যে তুলে আনা এ কথাশিল্পী বাংলা উপন্যাসে নিয়ে আসেন বৈচিত্র্যের স্বাদ। ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভূগোল, তৃণমূল মানুষের জীবন, মধ্যবিত্ত, দেশভাগ, প্রেম- সবকিছুই তিনি তুলে এনেছিলেন সুচারুভাবে। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ তার কালজয়ী উপন্যাস। উপন্যাস ছাড়াও লিখেছেন ছোটগল্প, প্রবন্ধ, বাচ্চাদের জন্য গল্প-উপন্যাস। শওকত আলী ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আলী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। খোরশেদ আলী সরকার ও সালেমা খাতুন দম্পতির তিনি তৃতীয় সন্তান। তার বাবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হন। ১৯৬১ সালে তিনি বিয়ে করেন তৎকালীন ইডেন কলেজের ছাত্রী শওকত আরাকে। তিনি ১৯৯৬ সালে মারা যান। এ দম্পতির তিন ছেলে; তারা হলেন- ডা. আরিফ শওকত পল্লব, আসিফ শওকত কল্লোল ও গালিব শওকত শুভ। শওকত আলী সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন। বীরগঞ্জ হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের চাকরি দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু। এর পর তিনি ঠাকুরগাঁও কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৩ সালে সরকারী সঙ্গীত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিজের কর্মজীবন শেষ করেন। তিনি বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ারের সম্পাদক পদেও চাকরি করেন। ছাত্র থাকাকালীন সাংবাদিকতা করেছেন ‘মিল্লাত’, সিকান্দার আবু জাফরের মাসিক ‘সমকাল’ এবং সাপ্তাহিক ‘মিঠেকড়ায়’। অবসর গ্রহণের পর থেকেই তিনি রাজধানীর টিকাটুলীতে নিজ বাসভবনে নিভৃত জীবনযাপন করেন। উইলিয়াম কেরি প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুরের মিশনারি স্কুলে শওকত আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পরে রায়গঞ্জ করনেশন হাই স্কুল থেকে ১৯৫১ সালে মেট্রিকুলেশন, ১৯৫২ সালে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ¯œাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। কলেজ জীবন থেকেই শওকত আলী কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত থাকার কারণে ১৯৫৪ সালে কারাগারে যান। স্কুলজীবন থেকে লেখালেখির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে শওকত আলীর। দেশভাগের পর কলকাতার বামপন্থীদের পত্রিকা ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। এরপর দৈনিক ‘মিল্লাত’, মাসিক ‘সমকাল’, ‘ইত্তেফাক’-এ তার অনেক গল্প, কবিতা এবং বাচ্চাদের জন্য লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’ প্রকাশিত হয়। তার ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস। তুর্কিদের আক্রমণ ও সেন রাজাদের সময়ে বঙ্গদেশের প্রাকৃতজনদের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এ উপন্যাসে। তার ত্রয়ী উপন্যাস ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কাল¯্রােত’ এবং ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’-ও ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পান। তার লেখা অন্যান্য জনপ্রিয় উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘ওয়ারিশ’, ‘অপেক্ষা’, ‘গন্তব্যে অতঃপর’, ‘উত্তরের খেপ’, ‘অবশেষে প্রপাত’, ‘জননী ও জাতিকা’, ‘জোড় বিজোড়’ ইত্যাদি। ২০০০ সালে ‘উত্তরের খেপ’ উপন্যাস অবলম্বনে শাহজাহান চৌধুরীর পরিচালনায় একই নামে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান চিত্রনায়িকা চম্পা। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিশুসাহিত্যের মধ্যে রয়েছে ‘টুনকু নামে হাতি’, ‘নীল পাহাড়ের গান’, ‘ভিতরগড়ের তিন মূর্তি’ এবং ‘তিন বন্ধু ও প্রাচীন রাজবাড়ি’। এই কথাশিল্পীর আলোচিত ছোটগল্প গ্রন্থ হলো ‘উন্মূল বাসনা’, ‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’, ও ‘বাবা আপনে যান’। কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন শওকত আলী। ১৯৬৮ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। এছাড়া ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবির কর্তৃক হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার।
×