ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার উঁচু ভবনগুলোতে বসছে শক্তিশালী মুভি ও সিসি ক্যামেরা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

ঢাকার উঁচু ভবনগুলোতে বসছে শক্তিশালী মুভি ও সিসি ক্যামেরা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সভা সমাবেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বন্ধে ঢাকার উঁচু ভবনগুলোতে স্থায়ীভাবে শক্তিশালী মুভি ক্যামেরা স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা বসানোর কথা রয়েছে। এসব ক্যামেরা অপরাধী, অপরাধে ব্যবহৃত যানবাহন, সন্দেহজনক বস্তু শনাক্তসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হবে। পুলিশের কর্মকাণ্ড ও মনিটরিং করা যাবে এসব ক্যামেরা দিয়ে। ঢাকায় সরেজমিন এ জাতীয় উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়টি যাচাইবাছাই করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, পুরো ঢাকা নিয়ন্ত্রণ করতে প্রায় ৪৯ হাজার ক্যামেরার প্রয়োজন। প্রথম দফায় ষোলো হাজার ক্যামেরা বসানোর প্রক্রিয়া চলছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে আরও জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে প্রথম ঢাকাকে নিরাপদ শহর ও যানজটমুক্ত শহর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই অংশ হিসেবে পুলিশের কন্ট্রোলরুম আধুনিক করার কাজ শুরু হয়। কন্ট্রোলরুম শাহবাগ থেকে সরিয়ে সচিবালয়ের সামনে নবাব আব্দুল গণি রোডে স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশ পুলিশকে আধুনিক করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রেলওয়ে, সরকারী পরিবহন পুল ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পাঁচ একর জায়গা কন্ট্রোলরুম স্থাপনের জন্য বরাদ্দ দেন। সেখানে ওই সময়ই ১৪তলা আধুনিক ভবন নির্মাণের অনুমোদনসহ অর্থ বরাদ্দ করেন। ১৪তলা ভবনের নক্সা অনুযায়ী ফাউন্ডেশন দিয়ে কাজ শুরু হয়। পুলিশ সদর দফতরের উন্নয়ন শাখার একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতা নিলে পুরো চিত্র পাল্টে যায়। কন্ট্রোলরুম স্থাপনের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে ১৪তলা ফাউন্ডেশনের ওপর ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা হয়। নিরাপদ শহর গড়ার পরিকল্পনার নামে শুরু হয় হাস্যকর কারবার। ঢাকাকে নিরাপদ শহর হিসেবে গড়ে তুলতে লাগানো হয় মাত্র ১৫৫টি সিসি ক্যামেরা। যা পরবর্তীতে অচল হয়ে যায়। ওই কর্মকর্তা বলেন, তারই ফলশ্রুতিতে খোদ ঢাকায় ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের মতো স্মরণকালের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে চালানো ওই গ্রেনেড হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন আওয়ামী লীগের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও গাজীপুরে সমাবেশে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা, সিলেটে সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে আওয়ামী লীগ নেতা ও অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যা, রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলাসহ অন্তত শ’খানেক হামলার ঘটনা ঘটে। প্রাণ হারান অনেকেই। বহুজন চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলছেন, ওই প্রকল্প যদি চলমান থাকত, এসব ভবনের আশপাশে মুভি ক্যামেরা বা সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকলে অনেক আগেই এসব ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব ছিল। হয় তো এসব হামলার ঘটনা নাও ঘটতে পারত। ঘটার আগেই হামলাকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হতো। আর হামলার পরেও হামলাকারীদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এত বেগ পেতে হতো না। এসব নেপথ্যের অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার আদ্যোপান্ত রহস্য আজও উদঘাটিত হয়নি। অনেকেই তদন্তের দীর্ঘসূত্রতা ও আসামি গ্রেফতার না হওয়াসহ নানা কারণে এখনও আড়ালেই রয়ে গেছে। আজও যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থেকেও, নানা বাধা বিপত্তি ও আইনের মারপ্যাঁচের কারণে গ্রেফতারের বাইরে রয়েছে, তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হতো। এত নেতাকর্মীর প্রাণহানির ঘটনাটিও না ঘটতে পারত। পুলিশ সদর দফতরের একজন উর্ধতন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা না প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে এজন্যই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যদি ঘটেও যায়, তাহলে অপরাধীদের যাতে দ্রুত গ্রেফতার করা সম্ভব হয়, এজন্যই এমন উদ্যোগ। সবাইকে নিরাপত্তা দেয়াই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য। এরমধ্যে রাজনীতিবিদদের নিরাপত্তা দেয়া আরও জরুরী। কারণ তারাই দেশ পরিচালনা করবেন। দেশে সুস্থ গণতন্ত্রের চর্চার জন্য বা গণতন্ত্র প্রকৃত চর্চা বহাল রাখতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অতীতের মতো আর যাতে রাজনৈতিক হত্যাকা-ের ঘটনা না ঘটে, পুলিশকেও যাতে আর রাজনৈতিক হত্যাকা-ের ঘটনার তদন্তে বেগ পেতে না হয়, এজন্যই এমন প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের উন্নয়ন বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। গত ২৩ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকে পুরনো এই প্রকল্পটি নতুন করে চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের নাম রাখা হয়েছে ভেডেলপমেন্ট অব ঢাকা সিটি ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন প্রকল্প থেকে সরে গেলেও তারা প্রকল্পের সব ধরনের সহায়তা পাবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স, এ্যাপ্লাইড ফিজিক্স, বিটিসিএল (বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সাইন্স এ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রযুক্তি বিশারদদের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করা হয়েছে। পুরো ঢাকা সার্ভে করে ৪৯ হাজার সিসি ও মুভি ক্যামেরা লাগানোর প্রয়োজনীয়তার কথা জানানো হয়েছে। প্রথম দফায় ১৬ হাজার ক্যামেরা বসানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদর দফতরের ডেভেলপমেন্ট শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ মোশারফ হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, এসব ক্যামেরা যুক্ত থাকবে অপটিক্যাল ফাইবারের সঙ্গে। ক্যামেরাগুলো যানজট নিরসনে আগাম সঙ্কেত, পুলিশের সুনির্দিষ্ট অবস্থান, সন্দেহজনক বস্তু, ব্যক্তি শনাক্তকরণে আগাম সঙ্কেত দেবে। পাশাপাশি জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ নম্বরে আসা ফোন নম্বরগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চাহিদা মোতাবেক সেই সেলে চলে যাবে। বিভিন্ন জেলা থেকেও মানুষ জরুরী জাতীয় সেবায় ফোন করেন। এসব ফোন তাৎক্ষণিকভাবে জেলা পুলিশ, এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ও ফায়ার সার্ভিসের কাছে চলে যাবে। অপরাধে ব্যবহৃত গাড়ি ও অপরাধী শনাক্তে সঙ্কেত দেবে, যানবাহনের নম্বরপ্লেট শনাক্ত করা, ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের শনাক্ত করা, কোন সড়কে কত গাড়ি রয়েছে, সে সম্পর্কে আগাম বার্তা দেবে। পুলিশের প্রতিটি শাখার সঙ্গে যুক্ত থাকবে এই সিস্টেমটি। ফলে কে কি কাজ করছে, তা কন্ট্রোলরুম থেকে দেখা যাবে। গুগল ম্যাপ একটি জায়গা সম্পর্কে ধারণা দেয়। তবে জায়গাটির অবস্থান কোথায় সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। এসব সিসি ও মুভি ক্যামেরায় যুক্ত থাকবে পুলিশ গ্লোবাল ইনফরমেশন সিস্টেম। যা কোন জায়গা বা বস্তু সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেবে। ফলে কোন ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে সেই জায়গায় চলে যেতে পারবে। এক্ষেত্রে কোন পুলিশ সদস্যের জায়গাটি কোথায় বা কিভাবে যাবে সে সম্পর্কে আগাম ধারণা না থাকলেও তেমন কোন সমস্যা হবে না। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের উন্নয়ন শাখার অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকায় দুই কোটির বেশি মানুষের বসবাস। সশরীরে উপস্থিত থেকে এত মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তত ২ থেকে ৩ লাখ পুলিশের প্রয়োজন। দেশের বাস্তবতায় তা সম্ভব নয়। এজন্য প্রযুক্তির কোন বিকল্প নেই। হালে অপরাধের ধরনও পরিবর্তন হয়েছে। অপরাধীরা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এজন্য প্রযুক্তি ছাড়া অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা প্রায় অসম্ভব। ঢাকাকে নিরাপদ শহর হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সরকারের নেয়া সুদূরপ্রসারী দূরদর্শী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা জরুরী। তাহলে হয়তো একুশে আগস্টের মতো ঘটনা নাও ঘটতে পারত। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে, যানজট নিরসন, অপরাধে ব্যবহৃত গাড়ি ও অপরাধীদের শনাক্তসহ পুলিশকে আরও জবাবদিহিতার মধ্যে আনতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ঢাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে ১৬ হাজার ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব ক্যামেরায় যুক্ত থাকবে উন্নত সব প্রযুক্তি। সিসি ক্যামেরা ছাড়াও মুভি ক্যামেরাও বসানো হবে উঁচু ভবনগুলোতে। তবে কোন কোন ভবনে এসব ক্যামেরা বসানো হবে, তা নিরাপত্তার স্বার্থে সবাইকে জানানো হবে না। তারই অংশ হিসেবে ছয়তলা কন্ট্রোলরুম ১৪তলা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভবন নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যেই টেন্ডারের কাজ শেষ হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই আধুনিক ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে। ১৪তলা ফাউন্ডেশনের ওপর নির্মিত ছয়তলা ভবনের ওপরই হবে বাকি আট তলা। প্রযুক্তির এই সুবিধা যুগ যুগ ধরে দেশবাসী পাবেন।
×