ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এখনও চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এখনও চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে

হাসিব রহমান, ভোলা থেকে ॥ ভোলার বাংলাবাজারে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংগ্রহ ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষণাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্বাধীনতা জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার প্রতিষ্ঠা করা এই স্বাধীনতা জাদুঘর বৃহস্পতিবার দুপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এরপর তিনি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। ভোলা সদর উপজেলার শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে মুক্তিযুদ্ধের ভোলার ঐতিহাসিক স্থান বাংলাজারের বাণিজ্যমন্ত্রীর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত ফাতেমা খানম কমপ্লেক্সে ৩ বছর আগে এই নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তখন এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আমাদের স্বাধীনতা অর্জন ও শত বছরের ইতিহাসের ধারাবাহিকতার দুর্লভ সব নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। জাদুঘরের তিনটি তলাতেই রয়েছে এর বিন্যাস। জাদুঘরের স্বপ্নদ্রষ্টা ঊনসত্তরের গণঅভুত্থানের মহনায়ক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এমন একটি জাদুঘর নির্মাণের স্বপ্ন ছিল তার দীর্ঘদিনের। এদিকে জাদুঘর উদ্বোধন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির আগমনের খবরে বাংলা বাজারে ভোলা সদর, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, লালমোহনসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দলে দলে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ছুটে। এ সময় বাংলা বাজার এলাকায় সাধারণ মানুষের মাঝে উৎসব আমেজ দেখা দেয়। অনেকে রাষ্ট্রপতিকে এক নজর দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে। এদিকে এর আগে সকালে রাষ্ট্রপতি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা কুকরি মুকরি ইকোপার্কের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। জাদুঘর উদ্বোধনের পর দুপুরে ভোলা বাংলা বাজার ফাতেমা খানম ডিগ্রী কলেজ মাঠে সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি বলেন, মাত্র এক মাস আগে আমরা ৪৭তম বিজয় দিবস উদযাপন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এখনও তাদের চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে। সুযোগ পেলেই ষড়যন্ত্রকারীরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করতে উঠেপড়ে লাগে।অতীতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র এ দেশে ইতিহাস বিকৃতির চর্চা শুরু করে যা এখনও অব্যাহত আছে। মিথ্যা বেশি দিন চাপা থাকে না। মিথ্যার ওপর সবসময়ই সত্যের জয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ভোলার কৃতী সন্তান বরণ্য রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ স্বাধীনতা জাদুঘর স্থাপন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার জন্য বাণিজ্যমন্ত্রীকে তিনি অভিনন্দন জানান। তিনি আরও বলেন, ডিজটাল বাংলাদেশ আজ আর কল্পনা নয়। তা বাস্তব। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ আগামীতে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যআয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে। তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ আর কল্পনা নয়। তা বাস্তব। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ আগামীতে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, ভোলা আরও এগিয়ে যাবে। এখানে উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। এখানে গ্যাস আছে। তেল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভোলা সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর পারভিন আকতারের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ভোলা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল, সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন, সংসদ সদস্য রেজায়ান আহমেদ তৈফিক। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজকে সম্পন্ন করা জন্য দায়িত্ব ভার গ্রহণ করে আজ বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। তিনি আরও বলেন, ভোলায় অনেক গ্যাস পাওয়া গেছে। আরও ৩টা কূপ খনন করা হবে। আরও অনেক গ্যাস পাব। ভোলায় অনেক শিল্পকলকারখানা হবে। ভোলায় নদী ভাঙ্গন রোধে তিনিসহ আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, আলী আজম মুকুলসহ ৪ জন মিলে প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। ভোলা-বরিশাল ব্রিজ হবে। ভোলার ভবিষ্যত উজ্জ্বল। মন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্রপতিকে অনেক ভালবাসে। আপনি আদর্শবান ন্যায়বান। আপনি অন্যায়ের কাছে মাথানত করেন না সত্যের পথে কাজ করে চলেছেন। এদিকে স্বাধীনতা জাদুঘরে তিনটি গ্যালারি রয়েছে। প্রথম তলার গ্যালারিতে এক পাশে ইতিহাস ঐতিহ্য, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ৪৭ এ দেশ ভাগ ও ভাষা আন্দোলনের দুর্লভ ছবি ও তথ্য রয়েছে। অপর পাশে রয়েছে লাইব্রেরি ও গবেষণাগার। এছাড়া ওই একই তলায় রয়েছে মাল্টিমিডিয়া ডিসপ্লে হল রুম। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ইতিহাসের মুহূর্তগুলোর চিত্রকল্প। তৃতীয় তলায় রয়েছে যুক্তফ্রন্ট, ’৫৮-এর আন্দোলন, পাকিস্তানের সামরিক শাসন, ’৬৬-এর আন্দোলন, ’৬৯-এর গণআন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন, ৭ মার্চের ভাষণ, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগের দুর্লভ আলোকচিত্র। এছাড়া রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সকল ভাষণের অডিও ও ভিডিও ডিজিটাল প্রদর্শনী। দর্শনার্থীরা ডিজিটাল টাচস্কিন ব্যবহার করে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ও তথ্য জানতে পারবেন; এমন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। ভোলার বাংলাবাজার এলাকাটিও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বহন করে চলেছে। ১৯৭১ সালের ২৩ অক্টোবর এই বাংলাবাজারে তিন দিক থেকে পাক-বাহিনী হামলা চালায়। ওইদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ হয় এখানে। পাক-বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধাসহ স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষকে। বাজারে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বাংলাবাজর খালের পাশে তিন শতাধিক মানুষের লাশ পড়েছিল। ওই বধ্যভূমি এখন ইতিহাসের কালের সাক্ষী। এ জাদুঘরে দেশ-বিদেশের ইতিহাসবিদরা গবেষণা করতে পারবেন। এটি একদিকে যেমনি গবেষণাগার, অপরদিকে ডিজিটাল ডিসপ্লেতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা-অন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা দেখতে ও জানতে পারবে নতুন প্রজন্ম। তুলে ধরা হয়েছে বাঙালীর লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। রাষ্ট্রপতি ২ দিনের সফরে বুধবার দুপুরে হেলিকপ্টার যোগে চরফ্যাশনে আসেন। ওই দিন তিনি জ্যাকব টাওয়ার উদ্বোধন শেষে কুকরি-মুকরিতে রাত্রিযাপন করেন। ২ দিনে সফর শেষে বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি ঢাকার উদ্দেশে ভোলা ত্যাগ করেন। রিক্সায় রাষ্ট্রপতি ॥ এ আর এম মামুন, চরফ্যাশন থেকে জানান, রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বৃহস্পতিবার রিক্সায় চড়ে ভোলার চরফ্যাশনের চরকুকরি-মুকরির মেঠো পথে গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। এ সময় রিক্সায় তার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। রাষ্ট্রপতির রিক্সার চালক ছিলেন চরকুকরি-মুকরি ৬ নং ওয়ার্ডের মোহাম্মদ আলীর ছেলে বাবুল। রাষ্ট্রপতির রিক্সায় চড়ে গ্রাম পরিদর্শনের দৃশ্য দূর থেকে এলাকাবাসী উপভোগ করেন। রাষ্ট্রপতি বুধবার বিকেলে চরকুকরি-মুকরি পৌঁছে হেঁটে কোস্টাল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কাম রেস্ট হাউসে যান। রাতে ওই রেস্ট হাউসে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সপরিবারের উপভোগ করেন এবং রাত্রিযাপন করেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, বৃক্ষ রোপণ ও কুকরি-মুকরি পর্যটন কেন্দ্র ও ইকোপার্কের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন শেষে রিক্সায় চড়ে মেঠো পথে গ্রাম ঘুরে পরিদর্শন শেষে হেলিকপ্টারে চড়ে বাংলা বাজার মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের উদ্বোধন ও ফাতেমা খানম কলেজ মাঠে সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। চরফ্যাশনে ইকোপার্কের যাত্রা শুরু ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় ভোলার চরফ্যাশনের কুকরি-মুকরি ইকোপার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ইকোপার্কের ভিত্তিপ্রস্তরের মধ্য দিয়ে সাগরপাড়ের পর্যটনক্ষেত্রে নতুন মাত্রার সূচনা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আগমনকে কেন্দ্র করে সাগরের ঢেউ আঁছড়ে পড়া কুকরি-মুকরি ছিল বর্ণিল সাজে সজ্জিত। উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল দ্বীপের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। ইকোপার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সাংসদ পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। কিশোরগঞ্জ ৫ আসনের সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন, কুকরি-মুকরি ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসেম মহাজন ও রাষ্ট্রপতির সফর সঙ্গীরা। এর আগে রাষ্ট্রপতি বৃক্ষরোপণ ও দরিদ্রদের মাঝে কম্বল বিতরণ করেন। কুকরি-মুকরিতে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা ম্যানগ্রোভ বাগান, সাগরের ঢেউ আঁছড়ে পড়া বিস্তৃত সৈকত, হরিণ- বানরসহ নানান প্রজাতির বন্যপ্রাণীর কিচির মিচির, শিয়ালের হাঁক, শীতের অতিথি পাখির কলকাকলী পর্যটকদের আকর্ষণ করছে এই দ্বীপ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর কুকরি-মুকরি সফর করেন এবং কুকরি-মুকরির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দ্বীপটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। জাতির জনকের স্বপ্নের পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার সেই সুদূরপ্রসারী চিন্তার ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য যাত্রা শুরু করল কুকরি-মুকরি ইকোপার্ক।
×