ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অসহায় কিশোরী মায়ের আর্তনাদ- ‘এ সন্তানের কী হবে’

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

অসহায় কিশোরী মায়ের আর্তনাদ- ‘এ সন্তানের কী হবে’

নীতিশ চন্দ্র বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ ॥ রেশমা তার সদ্যোজাত কন্যা-সন্তানকে নিয়ে এখন গোপালগঞ্জ আড়াই’শ বেড জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিভাগের পোস্ট অপারেটিভ-৩ নং বেডে চিকিৎসাধীন। গৃহকত্রীর বাড়িতে দিনের পর দিন আটকা অবস্থায় ধর্ষণের শিকারে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গত ১০ জানুয়ারি সে হাসপাতালে ভর্তি হয়। রবিবার দুপুরে হাসপাতালের গাইনি বিভাগের অধীনে তার সিজার হয় এবং সে ওই কন্যা-সন্তানের জন্ম দেয়। হাসপাতালের বিছানায় অসুস্থ রেশমা আর্তনাদের সুরে শুধু এটুকুই বলেছে - ‘আমি এখন কী করব? আমার এ সন্তানেরই বা কী হবে? বিচার চাই আমি’। হাসপাতালে আসার আগেই রেশমা (১৯) কথা বলে মিডিয়ার সামনে এবং জানায়, সে ফরিদপুর জেলার সালতা উপজেলার কামাইদা গ্রামের দরিদ্র শফি মাতুব্বরের মেয়ে। তিন বছর আগে তাকে গৃহপরিচারিকার কাজে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার এসআই কামরুল ইসলাম। তার একমাত্র সন্তান আলীফ হোসেনকে দেখাশোনা আর ঘরের কাজকর্ম করে ভালই কাটছিল রেশমার দিনগুলো। এভাবে বছর দেড়েক যেতেই ঢাকার কাঁচপুর ব্রিজের কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন গৃহকর্তা এসআই কামরুল ইসলাম। মাসখানেক পর, কামরুল ইসলামের স্ত্রী সেতু বেগম তার সন্তান আলীফ ও গৃহপরিচারিকা রেশমাকে নিয়ে এসে আশ্রয় নেয় গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পুখরিয়া গ্রামে তার নানা ইয়ার আলী মোল্লার বাড়িতে বাবা-মার সংসারে। সেখানে বসবাসের একপর্যায়ে উচ্চাভিলাষী সেতু নিজেই শুরু করে বেপরোয়া জীবন-যাপন। ভর্তি হয় মহিলা কলেজে আর সেইসঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে কতিপয় যুবকের সঙ্গে, যারা রাত-বিরাতে যাওয়া-আসা করত ওই বাড়িতে। সেতু জড়িয়ে পড়ে দেহ-ব্যবসায়; সখ্যতা গড়ে নেয় পুলিশের সঙ্গেও। এরইমাঝে চর পুখরিয়ার ইট-বালু ব্যবসায়ী সেলিমের সঙ্গে রাত কাটানোর জন্য রেশমাকে প্রস্তাব দেয় সেতু। রেশমাকে রাজী করাতে নানাভাবে ফুসলিয়ে বিয়েসহ টাকা-পয়সার লোভও দেখায় সে। কিন্তু সে প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় রেশমার উপর নেমে আসে মারধরসহ নির্যাতনের খর্গ। ক’দিন মার খেয়ে একসময় সইতে না পেরে রাজী হয়ে যায় রেশমা। গতবছর ৪ মার্চ রাতে সেতুর সহযোগিতায় ওই বাড়িরই একটি কক্ষে আটকে রেখে রেশমাকে ধর্ষণ করে সেলিম। এভাবে সপ্তাহখানেকের বেশি প্রতি রাতেই সেলিম তাকে ধর্ষণ করে বলে জানায় রেশমা। রেশমা আরও জানায়, এরই একপর্যায়ে দেশে আসেন সেতুর বাবা সৌদি-প্রবাসী মিরাজ দাড়িয়া। সেতুর মা জেসমিন বেগম তখন অসুস্থতার জন্য গোপালগঞ্জ আড়াই’শ বেড জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি থাকার কারণে সেতু তার মাকে দেখাশোনার জন্য থাকছিল হাসপাতালে। সেই ফাঁকে বাড়িতে রেশমাকে একা পেয়ে সেতুর বাবা মিরাজ দাড়িয়াও পর পর দু’রাত ধর্ষণ করে। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে রেশমা। বেশ কিছুদিন পর বিষয়টি জানাজানি হলে সেতু তাকে নিয়ে যায় গোপালগঞ্জ মাতৃমঙ্গলে। আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে জানা যায় সে ৬ মাসের গর্ভবতী। সেতু বাচ্চাটাকে নষ্ট করার জন্য অনেক চেষ্টা করলেও সেখানকার ডাক্তার লিভারে সমস্যা দেখিয়ে রেশমার অপারেশন করেনি। এরপর সেতু তার পুলিশ-বন্ধু গোপালগঞ্জ থানার এসআই হায়াতুর রহমানের (বর্তমানে কোটালীপাড়া থানায়) পরামর্শে রেশমার বাবা শফি মাতব্বরের নামে ৩’শ টাকার স্ট্যাম্প কিনে রেশমাকে দিয়ে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে নেয় এবং রেশমার বাবাকে খবর দিয়ে এনে গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইন মোড়ে গিয়ে তাকে তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে ভিডিও করে রাখে। হায়াতুর ছাড়াও মামুন, সাইফুল ও তন্ময়সহ বেশ কয়েকজন দারোগার সঙ্গে সেতুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে জানায় রেশমা। যদিও এসআই হায়াতুর রহমান সাংবাদিকদের কাছে সেতুর বাড়িতে দু’দিন গিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, সেতুর বাড়ির সন্নিকটে অন্য একটি ব্যাপারে তদন্ত করতে গিয়েছিলেন। তখন কাজের ফাঁকে তিনি অল্প সময়ের জন্য সেতুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। পরে কোন কূল-কিনারা না পেয়ে সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে ২৬ দিন পর রেশমা আবারও ফিরে আসে গৃহকত্রী সেতুর কাছে। কিন্তু সেতু তাকে বাড়িতে উঠতে না দিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। একপর্যায়ে সেতুর চাচাত মামা লিপন মোল্লা রেশমাকে ক্ষণিককালের জন্য প্রতিবেশী দুবাই প্রবাসী হারুন মোল্লার বাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে যায়। ওই বাড়িতে আশ্রয় পাওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত রেশমা সেখানেই অবস্থান করে। এরইমধ্যে রেশমা এ ব্যাপারে গোপালগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে ধর্ষক সেলিম (৩৫) ও মিরাজ দাড়িয়া (৪৫) এবং ধর্ষণে সহায়তাকারী গৃহকত্রী সেতু বেগমের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। আশ্রয়দাতাদের বাড়ির ছেলে ইয়াসিনও নিয়মিত প্রতিবেশী সেতুর বাড়িতে যাতায়াত করত এবং সে সুযোগে ইয়াসিনও রেশমার সঙ্গে বহুবার শারীরিক-সম্পর্ক করেছে। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বার বিষয়টি জানাজানি হলে অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াসিন তড়িঘড়ি সৌদি আরব চলে যায়। অবশেষে রবিবার রেশমা জন্ম দেয় কন্যা-সন্তান; যার এখনও মেলেনি পিতৃ-পরিচয়। হাসপাতালের বেডে রেশমা তার সদ্যজাত কন্যা-সন্তানকে জড়িয়ে ধরে শুধু এটুকুই বলে, এরপর আমি কোথায় যাব, কোথায় গিয়ে উঠব, কিছুই বুঝতে পারছি না। এ সমাজে আমার ঠাঁই না হলে আমার সন্তানেরই বা কী হবে? সুষ্ঠু বিচার চাই আমি, সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই। এদিকে, সেতু ও সেতুর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বাড়িতে গিয়েও তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি। সেতুর মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সেলিম শেখের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করে বলেছেন, এসব মিথ্যা। আমার অনেক শত্রু আছে, তারা আমার বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র করছে। আর ইয়াসিনের মা জেসমিন বেগম অভিযোগ করে বলেছেন, সেতু ও সেলিম পুলিশের সঙ্গে হাত করে আমার ছেলেকে ফাঁসাতে চাইছে। রেশমার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সাইফুল দারোগা হাসপাতালে এসেছিল। তারা রেশমাকে দিয়ে এখন এসব বলাচ্ছে।
×