ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শীতকালে জমজমাট ব্যবসা হয় সারাদেশে

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮

শীতকালে জমজমাট ব্যবসা হয় সারাদেশে

বুঝলাম না, এবার শীতবস্ত্রের ব্যবসার ওপর ভাল কোন স্টোরি পেলাম না। আমি জানতে চেয়েছিলাম শীতকালে শীতবস্ত্রের ব্যবসার পরিমাণ কত? ঈদের সময় মিডিয়া ব্যবসার ওপর অনেক স্টোরি করে। দুই ঈদের সময় তাই হয়। পূজার সময় আলাদা করে স্টোরি খুব কম হয়। এবার শীতেও তাই দেখছি। স্টোরি দেখা যায় শীতের কষ্টের। সাধারণ মানুষ শীতে কষ্ট করে, অনেক গরিব মানুষ মারা যায়, তার ওপর খবর হয়। এসব খবর সাধারণভাবে উত্তরাঞ্চলের। এবারও গরিব মানুষ শীতের কষ্টে মারা গেছে বলে খবরে পড়েছি। শীতের কষ্ট অবশ্য শুধু উত্তরাঞ্চলে নয়, এবার শীতের কষ্ট সর্বত্র। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এমন জমকালো শীত কেউ দেখেনি। বস্তুত শীতের আফসোস এবার অনেকেরই কেটেছে। অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল, শীত গেল কোথায়? শীত নয়, বরং আজকাল সকল ঋতু সম্পর্কেই এমন প্রশ্ন। ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। দুই মাসে এক ঋতু। দেখা যাচ্ছে এখন শীতকাল কেন বর্ষাকালও নেই। বাকি কালের মধ্যে অন্যগুলো আছে কী নেই সে সম্পর্কে মানুষ বেশি ভাবিত নয়। বর্ষাকালে বৃষ্টি না দেখে, শীতকালে শীত না পেয়ে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম আবহাওয়া-জলবায়ু ও পরিবেশ বদলাচ্ছে। তারই প্রতিফলন ঋতু পরিবর্তনে। এবার এর ব্যতিক্রম ঘটল। এবার বৃষ্টিও বেশি হয়েছে, আর শীত তো বটেই। বলা যায় কড়া শীত, প্রলম্বিত শীত। তাই মানুষের কষ্ট বেড়েছে। কষ্টের মধ্যেই যে ব্যবসা হয় এটাও তার একটা দিক। শীতের শুধু কষ্টের দিক নয়, ব্যবসারও দিক আছে, সাংস্কৃতিক দিক আছে, পর্যটনের দিক আছে, আছে ফসলের দিক। অতএব, শীতকালকে অনুধাবন করতে হলে এসবও বিবেচনায় আনতে হবে। আমি বেশি উৎসাহী অর্থনীতির দিকে, ব্যবসার দিকে। এ কারণেই শীতের ব্যবসার ওপর স্টোরি খুঁজি। কিন্তু পাই না। তবে দৃশ্যত অনেক কিছুই বোঝা যায়। পুরান ঢাকার ইসলামপুর, সদরঘাট এবং লক্ষ্মীবাজার শীতবস্ত্রের ব্যবসায় জমজমাট। বস্তুত এসব অঞ্চল এখন শুধু শীতবস্ত্রের ব্যবসার কারণে জমজমাট নয়, জমজমাট আরেকটি কারণেও। এই শীতকালেই বাংলাবাজার অঞ্চলে চলে আরেক জমজমাট ব্যবসা- বইয়ের ব্যবসা। নতুন বছরে সরকার কয়েক কোটি বই বিতরণ করেছে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। এটা এক বড় উৎসব। বাংলাবাজার অঞ্চলে গেলে এর উত্তাপ উপলব্ধি করা যায়। কাগজ, বাইন্ডিং, প্রুফ রিডিংয়ের ব্যবসা এখন। ব্যস্ততা শুধু সরকারী বই বিতরণের জন্য নয়। সামনে ফেব্রুয়ারি মাস। এখন বই ব্যবসার পিক পিরিয়ড। বাংলাবাজার অঞ্চলে চলাচলের কোন ব্যবস্থা নেই। গাড়ি ভর্তি বই, কাগজ, রং, কালি ইত্যাদি। রিক্সা, ভ্যানগাড়ির ঠেলাঠেলি ইত্যাদি। এরই মাঝে চলছে শীতবস্ত্রের ব্যবসা- কম্বল, ফুল-হাফ সোয়েটার, জাম্পার, মাফলার, মাথার টুপি, মেয়েদের সোয়েটার, গরম জুতা, হাতের মোজা, পায়ের মোজা, ফুল গেঞ্জি ইত্যাদি। বিচিত্র সব গরম কাপড়, তথা শীতবস্ত্র। এর মধ্যে দেশী ও বিদেশী সবই আছে। দাম? দামে বলব, বড়ই সস্তা। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, এমনকি গরিবরা অনেক শীতবস্ত্র কিনতে পারে। স্বাধীন বাংলাদেশে এই একটা কাজ হয়েছে। আমার মনে আছে, ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর আমরা পুরনো জামা, কোট, কম্বল, সোয়েটার কিনতাম। ভীষণ অভাব ছিল গরম কাপড়ের। পুরনো কাপড়ই ছিল ভরসা। সদ্য স্বাধীন দেশ। লোকের এত টাকাও নেই, শীতবস্ত্রও তত পাওয়া যায় না। তখনও গরম কাপড় তৈরির কারখানা গড়ে ওঠেনি। বহুলোকের গায়ে পুরনো কাপড়ও ছিল না। গেঞ্জি পরা লোকেরও ছিল অভাব। পায়ে স্যান্ডেল, সেও খুব কম লোকেরই। সেই তুলনায় এখনকার অবস্থা দিন-রাত তফাত। মানুষের পায়ে স্যান্ডেল আছে। গায়ে জামা-কাপড়-গেঞ্জি আছে। এখন শীতকালে শীতবস্ত্রহীন লোক রাস্তাঘাটেও পাওয়া বিরল। একজন রিক্সাওয়ালা দিনে যে রোজগার করে তা দিয়ে সে শীতবস্ত্র অনায়াসে কিনতে পারে। ঈশ্বরের কি ইচ্ছা ১০০-১৫০ টাকায় একটা পাতলা কম্বল আজকাল পাওয়া যায়। যে কেউ ‘বঙ্গবাজারে’ গেলে কাপড়ের দাম কত, শীত বস্ত্রের দাম কত তা আজকাল অনুমান করতে পারবেন। বঙ্গবাজার থেকে গুলিস্তান, গুলিস্তানের দক্ষিণে নবাবপুর রোড পর্যন্ত, উত্তর দিকে জেনারেল পোস্ট অফিস (জিপিও) পর্যন্ত, তারপর বায়তুল মোকাররমসহ সবটাই বলা যায় কাপড়ের বাজার। এখন যেহেতু শীত, তাই শীতবস্ত্রই প্রধান। বায়তুল মোকাররম থেকে মতিঝিল, সাবেক ‘ডিআইটি’ বা রাজউক ভবন, এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত বিশাল বিস্তৃত বাজার। ওইদিন অতি উত্তম একটা ফুল সাদা গেঞ্জি কিনলাম। দাম কত যানেন? মাত্র ৭০ টাকা। ভাবতেই পারিনি এত কম দামে এত পছন্দের একটা গেঞ্জি পাওয়া যাবে। সুতি শার্টের পিস ২৫০-৩০০ টাকা। সেলাই ৩০০-৪০০ টাকা। ৬০০-৭০০ টাকায় উত্তম একটা ফুল শার্ট যা ব্র্যান্ডের কাপড় হলে লাগত ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। এই ব্যবসা এখন সারাদেশে। রমরমা ব্যবসা। প্রশ্ন কত টাকার ব্যবসা? এর জন্য আমার কোন হিসাব নেই। হিসাব নেই আরেকটি ব্যবসার, যা এই শীতকালেই হয়। আমরা জানি ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানিসহ বহু কোম্পানির বছর শেষ হয় ডিসেম্বরে। কারণ তারা সরকারের অর্থবছর অনুসরণ করে না। সরকারের বছর জুলাই-জুন। এদের বছর জানুয়ারি-ডিসেম্বর। এরা লাখ লাখ ক্যালেন্ডার করে, ডায়েরি করে। নানা রকমের উপহার সামগ্রী করে। এই উপলক্ষে ঢাকার প্রেস থাকে ব্যবসায় জমজমাট। কাগজের ব্যবসা, রঙের ব্যবসা, প্যাকিং কাগজের ব্যবসা, প্রেসের ব্যবসা- সবকিছুর দারুণ রমরমা ব্যবসা চলে অক্টোবর থেকে বলা যায় ডিসেম্বর পর্যন্ত। একেক ব্যাংকেরই বাজেট থাকে এসবে ৫০ লাখ, ৬০ লাখ- এক কোটি টাকা। কারও কারও বাজেট আরও বেশি। শিল্পীরা কাজ পান এবং কাজ পান কপি রাইটারসহ বিভিন্ন শ্রেণীর লোক। বায়তুল মোকাররম গেলে ব্যাংকের এসব ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, উপহার সামগ্রী কিনতে পাওয়া যায়। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৮ সালের একটা ক্যালেন্ডার কিনলাম মাত্র ৫০ টাকায়। এর চেয়ে সস্তা আর কী হতে পারে! এই খাতে ঢাকায় কত ব্যবসা হয় তার কী কোন হিসাব কারও কাছে আছে? মনে হয় না। ব্যবসাটা শুধু মতিঝিল এবং পুরান ঢাকায় সীমাবদ্ধ নয়। ঢাকা এখন ১৯৭০ সালের ঢাকা নয়। এটা এখন বিশাল এক শহর। বুড়িগঙ্গার তীরের সদরঘাট থেকে উত্তরে গাজীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত এই শহর। শহর অবশ্য উত্তর দিকেই বাড়ছে। লোকসংখ্যা কত? কমপক্ষে দেড়-দুই কোটি। এর অর্থ শীতবস্ত্রের বাজার, বইয়ের বাজার, ক্যালেন্ডারের বাজার আজ বিশাল এবং এটা বিস্তৃত পুরো শহরেই। হাজার হাজার, লাখ লাখ লোক এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থেকে সংসার চালাচ্ছে। আমরা ধারণাও করিনি এসব খাত অর্থনীতিতে যোগ হবে। অথচ ‘জিডিপি’তে এসব খাতের অবদানও কম নয়। শীতকালে পর্যটন ব্যবসাও জমজমাট। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কোন গন্তব্যের টিকেট পাওয়া যায় না। কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সিলেট, জয়ন্তিয়া পাহাড়, কুয়াকাটা, উত্তরবঙ্গ- এর কোথাও যাওয়ার কোন উপায় নেই। রেলের টিকেট নেই। প্লেনের টিকেট নেই। ঢাকাবাসী মধ্যবিত্ত, অনেক ক্ষেত্রে শিকড়হীন মধ্যবিত্ত স্কুল ছুটিকালীন বেড়াতে যেতে চায়। আগে ক্ষণিকের ‘পিকনিকের’ দাম ছিল বেশি। এখন মধ্যবিত্ত ‘পিকনিকে’ খুব বেশি সন্তুষ্ট নয়। সে যেতে চায় কয়েকদিনের জন্য ঢাকার বাইরে। যাদের গ্রামে বাবা-মা থাকেন তারা গ্রামে যান। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হয়। পিঠা-পুলি খাওয়া হয়। ছেলেমেয়েরা গ্রামাঞ্চল দেখতে পারে। ‘ধান গাছ দিয়ে যে তক্তা’ হয় না সেটা সরেজমিন দেখে তারা বুঝতে পারে। যারা পারে তারা আজকাল বিদেশ যায়। না পারলে অন্তত প্রতিবেশী দেশে যায়। যায় ভারত, নেপাল, ভুটান, সিকিম ইত্যাদি অঞ্চলে। সেখানেও একই অবস্থা। হোটেলে সিট পাওয়া যায় না। রেল অথবা বিমানের টিকেট পাওয়া যায় না। পেতে হলে ভাড়া গুনতে হয় দেড় গুণ-দ্বিগুণ। তারপরও দিল্লী, আগ্রা, মথুরা, কাশ্মীর, আজমীর শরীফ, কলকাতা, দার্জিলিং, পুরী ইত্যাদি অঞ্চলে বস্তুত বাঙালী এখন পর্যটক হচ্ছে। সবই আয়ের ব্যাপার। রোজগার ভাল হলেই মানুষ বেড়াতে চায়। তাই এখন হচ্ছে। প্রতি মাসে একমাত্র ভারতে যায় লক্ষাধিক মানুষ। বাংলাদেশ ব্যাংকও এখন উদার। ১৯৭২ সালে ১০-২০ ডলারের জন্যও তাদের অনুমতি লাগত। এখন ৫০০০ ডলার এ্যানডোর্সমেন্ট করেই নেয়া যায় সঙ্গে। তার ওপর আছে আরেক বিধান। যে কেউ ৫০০০ ডলার নিয়ে বাংলাদেশে ঘোষণা ব্যতিরেকে ঢুকতে পারে এবং সেই ডলার নিয়ে বিদেশে যেতে পারে। ডলারের কোন অভাব নেই। এমতাবস্থায় যাদেরই সঞ্চয় আছে তারা এখন বেড়াতে পারে। বেড়ানোর জায়গাও এখন অনেক। শুনেছি শ্রীমঙ্গলেও এমন হোটেল হয়েছে যার ভাড়া দৈনিক ৫-৭ হাজার টাকা। এর পরেও যারা দেশের উন্নতি হয়নি বলতে চায় তাদের আর কী প্রশ্ন করা যায়? পর্যটন শিল্প এখন একটা বড় শিল্প এবং তা সম্ভাবনাময়। এর ব্যবসা বাড়ানোর জন্য সরকারের পদক্ষেপ কী তা কিন্তু সবিশেষ জানা যাচ্ছে না। শীতকালের ব্যবসার মধ্যে আছে কুলের ব্যবসা, পিঠা-পুলির চালের ব্যবসা, তাজা শাক-সবজির ব্যবসা, মাছের ব্যবসা। এখনই হাঁস খাওয়ার সময়, নানা রকমের পাখি খাওয়ার সময়। এই সময়েই গ্রামাঞ্চলে মেলা বসে, সার্কাস আসে, যাত্রা-থিয়েটারের আয়োজন হয়, হয় নাটক ইত্যাদি। স্কুল-কলেজে শীতকালে হয় খেলাধুলার উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নবান্ন তো চিরায়ত অনুষ্ঠান। মাছ মারার উৎসব সিলেটে হয় প্রতি বছর। বৃহত্তর ময়মনসিংহেও তাই। সব মিলে শীতকাল বাংলার অর্থনীতির জন্য এক সম্ভাবনাময় ঋতু। জানি না এর ওপর ‘মিডিয়া’ এত কৃপণ কেন? কৃপণ কিন্তু কবি-সাহিত্যিকরাও। শীতের ওপর কয়টা কবিতা আমরা পড়েছি? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×