ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিটলসের ভারত সফরের ৫০ বছর

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮

বিটলসের ভারত সফরের ৫০ বছর

জার্মানির হামবুর্গ শহরের একটি পাবে সঙ্গীত পরিবেশনার দায়িত্ব পায় ইংল্যান্ডের লিভারপুল শহরের চার তরুণের এক সঙ্গীতগোষ্ঠী। তখন কেউ ভাবতে পারেনি যে এই সঙ্গীতগোষ্ঠীই একদিন পপ সঙ্গীত জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করবে। কিংবদন্তি শিল্পগোষ্ঠী ‘দ্য বিটলস’এর যাত্রা শুরু বলা যায় এই হামবুর্গ শহরে, ১৯৬০ সালে। আর সেই চার তরুণ ছিলেন জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি, জর্জ হ্যারিসন এবং ড্রামবাদক পিট বেস্ট। হামবুর্গের এই পাবে অতিথিদের চিত্তবিনোদনের জন্য প্রতি সন্ধ্যায় অন্যদের গানের সঙ্গে তাদের নিজস্ব সঙ্গীত পরিবেশন করতেন ‘দ্য বিটলস’। সে সময়, এবং পরবর্তীকালেও জার্মান ভাষায় বেশকিছু হিট গান গেয়েছেন তাঁরা। যেমন, ‘শি লিবট ডিশ ‘বা শি লাভস ইউ’ গানটি। এরপর ১৯৬১ সালে, ‘হামবুর্গে বিটলস’এর প্রথম রেকর্ড ‘মাই বনি’ বের হয়। কিন্তু বিটলস নামে নয়। সে সময়ের বিখ্যাত ব্রিটিশ রক এ্যান্ড রোল সঙ্গীতশিল্পী টনি শেরিডেনের বাদকদল ‘দ্য বিট ব্রাদার্স’ হিসেবে। এই গান জার্মান চার্টস বা হিট গানের তালিকায় পাঁচ নম্বরে উঠে আসে। ওই বছরই লন্ডনের সঙ্গীত ব্যবসায়ী ব্রায়ান এপস্টাইন বিটলসের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পিট বেস্টের জায়গায় যোগ দেন ড্রামবাদক রিংগো স্টার। সঙ্গীতপ্রযোজক জর্জ মার্টিনের উদ্যোগে ৬২ সালে বের হয় ‘লাভ মি ডু’ এ্যালবাম। এই বছর থেকেই বিটলসের খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপজুড়ে। ১৯৬৪ সালে আমেরিকা সফরের পর সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বিটলসম্যানিয়া। ৬৭ সালে তাঁরা ভারত সফর করেন। এই সময় জন লেনন ও জর্জ হ্যারিসন পণ্ডিত রবি শঙ্করের কাছে সেতারে তালিম নেন। ১৯৭০ সালে এই কিংবদন্তি শিল্পগোষ্ঠী ভেঙ্গে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধারায় অসংখ্য সঙ্গীতে সুরারোপ করেছেন লেনন ও ম্যাককার্টনি। যখন বিটলস ব্যান্ড খুব অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তাদের পথ ঘুরিয়ে দিয়েছিল ভারত সফর। সেই সফরের ৫০ বছর হতে যাচ্ছে এই ফেব্রুারিতে। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে একদল বন্ধু-স্বজন নিয়ে লন্ডন থেকে ভারতের হৃষিকেশে আসেন বিটলসের ছোকরা চতুষ্টয়। হৃষিকেশে তাঁরা এসেছিলেন একটি আশ্রমে আধ্যাত্মিক এক সফরে। সেই আশ্রম আজ ৫০ বছর পর পাচ্ছে নতুন রূপ। লম্বা সময় ধরে পরিত্যক্ত থাকার পর এখন তা হয়ে উঠেছে বিটলস-ভক্তদের তীর্থস্থান। ভবিষ্যতে পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেখানে শিগগিরই বিটলস ব্যান্ড ও এর সদস্যদের নিয়ে একটি জাদুঘর খোলার। তাঁরা মহাঋষি মহেশ যোগীর শিষ্য হয়ে আধ্যাত্মিক যোগের শিক্ষা নিতে এসেছিলেন চৌরাশি কুটিয়া আশ্রমে। বিশাল দলে বিটলসের চার সদস্য, তাঁদের স্ত্রী ও প্রেমিকা, ব্যবস্থাপক, সহকারী, শব্দ প্রকৌশলী, কয়েকজন সাংবাদিকসহ ছিলেন ব্রিটিশ ও মার্কিন কয়েকজন চলচ্চিত্রব্যক্তিত্বও। একদম তরুণ বয়সেই দারুণ খ্যাতি পাওয়ায় বিভ্রান্ত জর্জ হ্যারিসন, জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি ও রিংগো স্টার খুঁজছিলেন জীবনের সঠিক দিক নির্দেশনা। তখনই তাঁদের পরিচয় হয় ভারতীয় আধ্যাত্মিক গুরু“মহাঋষি মহেশ যোগীর সঙ্গে। ছোকরা চতুষ্টয় এতই প্রভাবিত হন যোগীর কথায় যে, তাঁর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা নিতে হিমালয়ের কোলঘেঁষা হৃষিকেশ পর্যন্ত ছুটে আসেন তাঁরা। রিংগো স্টার সেই আশ্রমে ছিলেন ১০ দিন, পল ম্যাককার্টনি এক মাস আর জন ও জর্জ হ্যারিসন আশ্রমে ছিলেন ছয় সপ্তাহ। বিটলসের সঙ্গীতযাত্রায় এই ভারত সফর অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কারণ, এই সফরে দলটি প্রায় ৩০টি নতুন গান বেঁধেছিল, যার বেশির ভাগই জায়গা করে নেয় বিটলসের হোয়াইট এ্যালবামে। ভারত সফরে কে কয়টি গান লিখেছেন, এ হিসাব এক সাক্ষাতকারে দিয়েছিলেন জন লেনন। বলেছিলেন, ‘পল ডজনখানেক গান লিখেছে। জর্জ লিখেছে ৬টি আর আমি ১৫টি।’ কথিত আছে, বিটলসের সদস্যরা এলএসডি মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই আধ্যাত্মিক সফর তাঁদের সেই আসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনে। তবে আধ্যাত্মিক সফরের মাঝপথেই মহাঋষিকে জড়িয়ে কিছু বিতর্ক ছড়ায় গণমাধ্যমে। এর ফলে বেশ নাটকীয়ভাবেই হৃষিকেশ থেকে লন্ডনে ফিরে যান জন লেনন ও জর্জ হ্যারিসন। তবে এই যাত্রায় নাকি ভারতীয় মসলা ও ঝাল খাবারের ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন রিংগো স্টার। বিটলসের সেই সফরের পর মহাঋষির হৃষিকেশের আশ্রমটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে মারা যান মহাঋষি মহেশ যোগী। এরপর তাঁর ওই আশ্রমে কোন লোকসমাগমই ছিল না। ১৪ একরের ওই বিশাল আশ্রম হয়ে পড়ে জনশূন্য। তবে বিটলস ব্যান্ডের পাগল কিছু ভক্ত জনশূন্য সেই আশ্রমকে ‘বিটলস আশ্রম’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে তোলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিটলস-ভক্তরা সেই পরিত্যক্ত আশ্রমে গিয়ে জীর্ণ দেয়ালে এঁকেছেন অনেক রঙিন দেয়ালচিত্র (গ্রাফিতি)। কোনটায় লেখা বিটলসের জনপ্রিয় গানের পঙ্ক্ত, কোনটায় আবার শান্তির বার্তা।
×