ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

থমকেছে কিন্তু থামেনি

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮

থমকেছে কিন্তু থামেনি

আনন্দকণ্ঠ : পথ পরিক্রমার প্রথম পর্বের কথা যদি মনে পড়ে। রামেন্দু মজুমদার : সেসব তো কতদিনের আগেকার কথা। মননে মুনীর চৌধুরীর আধুনিক নাট্য ভাবনার পরিচর্চার তাড়না। কর্মবীর জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর কা-ারির ভূমিকা। নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা আবদুল্লাহ আল-মামুনের অসম্ভব প্রাণ শক্তির স্ফুরণ। অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের নবতরঙ্গের উন্মাদনা। আর আমার, সকলের ইচ্ছা বুঝে লক্ষ্য নির্ধারণে নিমগ্নতা। আমরা সকলেই বুঝে ছিলাম, ১৯৯০ তে দাঁড়িয়ে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নাট্যশিক্ষার কোন প্রতিষ্ঠান নেই। অথচ বিভিন্ন দলে অসংখ্য নাট্যকর্মী নাটকটা করছে এবং দলে কাজ করতে প্রত্যাশী বহু ছেলে মেয়ে দলে যোগদানে অপেক্ষমাণ আছে। আমরা মনে করলাম নাটক রচনা, দৃশ্যসজ্জা পরিকল্পনা, আলোক পরিকল্পনা, অভিনয় উপস্থাপনা, নির্দেশনা, রূপসজ্জা, নাটকে সঙ্গীতের ব্যবহার অর্থাৎ স্ক্রিপ্ট থেকে প্রোডাকশন পর্যন্ত নাট্য প্রযোজনার একটা প্রাথমিক ধারণা ছেলেমেয়েদের দেয়া প্রয়োজন। আমরা দেশ-বিদেশের নাট্যচর্চার তৎকালীন প্রবণতার আলোকে বিশ্বাস করলাম, ভাল নাটক করতে হলে নাটক সম্পর্কে জানা দরকার এবং সেজন্য লেখা-পড়াটা দরকার। নাটকের তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকবে আবার ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাও থাকবে। এই সকল ভাবনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই ১৯৯০ সালের ২৪ আগস্ট আমরা প্রতিষ্ঠা করি থিয়েটার স্কুল। আনন্দকণ্ঠ : স্কুল তো হলো কিন্তু কি পড়ানো হবে তা কিভাবে নির্ধারিত হলো! রামেন্দু মজুমদার : আমাদের নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা আবদুল্লাহ আল মামুন দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা ও কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস পর্যালোচনা করে আমাদের উপযোগী করে এক বছরের একটা পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করেন। সে পাঠ্যক্রমে ব্যবহারিক ও তত্ত্বীয় উভয় বিষয় ছিল এবং আজও আছে। প্রথমদিকে সপ্তাহে বৃহস্পতি-শুক্রবার মিলিয়ে দুদিন ধরে তিন তিন মোট ছয় ঘণ্টার ক্লাস হতো। ২০০৮ সালে থিয়েটার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা উপাধ্যক্ষ আবদুল্লাহ আল-মামুনের প্রয়াণের পর তার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সে বছর থেকেই আমরা আমাদের থিয়েটার স্কুলের নামের সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত করি। ফলে আমাদের থিয়েটার স্কুল এক রূপ থেকে রূপান্তরিত হয়ে নতুন রূপে, আবদুল্লাহ আল-মামুন থিয়েটার স্কুল। আনন্দকণ্ঠ : এই যে থিয়েটার স্কুল থেকে আবদুল্লাহ আল-মামুন থিয়েটার স্কুল হয়ে আজ অতিবাহিত ২৭ বছরের দীর্ঘ পথ চলা। এই চলার পথে বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানদের ভূমিকাকে কিভাবে দেখেন। রামেন্দু মজুমদার : থিয়েটার স্কুল চলাবার পথে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা অর্থের স্বল্পতা। ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে যে টাকাটা পাই তা দিয়ে খুব বেশিদিন চলা সম্ভব না। ফলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আমাদের পাশে সহৃদয় সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। যেমন এক সময় আমেরিকান একটি প্রতিষ্ঠান ফোর্ড ফাউন্ডেশন যারা কিনা সংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখে তারা বছর তিনেকের জন্য আমাদের কিছু অনুদান দিয়েছিল। স্যামসাং চৌধুরী, কবীর চৌধুরীর মতো বেশকিছু ব্যক্তি সহৃদয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ান। ফুজায়েরার আমীর, শারজাহ্র নাট্যমোদী আমীর ড. শেখ সুলতান আমাদের সহযোগিতা করেছে। আইটি আই এর আমন্ত্রণে তারা বিভিন্ন সময়ে নাটক নিয়ে যেসব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তাতে করে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব সংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতায় আগ্রহী তা বুঝে বিস্মিত হয়েছি। বিস্মিত হয়েছি, যখন আত্মিকভাবে তাদের আমাদের থিয়েটার স্কুলের পথচলায় সতীর্থ হিসাবে ভাবতে পেরেছি। আনন্দকণ্ঠ : ভাবনা কি কখনও থমকে গেছে! রামেন্দু মজুমদার : থমকেছে কিন্তু থামেনি। একদিন তুমি আমার কাছে এসেছিলে শেখ সাদীর ওপর নাটক লিখবে বলে পরামর্শ চাইতে। আমি সিরাজ নগরীতে গোলাপ ফুলে পরিবৃত শেখ সাদীর সমাধীক্ষেত্র দেখার অভিজ্ঞতা বলেছিলাম। তুমি নাটক সাদীনামা শেষ করে আমায় পড়তে দিলে। একটি দৃশ্যে দ্রুত এবং সময় নিয়ে কাজ করার বিষয়ে শেখ সাদীর দৃষ্টিভঙ্গি আমার ভাল লেগেছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি হলো না। দীর্ঘ কোর্সের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের অনীহা। আমরা এক বছরের কোর্সটিকে ডিপ্লোমায় রূপান্তরিত করার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি গ্রহণ করলাম। কিন্তু ডিপ্লোমা কোর্সের জন্য ডিগ্রী পরীক্ষায় উত্তীর্ণরাই আবেদন করতে পারবে বলে সে কোর্সে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আবেদনকারী পেলাম না। ক্রমেই এক বছর মেয়াদী ভর্তি হতে ইচ্ছুকদের সংখ্যা কমে আসছে। সবাই স্বল্পমেয়াদী কোর্স করতে আগ্রহী। ফলে গত বছর থেকে আমরা এক বছর মেয়াদী কোর্সটি আপাতত বন্ধ রেখে ছয় মাস মেয়াদী একটি বেসিক কোর্স চালু করেছি। ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের অসুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে সপ্তাহে তিন দিনের জায়গায় এখন দুদিন ক্লাস হয়, তবে প্রতিদিন তিন ঘণ্টার জায়গায় সময় বেড়ে এখন চার ঘণ্টা ক্লাসে। তাই বলছি, থমকেছে কিন্তু থামেনি। আনন্দকণ্ঠ : হয়ত থামেনি কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের অর্জনটাকে কিভাবে দেখছেন? রামেন্দু মজুমদার : থিয়েটার স্কুলের শিক্ষা কেবল নাটকে নয়, ব্যক্তিজীবন এবং কর্ম জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়ক হয়েছে। আজকে মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্রের অনেক প্রথিতযশা অভিনেতা অভিনেত্রীদের অনেকেই থিয়েটার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকেরই এখানে নাটক পাঠের হাতেখড়ি। অনেকের জীবনের স্বর্ণালি অধ্যায় এই থিয়েটার স্কুলকে ঘিরে। আনন্দকণ্ঠ : ২৭ বছর পূর্তি উৎসবকে ঘিরে যা যা ছিল। রামেন্দু মজুমদার : বর্তমান এবং প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের মিলনমেলায় গত শুক্রবার শিল্পকলা একাডেমি ছিল উৎসবমুখর। সকালে সেমিনার রুমে ছিল সেমিনার। অধ্যাপক আবদুস সেলিম উপস্থাপন করেন ‘চিরায়ত নাট্যরীতি ও সমকালীন প্রযোজনা নিরীক্ষা’ শিরোনামে তাঁর উপস্থাপনা। বিষয়বস্তুর ওপর সকলের অংশগ্রহণটা ছিল দেখার মতো। দুপুরে ছিল সকলে মিলে পারিবারিক আবহে মধ্যাহ্নভোজ। বিকেলে আনন্দ শোভাযাত্রা। সান্ধ্য আয়োজনে উৎসব আনুষ্ঠানিকতা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, থিয়েটারের ভরকেন্দ্র অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে থিয়েটার স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা নাট্য কোলাজ, নাটকের নৃত্যসঙ্গীত প্রভৃতি উপস্থাপনা করে। থিয়েটার স্কুলের একনিষ্ঠ কর্মী খুরশীদ আলমকে আমরা সম্মাননা প্রদান করি। সময়ের স্বল্পতায় অনেক ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশনা সর্বসমক্ষে তুলে ধরার সুযোগ দিতে না পারাটা একটা বেদনা। ইচ্ছা রইল ৩০ বছর পূর্তি উৎসবে সময়ের পরিধি বাড়িয়ে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। আনন্দকণ্ঠ : থিয়েটার স্কুলের ভবিষ্যত পরিকল্পনা। রামেন্দু মজুমদার : অতীতে থিয়েটার স্কুল শুধু ঢাকাতেই তাদের কার্যক্রম নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম-বরিশাল-খুলনার মতো চৌদ্দটি জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করেছ। ঢাকার শিক্ষকদের পাশাপাশি সায়মন কর্ডার, তাপস সেন, মনোজ মিত্র, দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়, ড্যানিয়েল কার্কি, বিভাস চক্রবর্তী, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়দের মতো বিদেশী আমন্ত্রিত শিক্ষকরা ক্লাস করিয়েছেন। সময়ের বিবর্তন এবং প্রযুক্তির উদ্ভাবনকে মাথায় রেখে থিয়েটার স্কুল তার পাঠ্যক্রমকে বরাবরের মতো সমসাময়িক করে নেবে। মূল্যবোধের এবং মনুষত্বের আলোকে শিখা জ্বলুক প্রাণে ভাবধারায় থিয়েটার স্কুল তার কার্যক্রম পরিচালনা করে চলবে নিরন্তন। সামান্য সম্মানীর বিনিময়ে সম্মানিত শিক্ষকদের মূল্যবান সময়দান, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধকরণ, পৃষ্ঠপোষকদের আন্তরিক সহযোগিতা এবং নাট্যানুরাগী মানুষদের অনুপ্রেরণা নিয়ে আবদুল্লাহ আল-মামুন থিয়েটার স্কুল এগিয়ে যাবে সম্মুখে, নতুন শক্তি সঞ্চয় করে নব থেকে নবতর সৃজনে। আনন্দকণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ। রামেন্দু মজুমদার : জনকণ্ঠকে ধন্যবাদ, তোমাকেও ধন্যবাদ।
×