ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কনটেনারের পানিতে কি খাচ্ছি?

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮

কনটেনারের পানিতে কি খাচ্ছি?

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ রাজধানীর আদাবর থানার আওতাধীন গৈদারটেক এলাকা। এখানে নামহীন গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এ এলাকার বিভিন্ন ভবনের ভেতরে যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ওয়াসার পানি প্লাস্টিকের কন্টেনারে ভর্তি করে বাজারজাত করা হচ্ছে তা সকলের দৃষ্টির আড়ালে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এসব বাসায় লোকজন বসবাস করে অথচ বাসার বিভিন্ন রুমে প্লাস্টিক জারে ভর্তি। মঙ্গলবার এমনই একটি একতলা ভবনের ভেতরে দেখা মিললো কীভাবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ওয়াসার পানি বোতলজাত করা হচ্ছে। শেওলাভর্তি রুমের মধ্যে ঠাসাঠাসি করে রাখা আছে জারগুলো। দুজন ব্যক্তি একে একে ওয়াসার পাইপ জারের মুখে ঢুকিয়ে পানি ভর্তি করছে। এভাবেই মিনারেল ওয়াটার বলে সরাসরি ওয়াসার সাপ্লাই করা পানিতে ফিটকিরি ও দুর্গন্ধ দূর করার ট্যাবলেট মিশিয়ে তা কনটেনারে ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে। বোতলজাত পানির দাম বেশি হওয়ায় কম দামে বেশি পানির প্রলোভন দেখিয়ে রাজধানী জুড়ে বিস্তৃত হয়েছে ফিল্টার্ড নামক পানির প্লাস্টিক কনটেনার বাণিজ্য। ঢাকা ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ থাকায় অনেক নগরবাসী বাসাবাড়িতে এ পানি কিনে খাচ্ছেন। এ ছাড়া রাস্তার ফুটপাথে গড়ে ওঠা চায়ের দোকানগুলোতেও এক গ্লাস এক টাকা মূল্যে এ পানি বিক্রি হচ্ছে দেদার। হোটেল- রেস্তরাঁ, স্কুল-কলেজ, বেকারি, ফাস্টফুডের দোকান, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চাহিদা মতো এ পানি সরবরাহ করা হয়। বিভিন্ন নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে এ ব্যবসা করা হচ্ছে। যারা এ পানির ব্যবসায় করছেন তাদের বেশির ভাগেরই নেই বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স। জারের পানি আদৌ পরিশোধন করা হয় না। গৈদারটেকের নামহীন এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মোহাম্মদ মিরাজ। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, দীর্ঘ তিন বছর ধরে এখানে তারা পানি সরবরাহের ব্যবসা করছেন। বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স তাদের না থাকলেও তারা আবেদন করেছেন বলে জানান মিরাজ। তিনি আরও জানান, এভাবেই নাকি ওয়াসার পানি জারভর্তি করে তা মিনারেল নামে সাপ্লাই দেয়া হয়। আর এটা শুধু তাদের প্রতিষ্ঠানই নয় বরং অন্যান্য পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও করে থাকে।’ নামহীন এই প্রতিষ্ঠানের মালিক বশির মিয়া। তবে সে নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে উপস্থিত না থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) একদল গবেষক বোতলজাত ও জারের পানিতে খনিজ উপাদানের মাত্রা ও গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা করে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাসাবাড়ি ও অফিস-আদালতে সরবরাহ করা ৯৭ ভাগ জারের পানিতে মানুষ ও প্রাণীর মলের জীবাণু ‘কলিফর্ম’ ক্ষতিকর মাত্রায় রয়েছে। রাজধানীসহ কেরানীগঞ্জ, আশুলিয়া ও সাভার এলাকা থেকে আড়াই শ’ জারের পানির নমুনা পরীক্ষা করে গবেষকরা দেখেছেন, প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে টোটাল কলিফর্মের মাত্রা ছিল ১৭ থেকে এক হাজার ৬০০ এমপিএন (মোস্ট প্রোবাবল নম্বর) এবং ফিকাল কলিফর্মের মাত্রা ছিল ১১ থেকে ২৪০ এমপিএন। ওই গবেষক দলের প্রধান মনিরুল ইসলামের মতে, জারের পানিতে টোটাল কলিফর্ম ও ফিকাল কলিফর্মের পরিমাণ শূন্য থাকার কথা। কিন্তু ৯৭ ভাগ জারের পানিতে দুটোরই উপস্থিতি রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’ গত ২২ জানুয়ারি রাজধানীর পল্টন ও মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার হাজার দূষিত পানির জার ধ্বংস করেছে মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। একদিনের এ অভিযানে ১২টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় চার হাজার জার জব্দ করে তা ধ্বংস কর হয়। জানা গেছে, অনেক দিন ধরে প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদিত মানহীন বোতলজাত খাবার পানি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বিএসটিআইয়ের অনুমোদন না নিয়ে অবৈধভাবে বিক্রয় ও বিতরণ করার অপরাধে এসব প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ৩৩ হাজার টাকা জরিমানা করেন বিএসটিআইয়ের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযান চলাকালে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা এবং জারের পানি সরবরাহে নিয়োজিত ১৫টি ভ্যান আটক করেন বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের পরিচালক মোঃ ইসহাক আলী বলেন, ‘ঢাকায় সরবরাহকৃত বেশির ভাগ জারের পানি পরিশোধনহীন। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান পরিশোধন না করে ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই প্লাস্টিকের জারে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। শুধু জারের মুখ কর্কবন্দী করে নাম দেয়া হয়েছে ‘ফিল্টার পানি’। তথাকথিত বিশুদ্ধ পানিভর্তি জারটির গায়ে নেই কোন লেবেল, এমনকী উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখও দেয়া থাকে না। বিএসটিআই এ ধরনের অভিযান আরও জোরদার করবে। তবে জারের পানি কেনার আগে ভোক্তাদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, নাম-ঠিকানাহীন প্রতিষ্ঠানের পানি কিনবেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে দেশে মাত্র ২৪৭টি কোম্পানি বিএসটিআই থেকে অনুমোদন নিয়ে বোতলজাত ও জারে করে পানির ব্যবসা করছে। এর মধ্যে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকাতে রয়েছে দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান। বিএসটিআই থেকে এ পর্যন্ত ৩৬৭ কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। যাদের অনেকেরই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে কিংবা বাতিল হয়ে গেছে। বর্তমানে প্রতিটি কারখানায় জার পরিষ্কার যন্ত্র থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসব না থাকলে তাদের লাইসেন্স দেয়া হয় না। এ ছাড়া বৈধভাবে পানির ব্যবসায় করতে হলে কমপক্ষে ২০-২৫ লাখ টাকা প্রয়োজন। অনেকে চার-পাঁচ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় শুরু করে দেন। পরে জরিমানা-জেল দিলেও তারা আবার ওই ব্যবসায় চালাতে থাকেন। রাজধানীতে বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে জার পানির ব্যবসায় করছে। এদের ধরতে র‌্যাব, জেলা প্রশাসনের সহায়তায় নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, এ রকম দূষিত পানি দীর্ঘদিন পান করতে থাকলে আরও জটিল রোগ, এমনকী মরণব্যাধি ক্যান্সারও হতে পারে। কিডনি রোগ, আলসার, রক্তচাপ, এ্যাজমা, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে। এ ছাড়া, পানিতে তিকর উপাদানগুলোর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতিতে টাইফয়েড জাতীয় রোগ, ডায়রিয়া, আমাশয়, কলেরা, জন্ডিসের মতো জটিল রোগ হতে পারে। পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, পিএইচ ভ্যালু ছয় দশমিক পাঁচ-এর নিচে নেমে গেলে পানিতে এ্যাসিডিটি বেড়ে যায়। এতে মাড়িতে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে। যদি কেউ লেড ও ক্যাডমিয়ামযুক্ত পানি নিয়মিত পান করে এবং তা অভ্যাসে পরিণত হয় তাহলে তার শরীরে পুষ্টির অসমতা দেখা দিতে পারে।
×