ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২০ শতাংশ নগদ সহায়তা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন

বিদেশে আলু রফতানির বাজার খুঁজছে সরকার

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮

বিদেশে আলু রফতানির বাজার খুঁজছে সরকার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সরকার বিদেশে আলু রফতানির চিন্তা করছে। কোন কোন দেশে বাংলাদেশের আলুর চাহিদা রয়েছে তা জানার চেষ্টাও চলছে। প্রতিবছর প্রচুর আলু নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে আলুচাষী ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমন অবস্থায় দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত আলু যেন রফতানি করা যায়, সে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অতীতে এ ধরনের উদ্যোগ বার বার নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে, এবার সরকার চায় যাতে আলু চাষে কৃষকরা নিরুৎসাহিত না হয়। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘অতীতে বাংলাদেশ থেকে আলু রফতানির হতো। বিশেষ করে রাশিয়ায়। একই সঙ্গে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরেও বাংলাদেশী আলুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আলুতে ব্রাউন রোড ডিজিস নামের এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ধরা পড়ায় রাশিয়া আলু নেয়া বন্ধ করে দেয়। রাশিয়ার সেই আপত্তি নিরসন করা হয়েছে। এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত আলু সব ধরনের ব্যাকটেরিয়া মুক্ত। বাংলাদেশ কৃষি বিভাগ এখন ব্যাকটেরিয়া মুক্ত আলু উৎপাদন করছে। বিষয়টি রাশিয়াকে ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে।’ এখন রাশিয়া বাংলাদেশের আলু নেয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে এক লাখ মেট্রিক টন আলু রাশিয়ায় রফতানির কথা ভাবছে সরকার।’ শুধু রাশিয়া নয়, কোন কোন দেশে বাংলাদেশের আলুর চাহিদা রয়েছে, তা জানাতে সব দেশে বাংলাদেশী মিশনগুলোকে নির্দেশ দেয়া হবে বলেও জানান তিনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর আলুর চাহিদা ৮০ লাখ মেট্রিক টন। গতবছর দেশে এক কোটি ১৩ লাখ টান আলু উৎপাদিত হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এই মুহূর্তে দেশের ৩৮০টি কোল্ড স্টোরেজে মজুদকৃত আলুর পরিমাণ হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। এরই মধ্যে বাজারে আসতে শুরু করেছে নতুন আলু। এখনও অনেক কৃষকের জমিতে আলু রয়েছে। সেগুলোও উঠবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর আশা করছে এ বছরও দেশে এক কোটি মেট্রিক টনের বেশি পরিমাণ আলু উৎপাদন হবে। এমন অবস্থায় কোল্ড স্টোরেজের মজুদকৃত আলু বাইরে আনতে পারছে না লোকসানের ভয়ে। কৃষকরা আর কোল্ড স্টোরেজের কাছেই যায় না। কারণ দাম নেই। প্রতি কেজি আলুর উৎপাদনসহ কোল্ড স্টোরেজে রাখার খরচ ১৪ টাকা হলেও দেশের উত্তরবঙ্গে এখন ৬০ কেজি আলুর বস্তা ৩০ টাকা দরে বিক্রির জন্য ব্যবসায়ীরা দাম বলছে। এমন অবস্থায় কোল্ড স্টোরের মালিকরা তার কোল্ড স্টোর খালি করতে এক কেজি দুধের বিনিময়ে ৬০ কেজি আলু বিক্রির ঘটনাও ঘটিয়েছে। কারণ উত্তরবঙ্গে এক কেজি দুধের দাম ৪০ টাকা। আলু ব্যবসায়ীরা যে দাম (৬০ কেজি ৩০ টাকা) বলছে, তার তুলনায় ১০ টাকা বেশি পাওয়ায় মালিকরা এভাবে তার গুদাম খালি করার চেষ্টা করছে। অথচ রাজধানীসহ শহরাঞ্চলে চড়া দামেই আলু বিক্রি হচ্ছে। মাঝখানে আলুর দাম কমে ১৮-২০ টাকায় নামলেও তা আবার বেড়ে ২২ থেকে ২৫ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। নতুন আলুর চড়া দামের সুযোগে পুরনো আলুর দামও ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১৭ সালে সারাবছর ধরেই আলুর দাম ২০ টাকার ওপরে কেনাবেচা হয়েছে। অথচ খুচরা বাজারে এক কেজি আলুর দাম সর্বোচ্চ ১৫ টাকা হওয়া উচিত বলে মনে করছেন ভোক্তারা। কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার কারণেই খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম বেশি হচ্ছে। তাদের অতি মুনাফার দায় বহন করতে হচ্ছে ভোক্তাদের। কৃষি বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সরাসরি আলুর ব্যবহার ও প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এটি করতে পারলে কৃষকের এই লোকসান কমানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে রফতানিযোগ্য জাত উদ্ভাবন করে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে বলেও মনে করেন তারা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আলু রফতানিতে আয় হয়েছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। আর চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে আলু রফতানি হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আলু সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় মালয়েশিয়ায়। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ব্রুনেই, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আলু রফতানিতে সরকার কয়েক বছর ধরে ২০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দিয়েছিল। ২০১৬ সালে তা কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এখন আবার নগদ সহায়তা ২০ শতাংশ করা হয়েছে। কাওরানবাজারের আলু ব্যবসায়ী এম এ সাত্তার বলেন, ‘সরকারের অপরিকল্পনা ও দক্ষতার অভাবে প্রতিবছর ব্যাপক পরিমাণে আলু নষ্ট হচ্ছে। যদিও দেশে আলুর উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে। গত কয়েক বছরে লাখ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত থাকছে। এই অতিরিক্ত আলু রফতানির উদ্যোগ নিলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন।’ বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ এ্যাসোসিয়েশন লিখিতভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, এ পর্যন্ত কোল্ড স্টোরেজে ৫৩ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। যার ৪৫ শতাংশই কম দামে বিক্রি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৯ লাখ টন অবিক্রিত আলু থেকে ১০ লাখ টন বীজ বের হবে। বাকি ১৯ লাখ টন আলু থেকে মৌসুমের আগে ৪ লাখ টন বিক্রি হতে পারে। এরপরও ১৫ লাখ টন রয়ে যাবে। যা বিক্রি হবে না। এ অবস্থায় ওই অবিক্রিত আলু কোল্ড স্টোরেজের বাইরে এনে ফেলে দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ হবে না। এতে প্রতি বস্তা আলু ১ হাজার ৪০০ টাকা দরে প্রায় ২ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই দরে সংরক্ষণ করা ৩৮ লাখ টন আলু ৭০০ টাকা বস্তা হিসেবে বিক্রিতে প্রায় ৩ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এতে কৃষকদের মোট লোকসান হচ্ছে ৫ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। এই লোকসান ঠেকাতে এ্যাসোসিয়েশন নেতারা আলু রফতানির উদ্যোগ বাড়ানোর কথা বলেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগ। আলু তো আর সরকার রফতানি করবে না। ব্যবসায়ীদেরই আলু রফতানির উদ্যোগ নিতে হবে। তাদেরই নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা আলু রফতানির উদ্যোগ নিতে পারে। কারণ তারা নিজেরাও ব্যবসায়ী। আর আলু হচ্ছে কৃষি পণ্য। বাজারে সব সময় কৃষি পণ্যের দাম উঠানামা করে। সরবরাহ বাড়লে দাম কমে, আর সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে। কোল্ড স্টোরেজগুলোতে যদি এত আলুই মজুদ থাকে তাহলে গত বছর ভোক্তাদের ৩০ টাকা দরে আলু খেতে হলো কেন? বিশেষ করে, বন্যার সময় সবজি সঙ্কটের সময় কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা আলুর দামও বাড়িয়ে দেয়। ফলে প্রায় ৪ মাস সময় ধরে ৩০ টাকা দরে ভোক্তাদের আলু খেতে হয়। দাম বৃদ্ধির কারণে তখন আরও চাহিদাও কমে যায়। অথচ ওই সময় তারা আগের দাম আলুর সরবরাহ বাড়িয়ে দিলে এখন কোল্ড স্টোরেজগুলোতে এত আলুর মজুদ গড়ে উঠত না। গত বছরের মতো, নতুন আলু উঠার পরপরই পুরনো মজুদ ফুরিয়ে যেত।
×