ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ধরা যাক দু’একটা ইঁদুর

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮

ধরা যাক দু’একটা ইঁদুর

সেই কবে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাস লিখেছিলেন, ‘চমৎকার, ধরা যাক দু’একটি ইঁদুর এবার।’ ইঁদুর তো ধরতেই হবে। কারণ ইঁদুরেরা কবির প্রিয় রূপশালী ধান কেটে নিয়ে গর্তে জমায়। ধানী জমি লোপাটে ইঁদুরের দক্ষতা তো অতুলনীয়। সুনিপুণভাবে দন্ত ব্যবহার করে গাছ থেকে ধানের ছড়া কেটে নিয়ে মাটির গহ্বরে নির্মিত বাংকার বা গুদামে সঞ্চিত করে। সারা বছরের খাবার সঞ্চয়ের জন্য নানাবিধ কলাকৌশল ব্যবহার ইঁদুরের একান্ত নিজস্ব। তার সঙ্গে পাল্লা দেয়ার মতো নেই কোন প্রাণী। রোমশ ইঁদুরেরা জীবনানন্দের কবিতার প্রাণ হয়ে ইতিউতি ঘুরে বেড়ায় আজও। ইঁদুরের কদর শুধু কবির কাছেই নয়, বিজ্ঞানী-গবেষকদের কাছে সে অতি মূল্যবান। বৈজ্ঞানিক-গবেষণাই বলি আর আবিষ্কৃত ওষুধের কথাই বলি তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে ইঁদুর ছাড়া উপায় নেই। মানুষের জন্য আবিষ্কৃত ওষুধ সর্বাগ্রে প্রয়োগ করা হয় ইঁদুরের দেহে। সে ওষুধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের পরই মানবদেহের জন্য তা অনুকূল কিনা সে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মানবদেহের বিভিন্ন কোষ-জিন বা হৃৎপিণ্ড, কিংবা মস্তিষ্ক সংক্রান্ত গবেষণার কাজটি চালানো হয় প্রথমেই ইঁদুরের ওপর দিয়ে। বিশ্বের প্রায় সব চিকিৎসা গবেষণাগারে ইঁদুরেরা সবচেয়ে বেশি কদর লাভ করে। ইঁদুর না থাকলে গবেষণা কাজ সম্ভব হতো না, এটাই বাস্তব। তাই যতই ইঁদুরের জন্য ফাঁদ বা কলপাতা হোক, তাকে অবহেলা বা উপেক্ষা করা সুকঠিন। ইঁদুরের সঙ্গে বিড়ালের খেলার গল্প কম নয়। ইঁদুর-বেড়াল খেলা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। ইঁদুর ধরার পর বিড়াল তাকে নিয়ে খেলে। কবি আবুল হাসান লিখেছিলেন সত্তর দশকে, ইঁদুরের তবু পালাবার রয়েছে পথ, আমাদের তাও নেই। আসলেই মানুষের পালাবার কোন পথ নেই। অনায়াসে গর্তে ঢুকে পড়তে পারে, কিংবা বাড়ির কার্নিশে উঠে যেতে পারে, পারে গাছের ডগায় ঠাঁই নিতে। কিন্তু মানুষ যাবে কোথায়? তাই তাকে ইঁদুরের আক্রমণ সয়ে যেতে হয়। পাঠাগার বা বইয়ের আড়তও ইঁদুরের খুব প্রিয়। পাঠাভ্যাস তার না থাকলেও পাঠযোগ্য বই মুট মুট করে কেটে ফেলায় তার জুড়ি নেই। আস্ত একটি বই লোপাট হয়ে যায় তার ক্ষুরধার দন্তাঘাতে। এমনকি কাপড়-চোপড়ও পায় না রেহাই। ‘কুটকুট শব্দ প্রবাহ ছড়িয়ে দেয়ার মধ্যে এক ধরনের সুর রয়েছে। এটাকে ‘ইঁদুর সঙ্গীত’ বলে অভিধা দিলেও অত্যুক্তি হয় না। তবে ইঁদুরের গায়ের গন্ধ বেশ বিটকেলে যেমন হয়, তেমনি হয় রোমাঞ্চকর। ঘ্রাণশক্তি তার তীব্র। তাই বুঝে নিতে পারে অনায়াসে কোথায় রয়েছে কি। ইঁদুর সুদর্শন প্রাণী অনেক ক্ষেত্রে। তার লেজের মাহাত্ম্য বোঝে সে নিজেই। বিড়াল দেখলে লেজ গুটিয়ে পালাতে দ্বিধা করে না। আর কান তার বেশ মায়াময়। দু’কান উঁচিয়ে রেখে শব্দের মাহাত্ম্য খোঁজে। এসব ইঁদুর ধরা সহজ কাজ নয়। কবি চাইলেও পেরেছেন কিনা জানা যায় না। কিন্তু ইঁদুর এসে কামড়ে দিয়ে যায় মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কখনও সখনও। এমনটাই ঘটেছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি কক্ষে বসে থাকা এক রমণীর পায়ে হঠাৎ একটি ইঁদুর এসে এমনভাবে কামড়ে দিয়েছে যে, তাতে তিনি আহত হন। কামড়ের চোটে যখন চিৎকার করেন, আতঙ্ক জাগে উপস্থিত অন্যদের মধ্যেও। ভ্যাকসিন দিতে হয়েছে আক্রান্তকে। বিমানবন্দরে মশা, মাছি, তেলাপোকা, বিড়ালের বসবাস অতি পুরনো। তাদের সঙ্গেই বাস করে ইঁদুরেরা। বিমানের শব্দ তাদের ক্লান্ত করে না। বরং কর্ণকুহরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে হয়ত শরীরে দোলা জাগে। সে দোলায় দুলতে দুলতে সম্ভবত ইঁদুরটিও রমণীর কোমল পায়ে তার দন্ত বসিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে তার শক্তিমত্তা। প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘চিনিল কেমনে?’ ইঁদুর চেনে, বোঝে জানে কোথায় কামড়াতে হবে। ইঁদুরের কাজ ইঁদুর করেছে, মানবীর দেহ তাই হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। ইঁদুর মারার কল বসাতে কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় দরপত্র ডাকবেন। সেমিনার সভাও হবে। মূল্যবান ভাষাণও শোনা যাবে। কিন্তু ‘ইঁদুর দমন অভিযান’ যতই চালানো হোক, বংশ নিধন তার হবে না সহজে। বন্যেরা বনে সুন্দর। ইঁদুর সুন্দর বিমানবন্দরে বুঝি আজ।
×