ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপকথন-৩ ॥ প্রথম বিশ্বকাপ : উরুগুয়ে ১৯৩০

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮

বিশ্বকাপকথন-৩ ॥ প্রথম বিশ্বকাপ : উরুগুয়ে ১৯৩০

বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসর বসে ১৯৩০ সালে সে কথা আগেই বলা হয়েছে। বিশ্বকাপের অভিষেক আসর আয়োজনের আগ্রহ প্রকাশ করে অনেক দেশ। বিশেষ করে যাদের নেতৃত্বে ফিফা গঠিত হয় সেই ফ্রান্সের আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। তার ওপরে ফিফার সভাপতি ফ্রান্সের মঁশিয় জুলে রিমে। ফলে বিশ্বকাপের প্রথম আয়োজনের দায়িত্ব যে ফরাসীরা পাচ্ছে এটা অনেকে এক রকম ধরেই নিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ফিফার ৪১টি দেশের প্রতিনিধির বৈঠকে প্রথম আয়োজক নিয়ে কোন মতানৈক্য হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে ফিফা সভাপতিকে ভোটে যেতে হয়। ভোটের ফলাফল ফ্রান্স কেন, ইউরোপের কোন দেশের পক্ষেই গেল না। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ল সুদূর ল্যাটিন দেশ উরুগুয়ের পক্ষে। যদিও তার যথেষ্ট কারণও ছিল। কেননা তখন উরুগুয়ের ফুটবলে স্বর্ণযুগ। এর আগের দুটো অলিম্পিকে (১৯২৪ ও ’২৮) ফুটবলের সোনা জিতেছে তারা। এ ছাড়া ১৯৩০ সাল উরুগুয়ের স্বাধীনতার শতবার্ষিকী। স্বাধীনতার শতবর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে চায় তারা। আর এ কারণে তাদের সে চাওয়াকে উপেক্ষা করতে পারেনি অনেকে। উরুগুয়ের বেশি ভোট পাওয়ার এটিও একটি কারণ। তারা তাদের স্বাধীনতার শতবার্ষিকীকে স্মরণীয় করে রাখতে চায় বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্যে দিয়ে। এ জন্য তারা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলগুওলোর যাবতীয় খরচও বহন করতে সম্মত হয়। এ ছাড়াও তারা মন্টিভিডিওতে একটি এক লাখ আসনের নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণেরও প্রতিশ্রুতি দেয়। ফলে উরুগুয়েকে হটিয়ে অন্য কারও পক্ষে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগই ছিল না। বিষয়টিকে ইউরোপের দেশগুলো প্রীতির চোখে দেখল না। সহজভাবে মেনেও নিল না। তারা অনেকে দূরত্বের অজুহাত দেখিয়ে উরুগুয়ের বিশ্বকাপে অংশ নিল না। অন্যদের বাধা উপেক্ষা করেও ইউরোপ থেকে ৪টি দল (ফ্রান্স, বেলজিয়াম, রুমানিয়া ও যুগোশ্লাভিয়া) উরুগুয়ের পথে পাড়ি দিল। এ ক্ষেত্রে রুমানিয়ার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। রুমানিয়ার রাজা ক্যারল তো অতি আগ্রহ নিয়ে বিশ্বকাপের দল গঠনে নিজেই মাঠে নেমে পড়লেন। অন্যদের অংশ নেয়ার জন্য উৎসাহিতও করেন। আর ইংল্যান্ড! তারা তো ১৯৫০ সালের আগে বিশ্বকাপ ফুটবলকে কোন প্রতিযোগিতাই মনে করেনি। প্রথম বিশ্বকাপে কেবল ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে (উত্তর ও দক্ষিণ) ১৩টি দল প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নেয়। আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়া থেকে কোন দেশ প্রথম বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়নি। অঞ্চলভিত্তিক দলগুলো হলো : ইউরোপ : ফ্রান্স, বেলজিয়াম, যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া ও বলিভিয়া; কনমোবল : ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, চিলি ও পেরু; কনকাকাফ : যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নেয়। মূল পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ১৮টি ম্যাচ। উরুগুয়ের ৩টি স্টেডিয়ামে এই ১৮টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ১৩টি দলকে ৪টি পুলে ভাগ করা হয়। একমাত্র ক পুলে ৪টি এবং বাকি ৩ পুলে ৩টি করে দল অংশ নেয়। গ্রুপিং করা হয় এভাবে : ক পুলে- ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো ও চিলি; খ পুলে-ব্রাজিল, যুগোশ্লাভিয়া ও বলিভিয়া; গ পুলে-উরুগুয়ে, রুমানিয়া ও পেরু; ঘ পুলে-যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম ও প্যারাগুয়ে। চার গ্রুপের গ্রুপ চ্যাম্পিয়নরা সরাসরি সেমি-ফাইনাল খেলে। এরপর ফাইনাল। প্রথম বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ইউরোপের ফ্রান্স বনাম পশ্চিমা দেশ মেক্সিকো। ইউরোপ বনাম ল্যাটিন লড়াইয়ে জেতে ইউরোপ। ফ্রান্স ৪-১ গোলে উড়িয়ে দেয় মেক্সিকানদের। ফ্রান্সের লুই লরেন্ট বিশ্বকাপে প্রথম প্রতিপক্ষের জালে বল ছোঁয়ান। গ্রুপ পর্বে বলা হয়, ফ্রান্সের বিজয় ব্রাজিলিয়ান রেফারি ছিনিয়ে নিয়ে আর্জেন্টিনাকে দিয়ে দেন। ফ্রান্স যখন খেলায় ফিরে আসার পথে ঠিক তখন ব্রাজিলিয়ান রেফারি সবাইকে হতবাক করে দিয়ে খেলার ৮৪ মিনিটের সময় শেষ বাঁশি বাজিয়ে দেন। যদিও পরে ফিফা কর্তাদের হস্তক্ষেপে ১৫ মিনিট পরে আবার খেলা শুরু হয় কিন্তু ফ্রান্সের আর হার এড়ানো সম্ভব হয়নি। আর্জেন্টিনা জেতে ১-০ গোলে। প্রথম বিশ্বকাপে আমেরিকার সাফল্যে সবাই অবাক হয়েছে। তারা ততটা ফেবারিট ছিল না। তারপরও তারা সেমিতে উঠে চমক দেখায়। মার্কিনীদের এই সাফল্যের নেপথ্য কারণ হিসেবে ইংরেজ ও স্কটিশদের উগ্র সাপোর্টকে অনেকে ক্রেডিট দেন। যদিও সেমিতে মার্কিনীরা ভাল ধরে রাখতে পারেনি। তারা ল্যাটিন ফুটবলের ভেলকির কাছে মার খেয়ে যায়। আর্জেন্টিনার কাছে হারে ৬-১ গোলে। তাদের সব অর্জন বিসর্জন দিয়ে দেশে ফিরতে হয়। গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনা ৬-৩ গোলে মেক্সিকোকে, ব্রাজিল ৪-০ গোলে বলিভিয়াকে, যুগোশ্লাভিয়া ৪-০ গোলে বলিভিয়াকে এবং ফ্রান্স ৪-১ গোলে মেক্সিকোকে হারিয়ে বড় জয় পায়। গ্রুপ পর্বের ফলাফল : পুল-১ : ফ্রান্স-৪ মেক্সিকো- ১; আর্জেন্টিনা-১ ফ্রান্স-০; চিলি-৩ মেক্সিকো-০; আর্জেন্টিনা-১ ফ্রান্স-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : আর্জেন্টিনা। পুল-২ : যুগোশ্লাভিয়া-২ ব্রাজিল-১; যুগোশ্লাভিয়া-৪ বলিভিয়া-০; ব্রাজিল-৪ বলিভিয়া-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন; যুগোশ্লাভিয়া । পুল-৩ : রুমানিয়া-৩ পেরু-১; উরুগুয়ে-১ পেরু-০; উরুগুয়ে-৪ রুমানিয়া-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : উরুগুয়ে । পুল-৪ : যুক্তরাষ্ট্র-৩ বেলজিয়াম-০; যুক্তরাষ্ট্র-৩ প্যারাগুয়ে-০; প্যারাগুয়ে-১; বেলজিয়াম-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : যুক্তরাষ্ট্র । সেমি-ফাইনাল : আর্জেন্টিনা-৬ যুক্তরাষ্ট্র-৩; উরুগুয়ে-৬ যুগোশ্লাভিয়া-১; তৃতীয় স্থান : যুক্তরাষ্ট্র। ফাইনাল : উরুগুয়ে-৪ আর্জেন্টিনা-২। চ্যাম্পিয়ন : উরুগুয়ে। চার পুলের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে আর্জেন্টিনা, যুগোশ্লাভিয়া, উরুগুয়ে, ও যুক্তরাষ্ট্র সেমিতে পৌঁছে। প্রথম সেমি-ফাইনালে আর্জেন্টিনা সহজেই যুক্তরাষ্ট্রকে ৬-১ গোলে হারিয়ে প্রথম দল হিসেবে প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে। অপর সেমি-ফাইনালে স্বাগতিক উরুগুয়েও একই ব্যবধানে ৬-১ গোলে যুগোশ্লাভিয়াকে হারিয়ে ফাইনালে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয়। মন্টিভিডিওর প্রায় এক লাখ দর্শকের উপস্থিতিতে এক জম্পেস গ্রান্ড ফাইনালে মুখোমুখি হয় দুই ল্যাটিন পরাশক্তি স্বাগতিক উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচে বিরতির সময়েও আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল। খেলার দ্বিতীয়ার্ধে দৃশ্যপট বদলে যায়। উরুগুয়ের ইরিয়াটে গোল করে খেলায় সমতা আনলে স্বাগতিকরা জয়ের স্বপ্ন দেখতে থাকে। আর তাদের সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেন উরুগুয়ের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক একহাতি খেলোয়াড় ক্যাস্ট্রো। মন্টিভিডিওর প্রায় এক লাখ দর্শককে আনন্দে জোয়ারে ভাসিয়ে জয়সূচক গোল করেন। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যান ক্যাস্ট্রো। ফুটবলের বিশ্বকাপের প্রথম ট্রফি (জুলে রিমে ট্রফি) ঘরে তুলে উরুগুয়েও হয়ে যায় কালের সাক্ষী। প্রথম বিশ্বকাপে কোন তৃতীয়স্থান নির্ধারণী ম্যাচ অনুষ্ঠিত না হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তৃতীয় স্থান দেয়া হয়। প্রথম বিশ্বকাপে মোট ৭০টি গোল হয়। হ্যাটট্রিক হয় মাত্র তিনটি। বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেটানভ। তিনি গ্রুপ পর্বে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন। সর্বাধিক গোলও করেন আর্জেন্টিনার গুলেইর্মো স্ট্যাবিল। তিনি ৮টি গোল করে ‘টপ স্কোরার’ হন। ২ জন খেলোয়াড় এ বিশ্বকাপে লালকার্ড দেখেন। প্রথম বিশ্বকাপে উরুগুয়ের নেতৃত্ব দেন ডিফেন্ডার নাজাজি আর রানার্স আপ আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকার ফেরেরা। অনেকে ভেবেছিল, ইউরোপের পুরো অংশগ্রহণ না থাকায় প্রথম বিশ্বকাপ ততটা জমবে না। বাস্তবে হয়েছে উল্টোটা। বিশ্বকাপ জমেছে, ষোলো আনা সফলভাবে শেষও হয়েছে। (চলবে) লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক পরিষদ ব-সধরষ : [email protected]
×