ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রিপোর্টারের ডায়েরি

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮

রিপোর্টারের ডায়েরি

দেশে ফিরলে মেরে ফেলবে! ৩০ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, দুপুর ১টা। কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুবপালং ও ময়নারগোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে বালুখালি ক্যাম্প পরিদর্শন শুরু করি। এ সময় কীভাবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে এখানে আসে এবং দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে কি-না এ বিষয়ে জানার চেষ্টা করি। এ নিয়ে প্রথমেই কথা বলি ১১ বছরের শিশু মো. তাহেরের সঙ্গে। সে জানায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলে সহায় সম্বলহীন পরিবারের সব সদস্য সেখান থেকে পালিয়ে অনেক দূরের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। এরপর বেশ কয়েক দিন পর তারা এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে অবস্থান নেয়। তবে আসার সময় তাহেরের এক বোন নূর কলিমা (৮) নাফ নদীতে ডুবে মারা যায়। এভাবে নদীতে ডুবে তাদের আরও ক’জন আত্মীয় মারা গেছে। এ কথা বলেই কাঁদতে কাঁদতে তাহের বলে ‘কবে আবার দেশে ফিরে যাব জানি না। আমাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করলে যেতে চাই। তবে দেশে ফিরে গেলে আমাদের মেরে ফেলবে। মা রশিদা বেগম ও বাবা মো. হোসেন এবং ২ ভাই ও ২ বোনসহ আমরা ৬ জনই বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকি। ক্যাম্প থেকে চাল, ডাল ও লবণসহ খাদ্যসামগ্রী দেয়া হয়। আমরা রান্না করে খাই। ওষুধপত্রও দেয়া হয়। ক্যাম্পে পানি ও শৈচাগারেরও ব্যবস্থা রয়েছে।’ তারপর বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া ১০ বছরের শিশু সারোয়ারের সঙ্গে কথা বলি। সে জানায় অনেক কষ্ট করে এখানে এসেছি। ক্যাম্প থেকে খাবার সরবরাহ করায় খাওয়া-দাওয়ার কোন সমস্যা নেই। তবে ক্যাম্প থেকে খাবার সরবরাহ করলেও অতিরিক্ত কিছু পাওয়ার জন্য তারা ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে আসা মানুষজনের কাছে যায়। একেকজন একেক রকম ত্রাণসামগ্রী দেয়। কেউ কেউ নগদ টাকাও দিয়ে যায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তেমন সমস্যা নেই। কথা প্রসঙ্গে সরোয়ার আরও জানায় তবুও তাদের দেশে ফিরে যেতে মন কাঁদে। তবে দেশে ফিরে গেলে মেরে ফেলতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে। বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যম্পে স্ত্রী ও ২ মেয়েকে নিয়ে অবস্থান করছেন মো. কলিমউল্লাহ (৩০)। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১০ দিন আগে এখানে আসলেও এখনও ক্যাম্পে স্থায়ী হতে পারেননি। তাই তাদের ওই এলাকার মানুষের বিভিন্ন কাজ করে যে পারিশ্রমিক পাওয়া যায় তার বিনিময়ে খাওয়া-দাওয়া চলে। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকার মানুষের কাজ করে টাকা রোজগারের পাশাপাশি ক্যাম্পে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। কাজ করার পাশাপাশি রাস্তায় কোন গাড়ি থামলেই দৌড়ে এসে ভিড় করেন কিছু পাওয়ার আশায়। আর আগ্রহীরা জানতে চাইলে মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার ও সেখান থেকে এখানে আসতে পথে পথে যে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তা বলেন। পরে খুশি হয়ে কেউ কোনকিছু সাহায্য করলে তা গ্রহণ করেন। এখান থেকে কেউ কেউ কাজের সন্ধানে অন্য এলাকায়ও চলে যান বলে জানা যায়। কলিমউল্লার সঙ্গে কথা বলার সময় আরও ক’জন রোহিঙ্গা এখানে জড়ো হয়ে সমস্বরে রাখাইন রাজ্যে তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের কাহিনী বলতে থাকেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তাদের মুখে এই নির্যাতনের কাহিনী শুনে এক পর্যায়ে আমি নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। আর মনে মনে ভাবতে থাকি আজকাল বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী দেশের পক্ষ থেকে বেশি বেশি করে মানবাধিকারের কথা বলতে শুনা যায়। তাহলে এই যে সহায় সম্বলহীন ১০ লাখ রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে তাদের কি কোন মানবাধিকার নেই। কেন এত কিছুর পরও তারা আশঙ্কা করছে নিজ দেশে ফিরে গেলে তাদের মেরে ফেলবে। তাদের মনের এ আশঙ্কা দূর করার দায়িত্ব কার? -শরীফুল ইসলাম আনপ্রেডিক্টেবল চ্যাম্পিয়ন! ৬ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ২০১৬। মানুষ ভাবে এক, কিন্তু হয় আরেক। দিনটা আমার জন্য অনেকটা তেমনই ছিল। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। লক্ষ্য কমপক্ষে তৃতীয় হওয়া (২০১৪ আসরে তৃতীয় হয়েছিলাম)। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অবস্থিত বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতিতে (বিএসপিএ) খেলা। যদিও প্রথমে খেলার ভেন্যু ছিল পল্টনের শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ ইনডোর স্টেডিয়ামে। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে ভেন্যু বদলে যায়। ‘সি’ গ্রুপে গাজী টিভির সাজ্জাদ হোসেনকে এবং নয়া দিগন্তের জিলানী মিল্টনকে হারিয়ে অপরাজিত গ্রুপসেরা হয়ে উন্নীত হলাম সেমিফাইনালে। তারপর সেমিতে অপ্রত্যাশিতভাবে হারাই গত তিন আসরের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন চ্যানেল ২৪-এর মুকিমুল আহসান হিমেলকে। সর্বশেষ আসরে তার কাছেই সেমিতে হেরে গিয়েছিলাম। হিমেলকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে নিজের কীর্তিকেই যেন বিশ^াস করতে পারছিলাম না। প্রতিপক্ষ হিসেবে ফাইনালে যাকে পেলাম, বাসসের সেই বর্ষীয়ান-স্বাস্থ্যবান সৈয়দ মামুনের বিরুদ্ধে তো জেতার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ তিনটি। তিনি ডিআরইউর বেশ ক’বারের সাবেক চ্যাম্পিয়ন, ডিআরইউ-ইতিহাসের সবচেয়ে তুখোড় ও ভয়ঙ্কর খেলোয়াড়দের একজন। তিনি বা-হাঁতি। ‘বাওয়া’দের বিরুদ্ধে খেলতে বরাবরই অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি এবং ব্যাপক স্নায়ুচাপে ভুগি। ফাইনালে ওঠার আগে তার খেলার ধরন ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করি। বুঝে ফেলি, তার সঙ্গে খেললে আমার ‘খবর’ আছে! ভয় পেয়ে লাভ নেই। কারণ আমি তো ‘আন্ডারডগ।’ কাজেই হারানোর কিছু নেই। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যেখানে তৃতীয় হওয়ার লক্ষ্য ছিল, সেখানে দ্বিতীয় বা রানার্সআপ হলে ক্ষতি কি! কাজেই নো চিন্তা, ডু ফূর্তি! প্রতিপক্ষকে ম্যাচ শুরুর আগেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অগ্রিম অভিনন্দন জানিয়ে বসলাম! আমার খেলার সবচেয়ে দুর্বল দিকÑ আমি প্রতিপক্ষের তুলনায় নবীন ও অনভিজ্ঞ। মোটেও ‘চাপ’ মারতে পারি না। খেলি ডিফেন্সিভ স্টাইলে। টেবিলের কোনা-কাঞ্চি ও নেটের ওপর দিয়ে ‘লো শট’ খেলাই আমার সম্বল। তারপরও ভরসা একটিইÑ প্রতিপক্ষকে কখনই তার স্টাইলে খেলতে দিই না। এমনভাবে খেলি, তারা যেন খেলতে বাধ্য হয় আমার ছক অনুযায়ী। চেষ্টা থাকে প্রতিপক্ষকে এ্যাঙ্গেল সাইড দিয়ে খেলানো এবং কখনই তাকে চাপ মারার সুযোগ না দেয়া। এভাবে খেলেই ফাইনাল পর্যন্ত উঠে এসেছি। কিন্তু সৈয়দ মামুনের বিরুদ্ধেও কি এই কৌশল সফল হবে? কি আশ্চর্য, হলো! প্রথম সেটে জিতলাম বেশ দাপটে, ২১-৯ পয়েন্টে। দ্বিতীয় সেটেও একইভাবে জিতবো ভেবেছিলাম। একপর্যায়ে ২০-১১ পয়েন্টে লিডও নিয়ে ফেলি। আর মাত্র ১ পয়েন্ট পেলেই স্বপ্নের শিরোপা ‘কুক্ষিগত’ করতে পারব। তখনই মামুন দেখালেন বুড়ো হাড়ের ভেল্কি! বুঝিয়ে দিলেন ‘ওল্ড আসলেই গোল্ড!’ টানা ৮ পয়েন্ট আদায় করে ম্যাচ জমিয়ে তুললেন। স্কোরলাইন ২০-১৯। আমি তখন মহা নার্ভাস! আর ১ পয়েন্ট পেলেই ডিউজ করে ফেলবেন তিনি এবং খেলা গড়াবে ‘বেস্ট অব ফাইভ’-এ। সেখানে যে তিনিই জিতবেন, তাতে সন্দেহ নেই। তাহলে কি তীরে এসে নির্ঘাত ডোবাবো তরী? নিজেকেই তখন নিজেই যে বলতে হবে, ‘আই এ্যাম সরি!’ কিন্তু না, সেটা আর হলো না। প্রতিপক্ষকে আর ১ পয়েন্ট পেতে দিলাম না। হতে দিলাম না ম্যাচটা ডিউজ। গড়াতে দিলাম না তৃতীয় সেটে। আমিই পেলাম মহামূল্যবান সেই পয়েন্টটি। আহ্, আমি বনে গেলাম ডিআরইউর ইতিহাসের সবচেয়ে ‘আনপ্রেডিক্টেবল চ্যাম্পিয়ন!’ এর দু’মাস পরেই বিএসপিএ’র বার্ষিক ক্রীড়া উৎসবে টেবিল টেনিসের এককের ফাইনালে ক্রীড়া ধারা ভাষ্যকার মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হই। সেই সঙ্গে একটি বিরল কীর্তিও গড়ে ফেলি। সেই মুহূর্তে সাংবাদিকদের দুটি সংগঠনের টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টেরই বর্তমান চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যাই। এমনটি এর আগে কখনই ঘটেনি! যাহোক, ডিআরইউ টিটিতে আমার সাফল্যের সংবাদটি ওইদিনই ৬ অক্টোবর আটটি অনলাইন, গাজী টিভিসহ একাধিক টিভি চ্যানেল এবং ৭ অক্টোবর জনকণ্ঠসহ ৭টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। চেয়েছিলাম পিস্তল, পেয়ে গেলাম কামান! কি অনাবিল চিত্তসুখ! ভরে গেল শূন্য বুক! -রুমেল খান
×