ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ

জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ক্ষণজন্মা এক ব্যক্তিত্ব

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮

জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ক্ষণজন্মা এক ব্যক্তিত্ব

২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি মহাপ্রয়াণে, না ফেরার দেশে চলে গেছেন জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্যার। তিনি ছিলেন এক প্রবল কর্মযজ্ঞের কাণ্ডারি, সারাজীবন যে কাজে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিজের মেধা, শ্রম আর ভালবাসা দিয়ে তিনি আমাদের চিরঋণী করে রেখে গেছেন। একজন চিকিৎসক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। শুধু রোগের উপশমই নয়, তিনি রোগ ও রোগী নিয়ে চিন্তা করতেন, ছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তার অসংখ্য গবেষণাপত্র দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সমাজের সবাইকে স্বাস্থ্যসচেতন করতে তিনি ছিলেন তৎপর। এদেশে ধূমপানের কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে তিনিই প্রথম ধূমপানবিরোধী কার্যক্রম শুরু করেন। তিনিই ‘আমরা ধূমপান নিবারণ করি’ বা ‘আধূনিক’-এর প্রতিষ্ঠা করেন। তার মূল বক্তব্যই ছিল ‘ধূমপানে বিষপান।’ এছাড়া তিনি বিভিন্ন ওষুধের অপ্রয়োজনীয় এবং অপব্যবহার রোধকল্পে জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারীদের অন্যতম ছিলেন। তিনি নিজে নেহায়েত যে সমস্ত ওষুধ প্রয়োজনীয় তাই রোগীর জন্য প্রেসক্রিপশনে লিখতেন। অযথা অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ওষুধ পরিহার করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। অনেক সময় রোগীদের অপ্রয়োজনীয় বা অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ছিল তার একদম অপছন্দ। প্রায়ই তাঁকে বলতে শুনেছি, রোগীর কাছ থেকে সুন্দর করে রোগের ইতিহাস নিয়ে এবং রোগীকে ভালভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেই অনেক রোগ শনাক্ত করা সম্ভব। অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর বিশাল অর্থের অপচয় ঘটে, যা অনেকেই বহন করতে অক্ষম। শুধু চিকিৎসক হিসেবেই নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের একজন প্রথিতযশা শিক্ষক হিসেবেও ছাত্রদের মাঝে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। বর্তমানে আমাদের দেশে যারা মেধাবী এবং দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে চিকিৎসার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাল শিক্ষক হিসেবেও শিক্ষাসেবা দিয়ে চলছেন, তাদের শিক্ষাগুরু হিসেবে স্যারের অবদান অপরিসীম। ব্যক্তি জীবনে স্যার ধর্মের অনুশাসন মেনে চলতেন। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সত্য ভাষণে অকপট, সততা আর সত্যের পথে অবিচল এই মানুষটি সব সময়ই ছিলেন আন্তরিক, মমতাপূর্ণ ও স্নেহার্দ্র। একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে ইসলাম স্যার ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির, অন্তত বাহ্যিকভাবে তাই মনে হতো। কাজের ক্ষেত্রে কোন অবহেলা তিনি সহ্য করতেন না। নিজে নিয়মের অনুশাসন মেনে চলতেন, অন্যদেরও নিয়ম অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করতেন। এ ক্ষেত্রে কোন বিচ্যুতি হলে তিনি কঠোর শাসন করতেন, এমনকি অনেক সময় গালমন্দও করতেন। কিন্তু এসব ছিল শুধু সঠিক কাজটা আদায় করার জন্যই। যাকে বকাঝকা করতেন, দেখা যেত পরমুহূর্তে তাকেই আবার সস্নেহে আলিঙ্গন করছেন। তিনি শুধু ছড়ি হাতে শাসক ছিলেন না, পিতৃসম মমতাকারীও ছিলেন। প্রায়ই তিনি বলতেন, ‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করেন যিনি।’ তাঁর কর্মপদ্ধতি আর কর্মক্ষেত্রে কঠোর মনোভাবের জন্য অনেকেই আড়ালে তাঁর সমালোচনা করতেন। কিন্তু স্যার ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আমি অনেক সময় দেখেছি বাইরে তাঁর সম্পর্কে বিদ্বেষ পোষণকারী এবং সমালোচনাকারীরাও তাঁর সম্মুখে নতজানু হয়েই থাকতেন। সামনাসামনি কিছু বলার মতো সাহস কারোরই ছিল না বরং সবাই মুগ্ধকণ্ঠে প্রশংসা করতেন। স্যার নিজেও জানতেন যে তার সমালোচকের অভাব নেই, শত্রুর অভাব নেই। আমি অনেকবার স্যারের মুখ থেকে শুনেছি ‘সমালোচনাকারী এমনকি শত্রু থাকাও ভাল। তাহলে আরও ভাল কাজ সতর্কভাবে করা যায়।’ তবে এ কথাও উনি বলতেন, ‘শত্রুকে চিনে রাখা ভাল, তাহলে আপনি সতর্ক থাকতে পারবেন।’ প্রশাসন চালাতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক গড়ে উঠলেও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পর্ক সবার সঙ্গে ভালই ছিল। স্যারকে আমি অনেক দিন বলতে শুনেছি ‘প্রশাসন চালাতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে মতবিরোধ, মনোমালিন্য প্রায়ই হয়ে থাকে, তারপরও তাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ হয়েছে বলে আমি মনে করি না।’ নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম স্যার ছিলেন চৌকস। নিজের বিচক্ষণতার ওপর তাঁর আত্মশক্তি ও আত্মপ্রত্যয় ছিল অত্যন্ত প্রবল আর আস্থা ছিল অবিচল। কবি কাজী নজরুল ইসলামের এক বিশিষ্ট বাণী স্যার মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাঁর এক ডায়েরিতে ওই বাণীটি লেখা ছিলÑ ‘বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেও না তাহার কাছে। নড়াচড়া করে, তবুও সে মড়া, জ্যান্ত সে মরিয়াছে। শয়তান তারে শেষ করিয়াছে, ইমান লয়েছে কেড়ে, পরাণ গিয়াছে মৃত্যুপুরীতে ভয়ে তার দেহ ছেড়ে।’ স্যার কাজ করতেন নিজের পদ্ধতিতে, শাসন করতেন কঠোরহস্তে। নিপুণ হাতে তিনি সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন, এতে কাজের গতি বাড়ত, সমন্বয় ঠিক থাকত। এক্ষেত্রে তার ভূমিকার জন্য অনেকেই তাঁকে আড়ালে সমালোচনা করতেন। কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন বনেভলেন্ট ডিক্টেটর। আর এ জন্যই তিনি তৎকালীন পিজি হাসপাতালের মতো একটি প্রতিষ্ঠানকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা বর্তমানে দেশের একমাত্র চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। সব আমলাতন্ত্র, রাজনীতি আর দুর্নীতিকে পায়ে দলে নিজ হাতে এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, সারা জীবন তিনি আরও অসংখ্য সংস্থা আর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি (ইউএসটিসি) প্রতিষ্ঠা তাঁর কর্মযজ্ঞের অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে। দেশ ও জাতির প্রতি তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য দেশী ও বিদেশী পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপকের পদ অলঙ্কৃৃত করেন। শেষ জীবনে ইসলাম স্যার বহুদিন শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু সেই অবস্থায়ও তিনি কাজ করে গেছেন, নিত্যনতুন সৃষ্টি করেছেন, দক্ষ হাতে প্রশাসন চালিয়ে গেছেন। তিনি বলতেন, আল্লাহর রহমতে আর মানুষের দোয়ায় বেঁচে আছি, হয়ত আমার কাজ শেষ হয়নি বলেই। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’ চিরসত্য এই বাণীর মতোই আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন এক বর্ণাঢ্য ও কর্মময় জীবন শেষে মহান, ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তিত্ব। তাঁর অনন্য সাধারণ কীর্তি, কর্মযজ্ঞ আর অমোঘ ব্যক্তিত্বের স্মৃতি ডাক্তার সমাজসহ সমগ্র জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে অবশ্যই স্মরণ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তাঁর কর্মস্পৃহা বুকে নিয়ে, মাটি ও মানুষের সেবার মানসিকতা ধারণ করে যদি আমরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারি, তবে তাই হবে এই মহান ব্যক্তির প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন। লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×