ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাধ চক্রের দৌরাত্ম্য

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮

অপরাধ চক্রের দৌরাত্ম্য

নির্বাচনের সময় যতই আসছে ঘনিয়ে, ততই বাড়ছে অপরাধ জগতের সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য। যদিও পাল্টেছে তাদের ধরন। অধিকাংশই রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সর্বত্র তৈরি করছে অরাজকতা। এমনিতেই দেশের বিভিন্ন নির্বাচনকালীন সময়ে ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের’ এসব অপরাধীর কদর বেড়ে যায়। ভাড়াটে হিসেবে তারা কোন না কোন প্রার্থীর পক্ষে অপরাধমূলক তৎপরতা চালায়। এর বাইরে সারা বছরই চলে তাদের চাঁদাবাজি। তাদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয় মাদক ব্যবসা। রাজধানীর সংঘবদ্ধ আন্ডারওয়ার্ল্ডের শুরুটা ছিল বিশ শতকের আশির দশকে। চাঁদাবাজির সীমানা নিয়ে আধিপত্যকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল সেভেন স্টার, ফাইভ স্টার নামে সন্ত্রাসী গ্রুপের। দিনদুপুরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে চলত এসব সন্ত্রাসীর অস্ত্রের মহড়া। বেশ কয়েকটি এলাকায় বোমাবাজি ছিল নিত্যদিনের চিত্র। ভয়ে ভীত হয়ে ব্যবসায়ীরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে না জানিয়েই পৌঁছে দিত মোটা অঙ্কের অর্থ। এই অর্থের ভাগবাটোয়ারা নিয়েও নিজেদের মধ্যে চলত দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এসব অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। আন্ডারওয়ার্ল্ড আগের মতো না থাকার কারণ বর্তমান সরকারের কঠোর পদক্ষেপ। প্রকাশ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অবস্থান দেখা না গেলেও, তাদের নাম ডাক ছড়িয়ে আছে। অনুসারী সন্ত্রাসীরা তাদের নাম করে ভয় দেখিয়ে, অস্ত্র প্রদর্শন করে চাঁদা আদায়ের কাজটি অব্যাহত রেখেছে। চাঁদা প্রদানকারীরা হুমকির মুখে ভয়ে অভিযোগ করতে সাহস পায় না। তাই থানায় অভিযোগ করার রেকর্ড মেলে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি চাপা পরে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও কারও সঙ্গে রয়েছে তাদের দহরম-মহরম, এমনকি চাঁদা ভাগাভাগিও। অনেকে দেশত্যাগ এবং আত্মগোপনে ছিল। পরে কতিপয় রাজনীতিক নামধারীর আশ্রয় পেয়ে এরা অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। চাঁদাবাজির সঙ্গে যোগ হয়েছে মাদক ব্যবসা। ইয়াবা নামক জীবনঘাতী ব্যবসার নেটওয়ার্ক এখন তাদের হাতেই নিয়ন্ত্রিত। ঢাকাসহ সারাদেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ওই নেটওয়ার্ক এখন বিস্তৃত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে চলা এই ব্যবসায় অপরাধীরা সহযোগী হিসেবে পাশাপাশি অবস্থান করছে। অনেক পুলিশ ইয়াবাসহ ধরা পড়ে চাকরিচ্যুত হলেও ব্যবসার গতি কমেনি, বরং ক্রমশ বাড়ছে। এলাকায় ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের আশ্রয়ে। ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনসহ অন্যান্য মাদক হারিয়ে গেছে ইয়াবার দৌরাত্ম্যে। ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় ব্যবহার করে প্রকাশ্যে তারা এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আবার এদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ও সরকারী দলের তত্ত্বাবধানে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন সংগঠনের পদবিতে আসীন থাকার কারণে গ্রেফতার হলে ছাড়িয়ে আনার তদবির চলে। দলীয় পরিচয় থাকার কারণে এদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া যাচ্ছে না। ইয়াবা ব্যবসায় সংসদ সদস্য থেকে অন্য জনপ্রতিনিধিদের জড়িত থাকার খবর বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রায় সর্বজনবিদিত। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীরা এখন চাঁদাবাজিতে তেমন সক্রিয় আর নেই। বরং ইয়াবা ব্যবসায় অধিক আয়ের সুবিধার কারণে তারা ইয়াবা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। পুলিশী ভাষ্যে বলা হয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তাদের নেটওয়ার্ক টিকিয়ে রাখতে এসব সন্ত্রাসীকে মাসোহারা দিয়ে থাকে। পুরনো সন্ত্রাসীরা এখন নানা কারণে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হলেও তাদের অনেকের নামে অন্য সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজিতে সক্রিয় রয়েছে। অপরাধ জগতের ‘খ্যাতিমান’ অনেক সন্ত্রাসী নিহত, অনেকে কারাবন্দী রয়েছে। কারাগার থেকেও সন্ত্রাস পরিচালনার নির্দেশ আসে বলে প্রচার রয়েছে। ‘কালা জাহাঙ্গীর’ ও ‘পিচ্চি হান্নান’ এর নাম দেশখ্যাত। এদের অনুসারীর সংখ্যা কত জানা না গেলেও এদের নামে চাঁদাবাজি চলছে। চলতি বছর নির্বাচনের বছর। নির্বাচনী কাজে ভোটকেন্দ্র দখল, প্রতিপক্ষকে হুমকি-ধমকি, ভোটারদের কেন্দ্রে না আসার জন্য সতর্ক করার কাজে এদের ব্যবহার করা হতে পারে। এদের রুখবে তেমন সাধ্য বুঝি কারও নেই। তবুও এই আন্ডারওয়ার্ল্ড জগতের বিনাশ চায় দেশবাসী।
×