ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত চট্টগ্রাম!

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২২ জানুয়ারি ২০১৮

মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত চট্টগ্রাম!

বঙ্গোপসাগরের তীরে পাহাড় নদী ঘেরা চট্টগ্রাম প্রকৃতির এক স্বর্গরাজ্য চট্টগ্রাম। পাহাড়, সমুদ্র আর নদী বেষ্টিত একটি সুন্দর শহর শুধু নয়, জেলা ও বিভাগীয় শহর। ছোট-বড় পাহাড়, টিলা নিয়ে গড়ে উঠা এ শহর খুবই সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন। ছিল অনুকূল পরিবেশ। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সমুদ্র ও পাহাড় অসংখ্য ছোট-বড় নদীর এক অপূর্ব মিলন ক্ষেত্র। প্রাচ্যের রানী খ্যাত এই চট্টগ্রাম, এখন আর এই নামে ডাকা যায় না। চট্টগ্রামের সেই বৈচিত্র্য ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে। গবেষকদের মতে প্রায় দুই হাজার বছর আগে বন্দর শহর চট্টগ্রামের গোড়াপত্তন। পরিবেশবাদীদের মতে, বাংলাদেশের প্রকৃতির অন্যতম উপাদান নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, পাহাড়, বন ও বন্যপ্রাণী। বিভিন্ন অঞ্চলের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, পাহাড়, বন ও বন্যপ্রাণী মিলে গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। গড়ে উঠেছে প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ। প্রকৃতির অন্যতম উপাদান নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, বন ও বন্যপ্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর নেমে আসে বিপর্যয়। প্রকৃতিতে এদের ভূমিকা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে প্রতিনিয়ত এসব উপাদান ধ্বংস হচ্ছে। মানবসৃষ্ট দুর্যোগে বন ধ্বংস, পাহাড় নিধন, অবৈধ বন্যপ্রাণী শিকার, দারিদ্র্য, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্প কারখানার দূষণে চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। বনভূমি উজাড়ের পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর দাবদাহে যতটা পরিবেশের ক্ষতি হয় তার চেয়ে শতগুণ বেশি হয় মানবসৃষ্ট কারণে। চট্টগ্রামের লাইফলাইন হালদা জনশ্রুতি রয়েছে, পাহাড়ী অঞ্চলের সালদা গ্রামের সালদা নামক ছড়া থেকে হালদার নামকরণ। হালদা নদী পার্বত্য অঞ্চল খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার পাতাছড়া ইউনিয়নের পাহাড়ী ক্রিক থেকে উৎপন্ন হয়ে পাহাড়ের বাঁক ধরে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম শহরের চাঁদগাঁও হয়ে পড়েছে কর্ণফুলীতে। হালদা নদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ দেশেই উৎপত্তি হয়ে এ দেশেই শেষ হয়েছে। সে হিসেবে এ নদী সম্পূর্ণরূপে আমাদের। প্রায় ১০০ কিমি দৈর্ঘ্যরে হালদা নদীতে মিলিত হয়েছে ৩৬টি ছড়া। এর মধ্যে খালের সংখ্যা ১৯টি। ১০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ নদীর ২৯ কিলোমিটার অংশ সারাবছর বড় নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে। প্রতিবছর হালদা নদীতে বর্ষার ঘনবৃষ্টির অমাবস্যার রাতের একটি বিশেষ মুহূর্তে রুই জাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়ে। কার্প জাতীয় মাছের উৎকৃষ্ট প্রজনন ক্ষেত্র এ হালদা নদী। হালদা নদী প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের এক স্বর্গীয় ক্ষেত্র। ঘন মেঘের দিনে দুপুরে কিংবা বিকেলেও ডিম ছাড়ে মাছ। হালদা শুধু মৎস্যসম্পদের জন্য নয়- এটি যোগাযোগ, কৃষি ও পানিসম্পদেরও একটি বিশাল উৎস। এই হালদা নদী থেকেই চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে চট্টগ্রাম মহানগরের ৬০ লাখ মানুষের পানির চাহিদা মেটায়। রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ পোনার জন্য এ নদীর আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, বাঁক কাটা, বালি উত্তোলন, ইটভাঁটির নদীর মাটি ও পানি ব্যবহার, রাবার ড্যাম স্থাপন, নদীর তীরে তামাক চাষ ও যন্ত্রচালিত নৌযান থেকে তেল ছড়িয়ে পড়া, মা-মাছ নিধন, এতসব মানবসৃষ্ট দূষণসহ নানা কারণে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও চট্টগ্রামের মানুষের লাইফলাইন খ্যাত এ নদী মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের মুখে। কল-কারখানা ও বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা দেশের নদী দূষণের কারণ শিল্প-কারখানা, গৃহস্থালি ও মানব বর্জ্য। দেশের বড় ও মাঝারি ধরনের প্রায় ৮ হাজার শিল্প-কারখানা মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, আশুগঞ্জ, ঘোড়াশাল প্রভৃতি এলাকার শিল্প-কারখানাগুলোর মারাত্মক ক্ষতিকর বর্জ্য পার্শ্ববর্তী নদীগুলোতে নিঃসরণ করছে। এসব এলাকার খাল-বিল-নদী মারাত্মক দূষণের শিকার। দূষণকারী শিল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে চামড়াশিল্প, ওষুধশিল্প, রাসায়নিক সার কারখানা, টেক্সটাইল, ডায়িং এ্যান্ড প্রিন্টিং, রং-কাগজ শিল্প প্রভৃতি। ভরাট হয়ে যাচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর ডোবা, জলাশয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে বলা হয়, চট্টগ্রামের অভ্যন্তরের ৩৬টি খালের সীমানা কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে এদের অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন। অন্যদিকে অস্তিত্ব বাঁচাতে লড়ছে হালদা, কর্ণফুলী ও সাঙ্গু। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে উৎপন্ন খালগুলো। একদিকে অবৈধ স্থাপনা, অন্যদিকে কল-কারখানার দূষিত উপাদান ও ৪৫ লাখ নগরবাসীর বর্জ্য নদী-নালা-খালের অপমৃত্যু ঘটাচ্ছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী- নালা-খালগুলোর প্রায় প্রতিটিই মানুষের আক্রমণের শিকার। পাহাড় নিধন ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের পর থেকে ব্যাপকভাবে পাহাড়কাটা শুরু হয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত ধরে পাহাড় ধ্বংস হলো। পুকুর ভরাট হলো। কোথাও পাহাড় হলো আবাসিক এলাকা। কোথাও হলো সরকারী অফিস অথবা ডিসির বাংলো। ব্রিটিশ শাসনামলে কিছু কিছু পাহাড় কাটা হয়েছে। তবে শহরের বিস্তৃতি বাড়ানোর জন্যে পাকিস্তান আমলেই সরকারীভাবে পাহাড় কাটা শুরু হয়। পতেঙ্গা বিমানবন্দর, স্টিল মিল, ইস্টার্ন রিফাইনারি এবং কালুরঘাট শিল্প এলাকা ছাড়াও চট্টগ্রামের প্রায় সব অভিজাত এলাকা যেমন- নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, খুলশী আবাসিক এলাকা ইত্যাদি পাহাড় কেটেই গড়ে তোলা হয়েছে। ১৭৬১ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণ করার পরই পাহাড় এবং বন-জঙ্গল কেটে চট্টগ্রাম শহরের উন্নয়ন শুরু হয়। মূলত ১৯৮০ দশক থেকে ১৯৯০-এর দশকের মধ্যেই চট্টগ্রাম শহরে সবচেয়ে বেশি পাহাড় ও টিলা কাটা হয়েছে। নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পাহাড় কেটে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করা হয়েছে। সেই কাটা পাহাড়ের মাটি বৃষ্টি হলেই পানির সঙ্গে মিশে নালা-নর্দমায় এসে জমা হয়, পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অতিবৃষ্টি মৌসুমী জোয়ারের কারণে শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা একেবারে পানির নিচে তলিয়ে যায়। নগরবাসী পড়ে যায় চরম দুর্ভোগে। সৃষ্টি হয় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। সাম্প্রতিক পাহাড় ধস বাংলাদেশের প্রায় ১৮ শতাংশ পাহাড়ী অঞ্চল যার সিংহভাগই বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থিত। উত্তর দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে বিস্তৃত প্রায় হাজার ফুট পর্যন্ত উচ্চতার এই পাহাড়ী ভূমিরূপ চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য এক মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ের উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টির সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। অপরিকল্পিত পাহাড় কাটার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহে ও ভয়াবহ পাহাড় ধসে প্রাণহানি নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি সম্প্রতি বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড়ের ইতিহাসে ঘটে গেছে এক মহাবিপর্যয়। তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির জানমাল ও সহায়সম্বল ভয়াবহতম ক্ষতির শিকার হয়েছিল। ভোর থেকে শুরু হয় বিপর্যয়। সকাল ১০টা থেকে ঘণ্টাদুয়েক সময়ের মধ্যে একযোগে বড়, মাঝারি ও ছোট ধরনের পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এর আগের রাতে ভারি বর্ষণের জের হিসেবে বিভিন্ন পাহাড়ে সৃষ্ট ফাটল থেকে ভূমি ধসের ঘটনা ঘটে। মৃতের সংখ্যা প্রায় ১৭১ জন। বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে আমাদের জনসংখ্যা অনেক আগেই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। আর এখন তা অসহনীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান, রাস্তা-ঘাট, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি তৈরি করতে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অপরিকল্পিতভাবে কাটতে হয়েছে পাহাড়। পাহাড়ে বড় গাছ নেই গাছের শেকড় প্রাকৃতিকভাবে মাটি ধরে রাখে, সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অতি বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে পড়ার ঘটনা ঘটছে। যে কোন মূল্যে প্রয়োজন জীবনের স্পন্দন পানি ও অক্সিজেনের উৎসসমূহকে সুরক্ষিত রাখা, প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়া, বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সবুজ বন সৃজন করা সময়ের দাবি। প্রকৃতিকে পরিমিত শাসন সভ্যতার ক্রমবিকাশের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু তা অতি শাসনে রূপ নিলেই ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব অনুযায়ী প্রকৃতি মানুষের ওপর প্রতিশোধ নেবেই-নেবে। প্রকৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত ও রিক্ত না করে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটালে, আমাদের মাতৃভূমি হবে বাসযোগ্য এবং আমরা থাকব নিরাপদ ও সুরক্ষিত। জলাবদ্ধ চট্টগ্রাম শহর মানবসৃষ্ট দুর্যোগে জলাবদ্ধতায় বন্দর শহর চট্টগ্রামের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে, কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতে নগর আর মানুষের বসবাসের উপযোগী থাকে না। অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যায়। চট্টগ্রামের প্রকট জলাবদ্ধতার নেতিবাচক প্রভাব শুধু ওই নগরের বাসিন্দাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর আমদানি-রফতানি তথা আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার এবং আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের ৪০ শতাংশ খালাস করা হয় সেখানে। টানা বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে আমদানিপণ্য জাহাজ থেকে খালাস করা বাধাগ্রস্ত ও বিলম্বিত হয়, পাইকারি বাজারগুলো থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। জলাবদ্ধতা নিয়ে বিভিন্ন সেবা সংস্থা আশার বাণী শোনালেও জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান দূরের কথা; বরং বর্তমান দুরবস্থায় দৃশ্যমান হচ্ছে যে, সমস্যাটি আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। মৃতপ্রায় নগরের খাল-বিল সবচেয়ে আলোচিত বিষয় চট্টগ্রাম শহরে কেন এই জলাবদ্ধতা? ১৯৬৯ সালের মাস্টারপ্ল্যান ও আরএস সিট অনুযায়ী চট্টগ্রাম মহানগরে ছোট-বড় খাল ছিল ৭০টি। কিন্তু বর্তমানে ৪৬টি খালই অস্তিত্বহীন। একসময় চট্টগ্রাম বন্দর চালু হওয়ার আগে মহেশখালে বিদেশী জাহাজ ভিড়ত যথারীতি পণ্যদ্রব্য খালাসও হতো। কোথায় সেই মহেশখাল? মহেশখালকে আমরা কার্যত নিঃশেষ করে দিয়েছি। যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করেছি। ফলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। নাগরিকরা যতক্ষণ পর্যন্ত এটির ভয়াবহতা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত, কোন সেবা সংস্থার পক্ষেই সম্ভব নয় জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে এ শহরকে রক্ষা করা। শহরের পানি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ার জন্য শহরের উত্তর-দক্ষিণ আর পূর্ব-পশ্চিমে একাধিক খাল ন্যূনতম ৫০ থেকে ৬০ ফুট প্রশস্ত ছিল, যার অন্যতম চাক্তাই খাল। এক সময় সেই খালে নৌকা চলত, ব্যবসায়ীরা এই চাক্তাই খাল দিয়ে বহদ্দারহাট ও চকবাজারে মালামাল আনা নেয়া করত। স্পিডবোটে গ্রাম থেকে শহরে যাওয়া আসা করতেন বিত্তবান ব্যক্তিরা। কালক্রমে চট্টগ্রামের দখলবাজরা সেই খাল বহু আগেই দখল করে ফেলেছে। বর্তমানে কোথাও কোন খেলার মাঠ অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। এমন একটা জঞ্জালপূর্ণ শহরে জলাবদ্ধতাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়া তো অনিবার্য। চট্টগ্রাম শহরের সমস্যা দূর করা কোন একজন মেয়র কিংবা প্রশাসকের পক্ষে সম্ভব নয়, যদি না এ শহরের সাধারণ নাগরিকরা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প... বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে সেবা সংস্থাসমূহের সমন্বয়ের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন সমবায় মন্ত্রণালয় ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি টাক্সফোর্স গঠন করা হয়েছিল বহু আগে। ওই টাক্সফোর্সে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আজম নাসির উদ্দিনকে আহ্বায়ক, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), ফায়ার সার্ভিস এর প্রতিনিধি, পরিবেশ অধিদফতর, চসিকের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে সদস্য করা হয়েছে। সদস্য সচিব হিসেবে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে অন্তর্ভুক্ত করে গত বছর আগস্ট মাসে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন সমবায় মন্ত্রণালয় (সিটি কর্পোরেশন শাখা-২) উপ-সচিব কর্তৃক টাক্সফোর্স গঠন সম্পর্কিত এ আদেশ জারি করা হয়। চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে টাক্সফোর্সের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ, নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মোটিভেশনাল ক্যাম্পেইন, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহের পাহাড় সুরক্ষা, নির্বিচারে পাহাড় ও গাছ কাটা বন্ধ করা, কর্ণফুলী নদী খনন করে নাব্য ফিরিয়ে আনা, হালদা নদী থেকে অপরিকল্পিত বালি উত্তোলন বন্ধকরা, জেলা ও নগরের দখল হয়ে যাওয়া শতাধিক খাল বিল নালা উদ্ধার করে খননের উদ্যোগ গ্রহণ, খালগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা, কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত খালগুলোর মুখে স্লুইসগেট বা জলকপাট নির্মাণ, নগরজুড়ে অপরিকল্পিতভাবে ঘর-বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা, বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরিতে আইনের সঠিক প্রয়োগ করা সম্ভব হলে এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমোদিত প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে বৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা থেকে চট্টগ্রাম শহর স্থায়ীভাবে মুক্ত হবে। আসুন, সবাই মিলে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে চট্টগ্রামের জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতির রানীখ্যাত চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার, হিউয়েন সাঙয়ের ঘুমন্ত পরী চট্টগ্রাম শহরকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। লেখক : শিক্ষাবিদ Email: [email protected]
×