ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কনডেম সেলে বছরের পর বছর-নারীর ফাঁসি কার্যকর হয় না যে কারণে

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২২ জানুয়ারি ২০১৮

 কনডেম সেলে বছরের পর বছর-নারীর ফাঁসি কার্যকর হয় না যে কারণে

শংকর কুমার দে ॥ দেশের স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৪৭ বছরে কনডেম সেলে থাকা ফাঁসির আসামি কোন নারীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়নি। এমনকি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা ভিক্ষার জন্যও আবেদন পাঠানো হয়নি কোন নারী ফাঁসির আসামির। এমনকি কারাগারগুলোতে নারীদের ফাঁসি কার্যকর করার কোন ফাঁসির মঞ্চও নেই। বর্তমানে দেশের কারাগারগুলোতে ৩৮ জন নারী ফাঁসির আসামি রয়েছে কনডেম সেলে। যে কারণে নারী আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয় না তার নেপথ্য কাহিনী কারাগার সূত্রে জানা গেছে। কারাগার সূত্র জানায়, সর্বোচ্চ আদালতের আপীল বিভাগে গেলেই নারী আসামির ফাঁসির দন্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন দন্ড দেয়ায় ফাঁসির দন্ড থেকে বেঁচে যায় অনেক নারী। সারাদেশের কারাগারগুলোর কনডেম সেলে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত নারী আসামি আছে ৩৮ জন। সর্বশেষ শিল্পপতি লতিফুর রহমানের কন্যা শাজনীন হত্যার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি এস্তেমা খাতুন মিনুর ফাঁসির দন্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন দন্ড দেয় সর্বোচ্চ আদালত। কারাগার সূত্র জানায়, শিল্পপতি লতিফুর রহমানের কন্যা শাজনীন হত্যার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি এস্তেমা খাতুনের ফাঁসির দন্ড কমিয়ে দেয়ার আগে পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ও মা হত্যাকান্ডর দায়ে মেয়ে ঐশীর ফাঁসির দন্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন দন্ড দেয় সর্বোচ্চ আদালত। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ৩৮ জন ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত নারী আসামি কনডেম সেলে অবস্থান করছে। ফাঁসির অন্য আসামিরা সাজা কমানো আসামিদের মতোই সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করার প্রতীক্ষায় আছে বলে কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের অনেকেই। কারাগার সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন কারাগারের কনডেম সেলে ৩৮ জন মহিলা ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে কাসিমপুর মহিলা কারাগারে ১৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯ জন, সিলেটে ১ জন, রংপুরে ৩ জন, খুলনায় ৭ জন, বরিশালে ২ জন ও ময়মনসিংহে ১ জন আসামি রয়েছে। নিম্নে আদালত থেকে এদের ফাঁসির রায় হওয়ার পর থেকে এরা আছে কনডেম সেলে। এদের মধ্যে অনেকেই উচ্চ আদালতে আপীল করেছে। আবার কেউ কেউ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে আপীল করতে পারে নি। কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিভিন্ন কারাগারে রাজনীতিক, সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, আইনজীবী চিকিৎসকসহ সহস্রাধিক ফাঁসির আসামি রয়েছে কনডেম সেলে, যাদের অনেকেরই ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে নিম্ন আদালত ফাঁসির রায় দিলে এক পর্যায়ে উচ্চ আদালত থেকে মহিলার ক্ষেত্রে দন্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন বা আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া হয়ে থাকে। সুতরাং আদালতের নির্দেশনার কারণেই কোন নারীর ফাঁসি দন্ড কার্যকর করা হয়নি। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত মহিলা বা পুরুষ যাই হোক না কেন, তাদেরকে কনডেম সেলেই থাকতে হয়। কারাগার সূত্র জানায়, মহিলা আসামিদের মধ্যে অধিকাংশই লুডু খেলে সময় কাটায়। আত্মীয়-স্বজন এলে জামিন করানোর জন্য অনুনয় বিনয় জানায়। বিগত ৪৭ বছরে অনেক নারী বন্দীর ফাঁসির দন্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন দন্ড দিয়েছে উচ্চ আদালতের আপীল বিভাগ। সর্বশেষ স্ত্রীসহ পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের দেয়া তাদের মেয়ে ঐশী রহমানের মৃত্যুদন্ডর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ডর আদেশ দেয় হাইকোর্ট। দন্ড কমানোর কারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যায় আদালত বলে, পাঁচটি কারণে এ দন্ড কমানো হয়। হত্যাকান্ডর সময় ঐশী মাদকাসক্ত ছিল। ১৪ বছর বয়স থেকেই সিসা, ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল এসব নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করত। ঐশী বংশগতভাবে মানসিক রোগী। তার চাচা-দাদি-খালা অনেকের মাঝেই মানসিক রোগের লক্ষণ আছে, যা তার মাঝেও ছোটবেলা থেকে বিদ্যমান। হত্যাকান্ডর ঘটনার দ্বিতীয় দিনের মাথায় সে আত্মসমর্পণ করেছে। এতে বোঝা যায়, সে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ এমন এক আইনজীবী বলেন, নারী আসামিদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, আপীল বিভাগে যাওয়ার পর ফাঁসির রায় আর বহাল থাকে না। সাধারণ কারা বিধি অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকরের ক্ষেত্রে আসামি বয়স্ক কিনা, তার শারীরিক অসুস্থতা আছে কিনা, আসামি নারী হলে গর্ভবতী কিনা এসব বিবেচনায় তার মৃত্যুদন্ড হ্রাস ও স্থগিত করা হয়। আগে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত নারী আসামিদের মৃত্যুদন্ড না দিয়ে সাজা কমিয়ে দেয়া হতো। এ বিষয়ে অলিখিত প্রথা ছিল।
×