ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

’১৭ সালে ৬৪ জেলায় ১৫ হাজার ৮৯৮ মামলা নিষ্পত্তি

অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের জন্য সরকারের আইনী সহায়তা

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ২১ জানুয়ারি ২০১৮

অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের জন্য সরকারের আইনী সহায়তা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ২০১০ সালে মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী পূর্ণিমা সমাদ্দার স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে আসামিরা ধর্ষণের চেষ্টার পর তাকে হত্যা করে। এ ঘটনায় ওই বছরের ৪ আগস্ট মামলা দায়ের হয় যা মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার মামলা নং-২। মামলার বিচার শেষে ২০১১ সালে বিচারিক আদালত স্কুলছাত্রী পূর্ণিমাকে অপহরণের অভিযোগে তিন আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। এর বিরুদ্ধে আসামিরা হাইকোর্টে আপীল করে। নিম্ন আদালতে মামলা পরিচালনায় সহায়তাসহ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করা হয়। অবশেষে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি পূর্ণিমা সমাদ্দারের অপহরণ, ধর্ষণ চেষ্টা ও হত্যা মামলায় তিন আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে যাবজ্জীবন দণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। পূর্ণিমার মতো নির্যাতনের শিকার অসহায় দরিদ্র নারীরা সরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত লিগ্যাল এইড সংস্থার মধ্যস্থতায় বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা পাচ্ছেন। সরকারী আইনগত এ সেবা শুধু নারীদের জন্যই প্রযোজ্য নয় এতে সমান অধিকার রয়েছে সকলের। ২০১৭ সালে দেশের ৬৪ জেলায় জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান (লিগ্যাল এইড) কমিটির মাধ্যমে সরকারী খরচে অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের ১৫ হাজার ৮৯৮ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে সরকারী খরচে অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের ১৫ হাজার ৮৯৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০১৬ সালে নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ২২০টি। পূর্বের বছরের তুলনায় মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কারাগারে আটক ১২ হাজার ৮৯৬ জনকে ২০১৭ সালে দেশের ৬৪ জেলা জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান কমিটির মাধ্যমে আইনগত সহায়তা দেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে এ সহায়তা পেয়েছেন ৯ হাজার ৬৯৪ জন। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা ২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৮১ হাজার ৩১২ জনকে সরকারীভাবে আইনী সেবা প্রদান করেছে। এর মধ্যে ৯৮ হাজার ৩০৮ জন নারী আইনী সহায়তা নিয়েছেন। এছাড়া বাকি ৯১ হাজার ৫৫৭ জন পুরুষ এবং ৪৯২ শিশু এ সহায়তা নেয়। আইনী পরামর্শ গ্রহণেও নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে দেওয়ানি কার্যবিধিতে এডিআর বাধ্যতামূলক করায় এ সেবা গ্রহনের আগ্রহ আরও বেড়েছে। জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থার উপপরিচালক আবেদা সুলতানা বলেন, ‘দেশের বেশিরভাগ নারী পারিবারিক সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হন। এ নারীদের বেশিরভাগই আর্থিকভাবে অসচ্ছল। আর আর্থিক অসচ্ছল নারীদের আইনী সহায়তা দিতে লিগ্যাল এইড অফিসগুলো উন্মুক্ত আছে। দিন দিন সরকারী লিগ্যাল এইড অফিসগুলো নারীদের ভরসাস্থলে পরিণত হচ্ছে। নারীর পাশাপাশি পুরুষ ও শিশুদেরকে আইন সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।’ এ সেবা কার্যক্রম আরও জোরদার করতে দেশব্যাপী আগামী ২৮ এপ্রিল ৬ষ্ঠ বারের মতো জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালন করা হবে। সরকারের এই আইনী সেবা প্রদানের বিষয়ে ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষে ২০১৩ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২৮ এপ্রিলকে ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস’ ঘোষণা করা হয় এবং ওই বছর থেকেই প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল জাতীয়ভাবে আইনগত সহায়তা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে এ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বিরোধ হলে শুধু মামলা নয়-লিগ্যাল এইড অফিসে আপোসও হয়’। যাদের জন্য আইনগত এই সহায়তা ॥ জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, ‘অসচ্ছল বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি’ যে কেউ এ সহায়তা পাবেন। এ ক্ষেত্রে সুপ্রীমকোর্টে আইনী সহায়তা পাওয়ার জন্য ওই ব্যক্তির আয় বছরে গড়ে দেড় লাখ এবং অন্যান্য আদালতের ক্ষেত্রে এক লাখ টাকার মধ্যে হতে হবে। এ ছাড়া কর্মক্ষম নন, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন বা বার্ষিক দেড় লাখ টাকার উর্ধে আয় করতে অক্ষম এমন মুক্তিযোদ্ধা, শিশু, বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এমন ব্যক্তি, ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ মাতা, পাচারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত নারী, এসিডে দগ্ধ নারী বা শিশু, উপার্জনে অক্ষম ও সহায়-সম্বলহীন প্রতিবন্ধী এ সুবিধার অধিকারী হবেন। হেল্পলাইন ॥ ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টোল ফ্রি জাতীয় হেল্পলাইন সেবার কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। যে কোন ব্যক্তি হেল্পলাইনের ১৬৪৩০ নম্বরে বিনা খরচে ফোন করে প্রাথমিক আইনী পরামর্শ ও সেবা গ্রহণ করতে পারেন। সরকারী ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ সেবা দেয়া হয়। সরকারী আইনী সেবা প্রদান ‘ফ্রি জাতীয় হেল্পলাইন নং ১৬৪৩০’-এর মাধ্যমে ২০১৭ সালে ১৫ হাজার ৩২০ জনকে আইনগত পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে এপ্রিল-ডিসেম্বর পর্যন্ত হেল্পলাইনে আইনগত সেবা গ্রহণ করেছিলেন ৭ হাজার ৭৬ জন। এ আইনী সেবার সফল বাস্তবায়নে অসহায় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অবহিতকরণসহ সরকারের জনসচেতনতামূলক কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। এ আইনী সহায়তা কার্যক্রম গতিশীল ও সেবা-বান্ধব করার লক্ষ্যে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার আওতায় প্রত্যেক জেলায় জেলায় লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপনসহ বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট, চৌকি আদালত এবং শ্রম আদালতে লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম চালু করা হয়। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসগুলোকে এখন শুধু আইনী সহায়তা প্রদানের কেন্দ্র হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। মামলা জট কমানোর লক্ষ্যে এ অফিসগুলোকে ‘এডিআর কর্নার’ বা ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কেন্দ্রস্থল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সরকারী আইনী সেবা প্রদান আরও বিস্তৃত ও সহজ করার লক্ষ্যে টোল ফ্রি জাতীয় হেল্পলাইন ১৬৪৩০ চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে যে কেউ বিনামূল্যে আইনী পরামর্শ ও সহায়তা নিতে পারছেন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায় সম্বলহীন বিচারপ্রার্থী জনগণকে সরকারী খরচে আইনী সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন-২০০০’ প্রণয়ন করে। তারপরের সরকারগুলো আইনটি কার্যকরে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর আইনটি কার্যকরে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০০০ সালে প্রণীত আইনটি অনুযায়ী ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’ গঠন করা হয়।
×