ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পর্দা নামল ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের

উষ্ণতা ছড়ালেও দুর্বল প্রজেকশন, দর্শকখরা কাটেনি

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ২১ জানুয়ারি ২০১৮

উষ্ণতা ছড়ালেও দুর্বল প্রজেকশন, দর্শকখরা কাটেনি

মোরসালিন মিজান ॥ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলতে হবে। টানা পতনের পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বাংলা চলচ্চিত্র। এফডিসি কেন্দ্রিক সিনেমাগুলো দর্শক মোটামুটি দেখছেন। ‘হিট’ বলতে যা বোঝায়, সেটিও কম হচ্ছে না। অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত তরুণ ও মেধাবী নির্মাতারা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। জনপ্রিয় ধারার বাইরে গিয়ে ছবি বানানোর যে চ্যালেঞ্জ, তারা তা গ্রহণ করছেন। শহুরে সচেতন দর্শক এসব ছবি দেখতে হলে যাচ্ছেন। বাইরের দেশগুলোতেও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজিত চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ। আশাজাগানিয়া এই সময়েই আয়োজন করা হয়েছিল ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের। গত ১২ জানুয়ারি শুরু হওয়া উৎসব শনিবার ২০ জানুয়ারি শেষ হয়েছে। বরাবরের মতোই উৎসবের আয়োজন করে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি। ষোড়শতম আয়োজনের স্লোগান ছিলÑ ভাল ছবি, ভাল দর্শক, সমৃদ্ধ সমাজ। ৯ দিনের উৎসবে স্বাগতিক বাংলাদেশসহ ৬৪টি দেশের ২১৬টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। বাইরের দেশগুলোর মধ্যে ছিল আলজেরিয়া, আর্জেন্টিনা, আর্মেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ইরান, ইরাক, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক, চীন, কাজাখস্তান, জর্ডান, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, পর্তুগাল, সুইডেন, তুরস্ক ও সুইরাজল্যান্ড। উৎসবের মূল ভেন্যু ছিল সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার চত্বর। পুরো চত্বরটিকে সিনেমার পোস্টার ব্যানারে সাজিয়ে নেয়া হয়েছিল। প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয় শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে। পাশেই জাতীয় জাদুঘর। জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে সিনেমা দেখানো হয়। প্রধান মিলনায়তনেও চলে প্রদর্শনী। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তন ও রাশিয়ান কালচার সেন্টারে প্রদর্শিত হয় উৎসবের ছবি। উৎসবের সূচনা করা হয় তুরস্কের নির্মাতা কাজিম ওজ’র বিখ্যাত সিনেমা ‘জার’ দেখিয়ে। ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে আয়োজন করা হয় ফোরথ ইন্টারন্যাশনাল উইমেন ফিল্ম মেকারস কনফারেন্স। এতে দেশ-বিদেশের নারী নির্মাতারা অংশ নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। নানা প্রতিবন্ধকতার কথা বলা হলেও, সবাই সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ছিল ফার্স্ট এশিয়ান ফিল্ম ক্রিটিকস এ্যাসেম্বলি কনফারেন্স। এতে এশীয় অঞ্চলের ১২ দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকাররা অংশ নেন। এশিয়ার চলচ্চিত্র নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল এশিয়ান কম্পিটিশন বিভাগ। এই বিভাগে প্রতিযোগিতা করে ১৫টি চলচ্চিত্র। রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগে দেখানো হয় ফরাসি নারী নির্মাতা জুলি বার্টুসেলি ও সিলিনি সিএমার ৭টি ছবি। এই বিভাগের সবগুলো চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে। উৎসবে যুক্ত করা হয় বাংলাদেশ প্যানোরোমা বিভাগ। এই বিভাগে ১০টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড বিভাগে দেখানো হয় ৪১টি সিনেমা। ১১টি শিশুতোষ চলচ্চিত্র দেখানো হয় চিলড্রেন্স বিভাগে। স্পিরিচুয়াল ফিল্মস বিভাগে ছিল ২৯টি চলচ্চিত্র। ছবিগুলো দেখানো হয় রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে। জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় উইমেন ফিল্ম মেকারস সেশন। দেখানো হয় ৫০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। শর্ট এ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্ম বিভাগে ছিল ৫২টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। ছবিগুলো প্রদর্শিত হয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে। উৎসবে দেশ বিদেশের অনেক বিখ্যাত সিনেমা দেখানো হয়। সবচেয়ে বড় কথা ছিল চিন্তার ভ্যারিয়েশন। সমকালীন নির্মাতারা কী নিয়ে ভাবছেন তা উৎসবে এসে অনুমান করা গেছে। অনেক রুচিশীল দর্শক সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন বটে। বাকিদের টানা যায়নি। হলের আসনগুলো বেশিরভাগ সময় ফাঁকা পড়ে ছিল। দর্শক খড়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি রেইনবো। এর অনেকগুলো কারণ খুঁজে বের করা যাবে। তবে মূল কারণটি হয়ত সময়ের পরিবর্তন। এখন চলচ্চিত্র দেখার নতুন নতুন মাধ্যম। এসব মাধ্যমে বুঁদ হয়ে আছে নতুন প্রজন্ম। দু হাতে যানজট ঠেলার সময় তারা পান না। আয়োজকরাও কিছুটা ক্লান্ত। হাত বাড়িয়ে কাউকে তেমন যুক্ত করতে যান না। যান না বলেই মনে হয়েছে। তবে বিদেশী পরিচালকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। নিজেদের নতুন ছবি নিয়ে উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন তারা। দর্শক কম হওয়ায় তাদের মুখ কিছুটা মলিন হয়েছে। তার চেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল প্রজেকশনের দুর্বলতা। এবার বিশেষ করে সামনে এসেছে সমস্যাটি। উপমহাদেশের প্রখ্যাত অভিনেত্রী পরিচালক অপর্ণা সেন কোন আর রাখঢাক করেননি। প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। ১৪ জানুয়ারি ঢাকায় তিনি। ১৫ জানুয়ারি উৎসবে দেখানো হয় তার চলচ্চিত্র ‘সোনাটা।’ প্রদর্শনের আগে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বাঙালী নির্মাতা বলেন, প্রজেকশনটা কেমন হবে ভেবে আমি কিছুটা চিন্তিত। কারণ আমি যখন একটি ছবি দেখলাম, দেখার সময় সেখানে অনেক আওয়াজ পেয়েছি। আমি জানি না ‘সোনাটা’ দেখার সময় দর্শকরা সেটা কীভাবে নেবেন! সিনেমা দেখানোর পরও নিজের অতৃপ্তির কথা জানিয়ে গেছেন তিনি। অবশ্য বাংলাদেশের আতিথেয়তার প্রশংসা করেছেন বিদেশী অতিথিরা। পুরোটা সময় দারুণ হাসিরাশি আনন্দে পার করেছেন তারা। প্রশংসা করে অপর্ণা সেনই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, আমি অনেক বড় উৎসবে গিয়েছি। কিন্তু সেখানে কোন উষ্ণতা থাকে না। এখানে আছে। মানুষের উষ্ণতা আছে। সত্যিই সব মিলিয়ে ভাল লাগছে। রবিবার পুরস্কার বিতরণীর মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে উৎসব। জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে সমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে কাছে টানতে পারে। ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে আজ সারাবিশ্বে চলছে হত্যাযজ্ঞ, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি আর রাহাজানি। আমরা নিজেদের দাবি করছি আমরা সভ্য। আসলে কি আমরা সভ্য? চলচ্চিত্র এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। চলচ্চিত্র পারে বিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে। ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০১৮ এর আহবায়ক অধ্যাপিকা কিশোয়ার কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ ও ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত ভিসেন্ট ভিভেনসিও তেজামো বেন্দিলো। সব মিলিয়ে কেমন হলো? জানতে চাইলে উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামান বলেন, আমরা সব চেষ্টা করেছি। নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও উৎসবটি কন্টিনিউ করছি। আয়োজনের তুলনায় দর্শক কম ছিল। আসল ইউটিউবের যুগে দর্শক তো ধরে আনতে পারবেন না আপনি। প্রজেকশনের দুর্বলতার কথা স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, এটা তো আমার হাতে নয়। আমাদেরও খারাপ লাগে। কিন্তু প্রজেকশন সাউন্ড ভাল করতে হলে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। আগামীতে দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা হবে বলেও জানান তিনি।
×