ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচন সুষ্ঠু হোক সেটাই কাম্য

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২১ জানুয়ারি ২০১৮

নির্বাচন সুষ্ঠু হোক সেটাই কাম্য

নতুন বছর ২০১৮ সাল অনেক দিক থেকেই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ বছরের শেষ দিকেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। আগামী বছরের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন করার সময় থাকলেও নতুন বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকেই হয়ে যাবে নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত ১২ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের টানা দ্বিতীয় মেয়াদের চতুর্থ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে সে কথাই বলেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ওপর এদেশের মানুষের প্রগাঢ় আস্থার কারণেই তিনি সর্বক্ষেত্রে অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। চুলচেরা বিশ্লেষণে গত চার বছরে সাফল্যের পাল্লাটাই যে আসলে বেশ ভারি তা বেশিরভাগ মানুষই বলছেন। অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে প্রিয় বাংলাদেশকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে ঈর্ষণীয় সাফল্য এনে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। ভয়ঙ্কর জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাস সাহসের সঙ্গে শক্তহাতে মোকাবেলা করে ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তায় সমুজ্জ্বল শেখ হাসিনা বিরল দক্ষতা ও বিক্ষণতার সঙ্গে দেশকে নিয়ে গিয়েছেন সাফল্যের স্বর্ণদ্বারে। দেশ আজ অনেক এগিয়েছে। দরিদ্র দেশের কাতার থেকে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। গত দশ বছরে মাথাপিছু জিডিপি তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৬০০ ডলার ছাড়িয়েছে। রিজার্ভের পরিমাণ তিন বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। বিদ্যুতের উৎপাদন চার গুণ বেড়েছে। এ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। এগুলো অবশ্যই বর্তমান সরকারের সাফল্য। এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে জনগণ অবশ্যই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪-দলকে আরও একবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে। তবে আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয় সে বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যেকথা বলেছেন তা সবাই ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। কারণ, দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ কোনমতেই কোন ধরনের রাজনৈতিক অশান্তি দেখতে চায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১২ জানুয়ারির ভাষণের পরই মনে হয় বিএনপি নেতাদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেছে। ভাষণটি সর্বমহলে সমাদৃত হলেও তাদের একবারেই পছন্দ হয়নি বলেই মনে হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেই ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। জনগণ বুঝতে অক্ষম সঙ্কটটা কি? এদিকে তাদের দাবিকৃত তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকারের রূপরেখা সম্পর্কে একটি শব্দও এ পর্যন্ত তারা বলতে পারেনি। পরিষ্কার ভাষায়ই বলা যায় তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি। মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি গর্বভরে বলেছেন, নির্বাচন যদি ৬০ সুষ্ঠু হয় তবে আগামী নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে তারা জয়ী হবে। তবেতো সব হয়েই গেল। আর কোন কথাই থাকে না। তাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার কথারই প্রতিধ্বনি। খালেদা জিয়া ২০১৪ সালে বলেছিলেন গত নির্বাচনে মাত্র পাঁচ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছে। তিনি দম্ভভরে আরও বলেছেন বাকি ৯৫ ভাগ তার লোক। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। সেখানে এসব কথা খুবই অবান্তর। ফন্দিফিকির করে আবার দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তুলে অগুন সন্ত্রাসের পাঁয়তারা আর কি! জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই শেখ হাসিনা বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। দেশ ও দেশের জনগণের প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসার প্রমাণস্বরূপ তিনি তখন বলেছিলেন, আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশই আমার সব। দেশের মানুষ খুশী থাকলে তাতেই আমার স্বর্গীয় সুখ। কথাগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়শিংটন পোস্ট পত্রিকাসহ আরও কিছু বিদেশী পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। পাকিস্তান ও পাকিস্তানীদের প্রেমে বিভোর খালেদা জিয়া ২০০১ সালে নানা কৌশলে ক্ষমতায় এসে পূর্ববর্তী সরকার প্রণীত সব দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ্র অশেষ রহমতে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৮-দল ক্ষমতায় আসে। দূরদৃষ্টি, সততা, সাহস ও মানুষের প্রতি নিখাদ ভালবাসাই শেখ হাসিনার চরিত্রের বড় দিক। চারিত্র্যিক দৃঢ়তার বলেই তিনি আবার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেন। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে বিশ্বব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো একটি সুবিশাল প্রজেক্টের কাজে হাত দেন। সারা বিশ্বকে বিস্ময়ে তাক লাগিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু আজ বাস্তব রূপ লাভ করতে যাচ্ছে। প্রমত্তা পদ্মার বুক ভেদ করে বিশাল জলরাশির ওপর সেতুটির অংশ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। এদেশের মানুষ ভুলে যায়নি যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের পূর্বে একটানা কয়েক মাস বিএনপি-জামায়াত জোটের মদদপুষ্ট জঙ্গী-সন্ত্রাসীরা ভয়ঙ্কর পেট্রোল বোমাসহ বিভিন্ন ধরনের বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হায়েনার হিংস্রতায় শিশু-নারী-বৃদ্ধসহ শত শত নিরীহ নিরপরাধ মানুষের শুধু প্রাণই কেড়ে নেয়নি সারাদেশে জাহান্নামের ভয়াবহতার সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়েছিল। মসজিদ-মন্দির-গির্জাও রেহাই পায়নি তাদের রুদ্ররোষ থেকে। অবুঝ ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে নিরাপদ জায়গা মনে করে বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা ড্রাইভার- হেলপারও রেহাই পায়নি তাদের জিঘাংসা থেকে। তারা কেটেছিল হাজার হাজার গাছ। মেরেছে বোবা গরুও। চলন্ত বাসে আগুন দিয়ে এবং ফিসপ্লেট তুলে চলন্ত ট্রেন ফেলে দিয়েও তারা মানুষ হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। আন্দোলনের নামে পৈশাচিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে শুধু মানুষের প্রাণ হরণই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর অতর্কিতে বর্বরোচিত বোমা হামলা চালিয়ে তাদের অনেক তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। আহত হয়েছিল আরও অনেকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণার পর দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের সশ¯্র ক্যাডাররা যেভাবে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা মেরে শিশু-কিশোরসহ নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হতাহত, পঙ্গু, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যা, পুলিশের অস্ত্র লুট এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি করে নাশকতা চালিয়েছিল তেমনি আবারও তারা সরকার পতনের আন্দোলনের বাহানায় তার পুনারাবৃত্তি ঘটানোর পাঁয়তারা করেছিল। আগুন জ্বালিয়ে এবং ভাঙচুর করে ধ্বংস করা হয়েছিল প্রায় হাজার পাঁচেক যানবাহন। ট্রেনেও হামলা করা হয়েছিল। দেশের অর্থনীতিও হয়েছিল অগ্নিদদ্ধ। ঐ সময়ে এক মাসে দিনমজুর থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী পর্যন্ত অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এবারও বিএনপির মূল দাবি আলোচনায় বসে তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান। সুপ্রীম কোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে ঐ ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করা হয়। গত নির্বাচনের আগেও বিএনপির তরফ থেকে আলোচনায় বসার আহ্বান ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে অবাক করে দিয়ে অত্যন্ত সাদা মনে খালেদা জিয়াকে ফোন করে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিলে তিনি হরতালের কথা বলে তা নাকচ করে দিয়েছিলেন। এ সব ছিল খালেদা জিয়ার ফন্দি-ফিকির। কূটকৌশল। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রেসক্রিপশন মোতাবেক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বেগম জিয়া বলেছিলেন, ‘১৫৪টা সিট আনকনটেস্টেড হয়ে গেছে। আর বাকিগুলোও করে ফেলবে।’ আনকনটেস্টেড হয়ে যাওয়া এদেশে নজিরবিহীন কিছু নয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও ৪৮ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। কোন দল যদি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের কুমতলব নিয়ে জোট বেঁধে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেক্ষেত্রে সাংবিধানিক ধারা সমুন্নত রাখার জন্য নির্বাচনে আগ্রহী অন্যান্য অনেক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেই পারে। কথাটি নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বেগম জিয়ার জাতীয়তাবাদী দলের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করা বড় প্রশ্ন ছিল না। পাকিস্তানের বড় বন্ধু ও জামায়াতে ইসলামের বড় দোসর বেগম জিয়ার জন্য তখন দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। অনেকের কাছে দিবালেকের মতো পরিষ্কার যে, ম্যাডামের সব কার্যক্রম পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আএসআইয়ের পরামর্শেই পরিচালিত হয়। তিনি পাকিস্তান ও পাকিস্তানীদের প্রেমে মশগুল এক মহিলা। তিন তিনবার এদেশের প্রধানমন্ত্রী হলেও তার মনপ্রাণ এখনও মনে হয় পাকিস্তানেই পড়ে থাকে। দেশে আন্দোলন উপযোগী এমন কোন পরিস্থিতি বর্তমানে বিরাজ করছে না। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যতই হুমকি বা হুঙ্কার ছাড়ুন না কেন আন্দোলনের জন্য সাধারণ জনগণ হুমড়ি খেয়ে না পড়লে আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য। এ মুহূর্তে দেশে এমন কোন সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি দেশের সাধারণ মানুষ কারও ডাকে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তখন ‘দেশনেত্রী’ ম্যাডাম খালেদা জিয়া বলেই ফেলেছিলেন, ‘দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ তার দলের পক্ষে রয়েছেন। কারণ, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নাকি দেশের মাত্র পাঁচ শতাংশ ভোটার ভোট প্রদান করেছেন। অথচ, দেশের মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে বিষয়টি সঠিকভাবেই জানতে পেরেছেন যে গত নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল শতকরা ৪০ ভাগ। এ কথাটি বেগম জিয়া নানা কারণে তার দলের হতাশ কর্মী-সমর্থকদের মন চাঙ্গা করতেই যে বলে থাকেন সেটা বোধহয় আর কারও বুঝতে বাকি নেই। তবে মিথ্যাচার আর হঠকারী কথাবার্তার একটা সীমা-পরিসীমা থাকা উচিত। বেগম জিয়ার এ বক্তব্যে তার লেশ মাত্র নেই। জনগণ রাজনীতিকদের কাছে সুন্দর কিছু আশা করে। মিথ্যাচার নয়। কারণ মিথ্যা দিয়ে সত্যকে কখনোই উড়িয়ে দেয়া যাবে না। এ সত্যটি দেশের রাজনীতিকদের আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
×