ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব হত্যা

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২১ জানুয়ারি ২০১৮

কেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব হত্যা

মানুষ মানুষকে হত্যা করে ধর্মের নামে, ক্ষমতার নামে, বর্ণের নামে, ভাষার নামে। যুুগে যুগে হত্যার ঘটনাগুলো মানুষকে পীড়িত করে। অথচ মানুষই হয়ে ওঠে হত্যাকারী এবং হত্যার শিকার। পৃথিবীতে মানব আগমনকালেই হত্যার প্রক্রিয়ার কাহিনী আজও বিধৃত। পৌরাণিককালের হত্যার নানা বিবরণ একালেও আলোচিত। মানুষই হয় মানুষের শত্রু, মানবতার শত্রু। জীবনের জয়গান গেয়ে আসা মানুষের বুকে ছুরি, গুলীবর্ষণ সর্বকালেই ঘটে আসছে। কিন্তু কেন এই হত্যা? শুধু হত্যা নয়, গণহত্যাও চলে। বিশ শতক জুড়ে দেশে দেশে, মহাদেশে গণহত্যার যে দৃশ্যপট, তা মানুষের ভেতরের মানবিকতাকে, মানবতাকে লুণ্ঠিত করেছে। মনুষ্যত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে। রাজ্য দখলকে কেন্দ্র করে বহু যুদ্ধ বিগ্রহ ঘটেছে, এখনও ঘটছে। আর এই যুদ্ধের দামামায় প্রাণ হারিয়েছে কত শতকোটি মানুষ, ইতিহাসের পাতায় হয়ত তার পাওয়া যায় রূপরেখা। মানুষের ভেতরের পাশবিকতা মানুষকে হত্যাকারীতে পরিণত করে হয়ত। মানব মনের বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা, তাকে পরিণত করতে পারে হত্যাকারীরূপে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর বার বার আক্রমণ ঘটে; কেন, তার ব্যাখ্যা ও কারণ অনুদঘাটিত রয়ে যায়। বাংলাদেশে সফরকালে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি বাঙালী অন্তঃপ্রাণ প্রণব মুখার্জী এই উপমহাদেশে বঙ্গবন্ধুসহ রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেন বার বার আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, সেই প্রশ্ন তুলে এসব হত্যাকা-ের কারণ জানতে গবেষণার আহ্বান জানিয়েছেন। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু উপমহাদেশ নয়, এশিয়া মহাদেশে রাজনীতিক, রাষ্ট্রনায়কদের খুন হতে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু কেন এই হত্যা, কেন আঘাত- সেসব প্রশ্নের জবাব মেলেনি। বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, এখনও ঘটছে। ১৯৭৫ সালের আগেও দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। ব্রিটিশদের বিদায়ের পরপরই ১৯৪৮ সালে প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকা-ে নিহত হন ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। এই হত্যাকা-ের তিন বছরের মাথায় ১৯৫১ সালে নিহত হন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ১৯৫৯ সালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন সিংহলের প্রধানমন্ত্রী সলোমন বন্দর নায়েক। ১৯৬৩ সালে বৈরুতে এক হোটেলে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মারা যান অবিভক্ত বাংলার শেষ এবং পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, গুপ্তহত্যার শিকার তিনি। যেমন শিকার হন জিন্নাহর বোন চিরকুমারী ফাতেমা জিন্নাহ ১৯৬৮ সালে। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নির্বাচন করার তিন বছরের মাথায় এ ঘটনা ঘটে। তার গলাকাটা লাশ মিলেছিল। কিন্তু সেসব হত্যাকা- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মতো উপমহাদেশের শীর্ষ নেতাদের মনে নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চাপা আতঙ্কের জন্ম দেয়নি। ১৯৭৯ সালে নিজের নিয়োগ করা সেনাপ্রধানের চক্রান্তে পরবর্তীতে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। ২০০৭ সালে রাজনৈতিক হত্যাকা-ের শিকার হন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজের নিরাপত্তা বাড়িয়ে দিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৮৪ সালে নিজ নিরাপত্তা রক্ষীর গুলিতে নিহত হন তিনি। ’৭৫-এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খান, ১৯৭৯ সালে সে দেশেরই দুই রাষ্ট্রনায়ক নূর মোহাম্মদ তারাবী, হাফিজুল্লাহ আমীন এবং ১৯৯৬ সালে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ক্ষমতাদখলকারী সামরিক জান্তা শাসক জিয়াউর রহমান নিজ অনুগত সেনাদের হাতে নিহত হন। ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জিয়াউল হক, ১৯৯১ ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, ১৯৯৩ শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রানা সিংহ প্রেমাদাসা, ১৯৯৪ শ্রীলঙ্কার বিরোধীদলীয় নেতা গামিনী দেশনায়েক, ২০০১ নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ, ২০০৫ শ্রীলঙ্কা পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষ্মণ কাদির গামার, ২০১১ আফগানের সাবেক প্রেসিডেন্ট বুরহান উদ্দিন রব্বানী রাজনৈতিক অপঘাত ও গুপ্ত হত্যায় প্রাণ হারান। ২০০৪ সালে ঢাকায় মারাত্মক গ্রেনেড হামলা থেকে শেখ হাসিনা অল্পের জন্য বেঁচে যান, কিন্তু মারা যায় রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ ২৫ জন কর্মী, ১৯৭৫-এর আগেও দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক হত্যাকা- হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যা রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্রান্তিকাল ছিল। যে ঘটনার পর দৃশ্যত এই অঞ্চলের দেশগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের প্রাণের ওপর আঘাতের প্রবণতা বেড়ে যায়, প্রণব মুখার্জীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যারা গবেষণা করবেন, তারা নিশ্চয়ই আসল কারণ উদ্ঘাটন করবেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক হত্যাকা- বন্ধে উপমহাদেশবাসীর সচেতন ও সতর্ক থাকার বিকল্প নেই।
×