ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাবমেরিন ডুবে গেছে!

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২০ জানুয়ারি ২০১৮

সাবমেরিন ডুবে গেছে!

মুহম্মদ শফিকুর রহমান ॥ চার্লি চ্যাপলিন কিংবা বীন এবং আশিস কুমার লৌহ থেকে খান জয়নুল, টেলি, দিলদার কিংবা বোম্বের জানিওয়াকার থেকে জনি লিভার অভিনয় দিয়ে মানুষের হাসির খোরাক যুগিয়ে চলেছেন যুগ যুগ ধরে। গোপালভাঁড়ের মজার মজার কথা কি ভোলা যায়? অনেকে প্রয়াত হয়েছে, তবু আজও তাদের নাম শুনলেই হাসি পায়। অবশ্য এসব জানার জন্য সমৃদ্ধ ঘট লাগে। সেই ঘট ক’জনের আছে জানি না। আমরা যারা ষাটের দশক দেখেছি তাদের কাছে এক মহারথীর হাসির কথাবার্তা-কর্মকা- আজও মনে পড়লে অটোমেটিক চেহারায় হাসি ফুটে ওঠে। অন্তত একটা ব্যাপার আমাদের জানার কথা যে, পাকিস্তান আমলটা কেটেছে মার্শাল ল’ বা মিলিটারি স্বৈরশাসকের কাল। সেকালে আবার সবচেয়ে ডাকসাইটের মিলিটারি সর্দার ছিলেন প্রয়াত আইয়ুব খান। তৎকালীন পূর্ববাংলা বা আজকের বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। আইয়ুবের প্রতিনিধি হিসেবে এখানে বঙ্গভবনে বসে মোড়লিপনা করতেন গবর্নর পদবির একজন। তাদের মধ্যে আবার সবচেয়ে মজার গবর্নর ছিলেন খাঁ আবদুল মোনেম খাঁ। আইয়ুব খাঁ ছিলেন ফিল্ড মার্শাল (পরে নিজেই মার্শাল স্টারও লাগিয়ে নিয়েছিলেন) আর খাঁ আবদুল মোনেম খাঁ উকিল (যাকে বলে বটতলার উকিল) দু’জনের সম্পর্ক ছিল মনিব-চাকরের। কথিত আছে তার মনিব আইয়ুব টেলিফোন করলে প্রথমেই মাথায় হাত দিতেন টুপি আছে কী-না? না থাকলে ‘জরা ধরিয়ে সাব, সের পে টুপি নেহি হায়, টুপি লাগিয়ে বলতেন আপ ঠিক হায়, বোলিও!’ এই খান আবদুল মোনেম খানের নামের পেছনে খান লাগালে তিনি খুব খুশি হতেন। খান লাগালে নিজেকে আইয়ুব আইয়ুব খান খান মনে হতো তার। সে সময় উর্দু চাপিয়ে দিতে গিয়ে ফেল করলেন। তারপর শুরু করলেন সাহিত্য মুসলমানিকরণ। প্রথমেই এ্যাটাক এলো রবীন্দ্র-নজরুল সাহিত্যের ওপর। ফরমান জারি হলো : রবীন্দ্রনাথ : ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, পূর্ণ হোক পূর্ণ হোক, হে ভগবান...’ যেহেতু এখানে ‘ভগবান’ শব্দ আছে, অথএব এটি গাওয়া যাবে না। ‘ভগবান’ হিন্দু শব্দ...। কাজী নজরুল : তার কবিতার ‘মহাশ্মশান’ শব্দ পাল্টাতে হবে। তদস্থলে ‘ গোরস্তান’ শব্দ প্রতিস্থাপন করতে হবে। নইলে এটা চলবে না। কিংবা মদন মোহন তর্কালঙ্কার : ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি...’ এই কবিতাকেও মুসলমানিকরণ করাতে হবে। যেমন : ‘ফজরে’ উঠিয়া আমি ‘দেলে দেলে’ বলি... এইভাবে মুসলমানি করাবার প্রক্রিয়ায় যারা যোগ দিলেন তারা ভুলে গেলেন বাঙালী ছাত্রসমাজ বাংলা ভাষার জন্য অকাতরে জীবনদান করেছে, তারা এই পাগলের প্রলাপ সইবে কেন? শুরু হলো আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে উঠল। প্রগতিশীল ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী, লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা রাজপথে নেমে এলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো, কেননা ওটা হিন্দুর লেখা সঙ্গীত। ঢাকার রাজপথ আরও উত্তাল হয়ে উঠল- মানি না মানব না স্লে‍াগান উঠল। আইয়ুব খাঁর খাঁ আবদুল মোনেম খাঁর কানে স্লেøাগানের জ্বালা ধরল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর ড. মুহম্মদ আবদুল হাই। খাঁ আবদুল মোনেম খাঁ তাকে ডাকলেন। আবদুল হাই স্যার (আমার সরাসরি শিক্ষক) দেখা করলে খাঁ সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘কী শুরু করেছেন আপনারা হিন্দু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে? রবীন্দ্রসঙ্গীত যদি গাইতেই হয় তবে আপনি কেন রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখছেন না? আপনি তো অনেক বড় পন্ডিত। আপনি দু’চারটা রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখলে আর কথা থাকে না। ল্যাঠা চুকে যায়।’ প্রফেসর আবদুল হাই স্যার কোনরকম হাসি চেপে বললেন, ‘আমি লিখলে সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত হবে না, হবে হাইসঙ্গীত’, ‘ঐ হলো... খাঁ মোনেম বললেন। ভূমিকাটা একটু বড় হয়ে গেল। সাম্প্রতিককালে কিছু মজার বাণী কানে এলো এবং তা কানের ভেতর দিয়া মরমে পসিয়া বড়ই আনন্দ দিয়ে চলেছে। বাণীগুলো নিশ্চয়ই মহাজনী এবং আমি দুটি উল্লেখ করতে চাই। আমাদের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক’দিন আগে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছেন, এতে ঝুঁকি আছে, কেউ ওতে উঠবে না..., দ্বিতীয় মজার কথাটি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা দুটি সাবমেরিন কিনে এনেছেন, উদ্বোধনের পরপরই ওগুলো ডুবে গেছে।’ জীবনে অনেক জোক শুনেছি বা আপনারাও শুনেছেন; কিন্তু কেউ কি শুনেছেন তালি দিয়ে সেতু হয় বা সাবমেরিন ডুবে যায়, ওটা ডুবেই চলাচল করে। এবার বুঝুন, বন্ধুরা আমাদের তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যের দৌড়। অবশ্য কখনও কলেজে পড়েছেন কখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন ঐ সব পথে হেঁটে যখন দেখলেন মানুষ হাসে তখন ‘স্বশিক্ষিত’ তকমা লাগিয়ে দিলেন, কারণ এটি চ্যালেঞ্জ করার কিছু নেই। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কথাই হলো জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানানো হচ্ছে। জোড়া দিয়ে বানানোটা বেশি বলা নয়। কারণ পার্ট বাই পার্ট জোড়া দিয়েই বানানো হয়। গত বছর জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে জাতির পিতার সমাধিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাতে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছিলাম। তখন দেখেছি বিশাল বিশাল সব কংক্রিটের স্ট্রাকচার সেতুর এ পাড়ে শুয়ে আছে। এগুলোকেই বড় বড় ক্রেন দিয়ে তুলে নিয়ে সেতুর স্ট্রাকচার-পিলারের ওপর বসানো হবে। একটা স্প্যানের সঙ্গে আরেকটি স্প্যান এভাবেই জোড়া দেয়া হয়। কিন্তু তালির ব্যাপারটা হাস্যকর নয় কি? যেমন ইতোপূর্বে একটি স্প্যান বসানো হয়েছে, আরেকটিও অল্প দিনের মধ্যে বসানো হবে। সাবেক তিনবারের স্বশিক্ষিত প্রধানমন্ত্রীর এই জোড়াতালির কথাটি আমাদের জাতীয় সংসদে পর্যন্ত উঠেছে। আমাদেরও প্রশ্ন পার্ট বাই পার্ট জোড়া দিয়ে সেতু বা যে কোন স্ট্রাকচার বানানো যায় কিন্তু ‘তালি’ দিয়ে বানানো যায় এটা কখনও শুনিনি। সংসদ সদস্য ফজিলাতুন্নিছা প্রশ্নটি উত্থাপন করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘উনি জোড়াতালি বলতে কি বোঝাতে চেয়েছেন আমার বোধগম্য নয়। তবে বাংলাদেশে একটি প্রচলিত কথা আছে- পাগলে কি না কয় ছাগলে কি না খায়। আমার মনে হয় এ ধরনের পাগলের কথায় কান না দেয়াই ভাল।’ দ্বিতীয় হিউমার : ‘হাসিনা ২টা সাবমেরিন এনেছে, উদ্বোধনের পরই ডুবে গেছে।’- একটি মোবাইল স্ট্যাটাস থেকে জানতে পেরেছি। উপরে লেখা আছে : From-edizctg.com. কারও জ্ঞানের লেভেল নিয়ে কথা বলতে চাই না। এটা যেমন ঠিক তেমনি এই ‘লেভেলের’ মানুষের জ্ঞানের লেভেলও সে রকম হওয়া দরকার। একটি অতি সাধারণ নাগরিকও জানেন সাবমেরিন পানির তলদেশ দিয়ে চলে, বিশেষ করে সমুদ্রের নিচ দিয়ে। টিপিক্যাল জাহাজের মতো এর জলের ওপর কোন কাজ নেই। তবে ইচ্ছা করলে রূফ-টপ পানির ওপর জাগিয়ে আকাশ দেখার সুযোগ রয়েছে। সাগরের তলদেশে পানিতে চলে বলে এর অবয়বও শার্ক কিংবা তিমির মতোন। এই সাধারণ জ্ঞানটি যার থাকে না তাকে নিয়ে যেমন স্বপ্ন দেখা যায় না, তেমনি কিছু আশা করাও যায় না। তাকে দেশের নেতা হিসেবেও ভাবা ঠিক নয়। রামের পাদুকা রেখে ভরত রাজ্য শাসন করেছিল, সে ওয়ানস আপন এ টাইম। আজ একবিংশ শতাব্দী। এখন ছোট ছেলেমেয়েরাও ঘরে বসে মোবাইল (সেলফোন) টিপে গভীর সমুদ্রে শার্ক-তিমির পাশাপাশি সাবমেরিনের গতিবিধি এনজয় করে। ইচ্ছা করলে ওদের পাশে বসে দেখা যেতে পারে। অবশ্য আমি সব জানি না। অন্যের কাছ থেকে জেনে নেই। তাছাড়া গোপালভাঁড়ের গল্পের বইয়ের পাশাপাশি মোল্লা দো পেঁয়াজা, শিব্রাম চক্রবর্তীর নামটাও জানা থাকা দরকার। আমাদের ঢাকাইয়া ভানু তো রয়েছেনই। ভদ্রলোক কিভাবে পশ্চিম বাংলার দাদাদের স্ত্রী-লিঙ্গ বানিয়ে ছাড়লেন, এদের কাছ থেকে খালেদা জিয়া সবক নিতে পারেন। বস্তুত জ্ঞানের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড যার নেই রাজনীতিতে তার লেভেল প্লেয়িংইবা কি, জোড়াতালিইবা কি? ঢাকা- ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ই-মেইল: [email protected]
×