ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

-সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে

রাজৈরে লোকজমেলা

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২০ জানুয়ারি ২০১৮

রাজৈরে লোকজমেলা

মেলা আবহমান বাংলা ও বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং লোক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালী মনের আনন্দ-খুশিকে প্রাণবন্ত করতেই মেলা বসে শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে। মেলা বলতে আনন্দ-উল্লাস আর আবেগঘন মনের খোরাক এবং প্রাণের মেলা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মাদারীপুর অঞ্চলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মেলার আয়োজন করা হয়। জেলার সর্ববৃহৎ মেলার মধ্যে রাজৈরের পক্ষকালব্যাপী পৌষ মেলা অন্যতম। এর একটির ঐতিহ্য এক শ’ বছরের এবং অন্য আর একটি ঐতিহ্য প্রায় তিনশ’ বছরের। এ পৌষ মেলা উপলক্ষে আয়োজন করা হয় সপ্তাহব্যাপী কবি গান ও বাউল গান। এ অঞ্চলে যে সব মেলার প্রচলন রয়েছে তা হলোÑবৈশাখী মেলা, মধুমাসের মেলা, ঈদের মেলা, কুম্ভমেলা, চড়ক পূজার মেলা, বাজিতপুরের মেলা, বসন্তবরণ মেলা, চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, নীল পূজার মেলা, জন্মাষ্টমীর মেলা, দুর্গাপূজার মেলা, কুন্ডুবাড়ি কালীপুজার মেলা, পৌষমেলা, মাঘী পূর্ণিমার মেলা, স্বাধীনতা দিবসের মেলা, বিজয় দিবসের মেলা, একুশের মেলা, রথযাত্রার মেলা ইত্যাদি। বারো মাস কোন না কোন দিবস বা উৎসব উপলক্ষে জেলার কোথাও না কোথাও মেলা বসে। অঞ্চল ভেদে মেলাকে নানা নামে অভিহিত করা হয়। মেলাকে কোথাও গলইয়্যা, কোথাও আড়ং, কোথাও বান্নি নামে ডাকা হয়ে থাকে। যে নামেই ডাকা হোক না কেন মেলা বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব। মেলা ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালীর প্রাণের উৎসব। যা ভ্রাতৃত্বের সেতু বন্ধন তৈরি করে বাঙালীকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। অনেকে মেলাকে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করতে চায়। কেউ-কেউ মেলাকে ‘হিন্দুয়ানি’ আচার-অনুষ্ঠান বলে থাকেন। কিন্তু এ কথার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মেলা, গলইয়্যা, আড়ং ও বান্নি সবই বাঙালিয়ানার পরিচয় বহন করে। মেলার আবেদন আবহমানকালের এবং তা বাংলার লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধারণ করে আসছে যুগ-যুগ ধরে। জেলার গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, খোলা জায়গায়, নদীরপাড়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে মেলা বসে। মেলায় যে শুধু হিন্দুদের আগমন ঘটে তা নয়, মুসলমানদেরও আগমন ঘটে। কোন কোন ক্ষেত্রে হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানদের উপস্থিতি থাকে সিংহভাগ। সুতরাং বাঙালীর প্রাণের উৎসবে মেলায় অংশগ্রহণ নিয়ে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে কোন মতপার্থক্য থাকে না। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় অনুষ্ঠিত মেলায় ধর্ম বর্ণের কোন ভেদাভেদ থাকে না। সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ মেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। সবকিছু ছাপিয়ে জেলায় সর্ববৃহৎ মেলা অনুষ্ঠিত হয় রাজৈর উপজেলার কদমবাড়িতে। প্রতি বছর বাংলা মাসের ১৬ জ্যৈষ্ঠ রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি গণেশ পাগলের আশ্রমের ৩২ একরের বিশাল আঙ্গিনায় অনুষ্ঠিত হয় কুম্ভমেলা। এই আশ্রমে প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে বসে পক্ষকালব্যাপী পৌষ মেলা ও আয়োজন করা হয় সপ্তাহব্যাপী কবি গান এবং বাউল গানের। এবারো কদমবাড়ি ও খালিয়ায় বসেছে পক্ষকালের পৌষ মেলা ও সপ্তাহব্যাপী কবিগানের আসর। রাজৈরের পৌষ মেলা জেলার বৃহৎ মেলার একটি। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী গণেশ পাগল সেবাশ্রম সংঘ ও খালিয়ার সেনদিয়ায় শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী কবি গান ও পক্ষকালব্যাপী পৌষ মেলা। কবি গান শুনতে এবং পৌষ মেলায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতাদের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে উঠে মেলা প্রাঙ্গণ। গভীর রাত পর্যন্ত চলে গান ও বাউল গান। প্রায় এক শ’ বছর আগে মহামানব গণেশ পাগল পৌষ মাসের শেষ মঙ্গলবার কালী পূজার মধ্য দিয়ে কবি গানের আয়োজন করেছিলেন এবং তিনি নিজে ঈশান কোণের আসরে বসে কবিগান শুনতেন। সেই থেকে রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী গণেশ পাগল সেবাশ্রম সংঘ প্রতি বছর ১৫ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ দিনব্যাপী কবিগানের আয়োজন করে। বসে ১৫ দিনব্যাপী পৌষ মেলা।
×