ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আশরাফ পিন্টু

মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসন

প্রকাশিত: ০৭:১২, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসন

ইংরেজি ‘ঋধৎপব’- এর বাংলা সমার্থক শব্দ হলো প্রহসন। সাধারণত যে নাটকে হালকা হাসি আর কৌতুকের মাধ্যমে সমাজের দোষত্রুটি তুলে ধরা হয় তাকে প্রহসন বলে। প্রহসন নাটকেরই একটি উপশাখা। সংস্কৃত আলঙ্কারিকদের মতে, প্রহসন হলো সমাজের কু-রীতি শোধনার্থে রহস্যজনক ঘটনা সংবলিত হাস্যরস প্রধান একাঙ্কিকা। বর্তমানে প্রহসন বলতে একাঙ্ক কিংবা দুই অঙ্ক বিশিষ্ট অতিমাত্রার লঘু কল্পনাময়, আতিশয্যব্যঞ্জক হাস্যরসোজ্জ্বল সংস্কারমূলক নাটককে বুঝায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫জানু. ১৮২৪- ২৯জুন ১৮৭৩) যেমন আধুনিক বাংলা কবিতার মুক্তিদাতা তেমনি তিনি আধুনিক বাংলা নাটকেরও জন্মদাতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকের সংখ্যা ৩টি এবং প্রহসনের সংখ্যা ২টি। তাঁর প্রথম নাটক ‘‘শর্মিষ্ঠা’’ ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত হবার পর তিনি প্রহসন রচনায় উৎসাহিত হন। তিনি একই বছরে (১৮৬০) দুটি সার্থক প্রহসন ‘‘একেই কি বলে সভ্যতা’’ ও ‘‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’’ রচনা করেন। মধুসূদনের নাটকগুলো সম্পর্কে সমালোচনা থাকলেও তাঁর প্রহসন সম্পর্কে তেমন বিরূপ সমালোচনা নেই। এর পূর্বে কেউ মদুসূদনের মতো সার্থক প্রহসন রচনা করেননি। তবে যে বিষয়বস্তু নিয়ে মধুসূদন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ রচনা করেছিলেন, ঐ একই বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁর পূর্বে ‘নববাবু বিলাস’, ‘নববিবি বিলাস’, ‘‘আলালের ঘরের দুলাল’’ ইত্যাদি ব্যঙ্গাত্মক সাহিত্য রচিত হয়েছিল। কিন্তু একই বিষয় নিয়ে মধুসূদনই সর্বপ্রথম সার্থক প্রহসন রচনা করেন। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ দুই অঙ্ক বিশিষ্ট প্রহসন। প্রতি অঙ্কে দুটি করে গর্ভাঙ্ক বা দৃশ্য রয়েছে। এর পটভূমি আধুনিক কোলকাতা। পাশ্চাত্য প্রভাবিত ‘ইয়ংবেঙ্গল’ বা ‘নববাবু’দের চরিত্রদোষ উদ্ঘাটন করাই এ রচনার উদ্দেশ্য। নববাবু ও তার বন্ধুরা মিলে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’ নামে একটি ক্লাব খোলে। আড্ডাই এ ক্লাবের মুখ্য উদ্দেশ্য; যেখানে অবাধে মদ্যপান ও বারবণিতাদের নিয়ে উলঙ্গ মাতামাতি চলে। নবকুমারের বাবা গোঁড়া হিন্দু বৈষ্ণব। তিনি ছেলেকে চোখে চোখে রাখতে চান। কিন্তু তার বন্ধু কালীনাথ ভালোমানুষীর অভিনয় করে নববাবুর বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ওকে ক্লাবে নিয়ে যায়। তবুও নববাবুর বাবা পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে না ওদের ওপর। তাই তিনি সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বৈষ্ণব বাবাজীকে ক্লাবের উদ্দেশে পাঠান। প্রহসনটি শেষ হয়েছে ব্যঙ্গাত্মক বর্ণনা ও পথভ্রষ্ট নষ্ট যুব সম্প্রদায়ের প্রতি ধিক্কার দিয়ে। মাতাল নববাবুকে নিয়ে বৈদ্যনাথ বাড়ি ফেরার পর বাবা-মা, স্ত্রীসহ বাড়ির সকলে ছুটে আসে। নববাবু আবোল-তাবোল বকতে থাকে। পরিশেষে স্ত্রী হরকামিনীর ধিক্কারের মধ্য দিয়ে প্রহসনটি শেষ হয় : ‘‘এমন স্বামী থাকলেই বা কি আর না থাকলেই বা কি। ঠাকুর ঝি! তোকে বলতে কি ভাই, এইসব দেখেশুনে আমার ইচ্ছে করে যে গলায় দড়ি দে মরি। ছি, ছি, ছি! বেহায়ারা আবার বলে কি, যে সাহেবদের মতন সভ্য হয়েছি, হা আমার পোড়া কপাল! মদ-মাঁস খেয়ে ঢলাঢলি কল্লেই কি সভ্য হয়? একেই কি বলে সভ্যতা?’’ ‘‘একেই কি বলে সভ্যতা’’ প্রহসনের শ্রেষ্ঠত্ব হলো মধুসূদনের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রয়োগ। তিনি তৎকালীন ‘নববাবু’ বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’দের চরিত্রের মধ্যে যে দোষ-ত্রুটি লক্ষ করেছেন তা-ই নিখুঁতভাবে এখানে অঙ্কিত করেছেন। এমন সমাজবাস্তবধর্মী প্রহসন রচনা করে মধুসূদন পাঠকসমাজে ধন্য হলেও তৎকালীন ইয়ং বেঙ্গলদের কাছে তিনি রোষানলে পড়েন। ফলে সে সময়ে তিনি বেলগাছিয়া রঙ্গশালায় তাঁর প্রহসন দুটি মঞ্চস্থ করতে পারেন নি। ফরাসি নাট্যকার মলিয়েরের মতোই তাঁর ভাগ্যেও উপযুক্ত পুরস্কার মেলে নি। ‘‘একেই কি বলে সভ্যতা’’- এর অল্প সময় পরে মধুসূদন ‘‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’’ রচনা করেন। সমাজের আরও একটি বিপরীতমুখী বাস্তব চরিত্রকে অবলম্বন করে প্রহসনটি রচিত হয়। ‘‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’’-ও দুই অঙ্ক বিশিষ্ট নাটিকা। এর মূল কাহিনী সমাজের বিত্তশালী বৃদ্ধ ভক্তপ্রসাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মূলত বুড়ো বয়সে ইন্দ্রিয় আসক্তির দৌরাত্ম্য বা লাম্পট্যের স্বরূপ উন্মোচনই এ প্রহসনের উদ্দেশ্য। ভক্ত প্রসাদ ছাড়াও এখানে আছে তার অনুচর গদাধর, দরিদ্র ব্রাহ্মণ বাচস্পতি, রায়ত হানিফ গাজি, হানিফের সুন্দরী স্ত্রী ফাতেমা, খল স্ত্রীচরিত্র পুঁটি আরও আছে পঞ্চী ও পঞ্চীর মা ভগি। খরার কারণে ভালো ধান না হওয়ায় হানিফ গাজি ভক্ত প্রসাদকে কীভাবে খাজনা দিবে -এ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে খাজনা কিছুটা মওকুফের জন্য গদাধরকে ধরে। এ কথা শুনে ভক্ত প্রসাদ ক্ষেপে যায়। এক পর্যায়ে গদা তার মনিবকে হানিফের সুন্দরী স্ত্রী ফাতেমার কথা বললে ভক্ত প্রসাদের রাগ কমে যায়; সে ফাতেমাকে কীভাবে ভোগ করবে ফন্দি আঁটতে থাকে। শুধু ফাতেমাই নয়, তার লাম্পট্য প্রকাশ পায় গ্রামের যুবতী মেয়ে পঞ্চীর উপর কু-দৃষ্টির মাধ্যমেও। লাম্পট্যের যে কোনো ধর্ম নেই তা নিখুঁতভাবে প্রকাশ পেয়েছে ভক্ত প্রসাদের চরিত্রে এবং এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তারই অনুচর গদাধরের স্বগত উক্তিতে। ভক্ত প্রসাদের ছেলে কোলকাতায় থাকে। সে নাকি মুসলমান বাবুর্চির রান্না খায়। এ কথা শুনে ভক্ত বলেÑ ‘‘থু!থু! বল কি হিন্দু হয়ে নেড়ের ভাত খায়। রাম!রাম! থু!থু!’’ তখন গদাধর স্বগত উক্তিতে বলে- ‘‘নেড়েদের ভাত খেলে জাত যায় কিন্তু তাদের মেয়েদের নিলে কিছু হয় না। বাঃ!বাঃ!’’ পরিশেষে ভক্ত প্রসাদ ফাতেমাকে ভোগ করার জন্য শিবমন্দিরের ভিতরে ঢোকে। কেননা ফাতেমার মতো ‘এমন স্বর্গের অপ্সরীর জন্যে হিন্দুয়ানী ত্যাগ করাই বা কোন ছার।’ কাজেই দেবালয় বা ধর্ম তার কাছে বড় ব্যাপার নয়Ñ ভোগটাই মুখ্য। তবে হানিফ গাজি ও বাচস্পতির বুদ্ধি ও কৌশলের কাছে সে হার মানেÑফাতেমাকে ভোগ করতে পারে না। ‘‘একেই কি বলে সভ্যতা’’- এ মধুসূদন যেমন শহরের ক্ষয়িষ্ণু সমাজচিত্র অঙ্কন করেছেন তেমনি গ্রামের সামাজিক অসংগতি ও মানুষের মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়কে তিনি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন ‘‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’’ প্রহসনে। তাঁর সৃষ্টির দিক দিয়ে এ প্রহসনটি পূর্বের প্রহসন ‘‘একেই কি বলে সভ্যতা’’-এর চেয়ে অধিকতর মূল্যবান। এখানে চরিত্র সৃষ্টি এবং তাদের মুখের সংলাপ যেমন সার্থকতা অর্জন করেছে তেমনি এখানে কবিতা বা ছড়া ব্যবহার করে ভাষাকে আরো সরস ও প্রাণবন্ত করে তোলা হয়েছে। সমালোচক দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘মধুসূদনের ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’-এর ওপর ফরাসি নাট্যকার মলিয়েরের ‘তারতুফ’ নাটকের প্রভাব রয়েছে।’’ তবে মূল কাহিনীতে কিছুটা প্রভাব থাকলেও মধুসূদনের এ প্রহসনের কাহিনী সম্পূর্ণ গ্রামবাংলাভিত্তিক; যেখানে এতটুকুও কৃত্রিমতা নেই। এ ছাড়া প্রহসনটির ভাষা ও বর্ণনা কৌশলে মধুসূদনের স্বাতন্ত্র্যবোধই লক্ষ করা যায়। মধুসূদনের প্রহসন সম্পর্কে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমালোচক ড. নীলিমা ইব্রাহিম বলেছেন, ‘‘প্রহসন সৃষ্টির শিল্প-প্রতিভা সম্পর্কে মাইকেলের প্রতিভা ছিল যুগোগ্রগামী; একথা নিঃসন্দেহে স্বীকার করা চলে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রতিটি চরিত্রকে তিনি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করে তাতে স্বকীয়তা আরোপ করেছেন।’’ পরিশেষে বলা যায়, মাইকেলে মধুসূদনের হাতেই সার্থক বাংলা নাটকের যাত্রা শুরু হয়েছে। এ নাট্যপ্রতিভা তাঁর প্রহসনেও পরিস্ফুট হয়েছে। প্রহসন দুটিতে যে রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তেমন সমাধানও তিনি দিয়েছেন। সর্বোপরি প্রহসন দুটিতে শিল্প সৃষ্টিতে মধুসূদনের শিল্পসত্তারই পরিচয় বহন করে।
×