ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:১০, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) এছাড়াও রয়েছে সাহিত্য এবং দার্শনিক বিষয়াদি। এগুলো শিল্পকলার সামগ্রিক উৎকর্ষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নাগরিকের নিয়মিত তৃতীয় নাটক ছিল আলবেয়ার কামু রচিত ক্রসপারপাস নাটকের অনুবাদ। ওই সময় এই নাটকের মঞ্চায়ন নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যেই অনেক বিতর্ক হয়। অনেকের ধারণা এই নাটকটি জীবনবিরোধী। কিন্তু নাটকের ভেতরে প্রবেশ করলে এর অন্তর্নিহিত অর্থ কখনই জীবনের পরিপন্থী বলে মনে হবে না। এক বৃদ্ধা এবং তার কন্যা ইউরোপের কোন একটি শহরে একটি অতিথিশালা পরিচালনা করে। যেখানে বিত্তবান কোন ব্যক্তি থাকতে এলে তাকে হত্যা করে তার অর্থ আত্মসাত করে তারা। এই ছিল গল্পের শুরু। এই বৃদ্ধার এক পুত্র অল্প বয়সে মা-বোনকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গিয়েছিল। পরে সে একজন অতিথি হিসেবে মায়ের এই অতিথিশালায় পরিচয় গোপন করে থাকতে আসে। উদ্দেশ্য মা-কে বিস্মিত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাকেও মা এবং কন্যা মিলে খাবারের সঙ্গে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে। এ যেন সেই জনপ্রিয় ইংরেজী প্রবচনের মতই : ডযধঃ মড়বং ধৎড়ঁহফ, পড়সবং ধৎড়ঁহফ. তাদেরই হাতে নিহত হয় তাদেরই একান্ত আপনজন এবং পরে সব জানতে পেরে মা’ও আত্মহত্যা করে। অতএব, যে নাটককে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় বিমূর্ত এবং অসংলগ্ন সেই নাটকেরও একটি অতি স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। বলার ভঙ্গিটা ভিন্ন কিন্তু মোদ্দা বিষয় আমাদের মানবতার দিকেই দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করে। ক্রসপারপাস নাটকটির নির্বাচন এবং নির্দেশনায় ছিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এর প্রথম সভাপতি অধ্যাপক জিয়া হায়দার। নাটকে সুচারু অভিনয় করেছিলেন মা’এর ভূমিকায় সুলতানা কামাল এবং কন্যার ভূমিকায় সারা আমিন। এই নাটকের আলোক নিয়ন্ত্রণে ছিলাম আমি। এরপরও আমরা নাটক নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছি। অনেক আপাত অপরিচিত নাট্যকারের নাটকও আমাদের দেশ এবং সমাজে গ্রহণযোগ্য মনে হলে আমরা তা মঞ্চে আনতে দ্বিধা করিনি। এ রকম একটি নাটক ছিল ফেরেঙ্ক মলনার রচিত ক্যারোসেল। আতাউর রহমান এই নাটকটির রূপান্তর করে ভেঁপুতে বেহাগ নামে মঞ্চে নিয়ে আসেন। ১৯৭৪ সালে মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের আনুকূল্যে ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে একজন অধ্যাপক এবং তিনজন ছাত্রছাত্রী এসেছিল ঢাকায় তিন চারদিনের একটি কর্মশালা পরিচালনা করতে। তখন নানা রকম মার্কিন নাটক নিয়ে আলোচনা হতো। তারই ফলে এক আধুনিক মার্কিন নাট্যকার এডওয়ার্ড এ্যালবির নাটকের প্রতি আমাদের বিশেষ আগ্রহ। আমি তাঁর একটি নাটক নিয়ে রূপান্তর করার ভাবনা-চিন্তা করছিলাম তখন। এই নাটকটি, এভরিথিং ইন দ্য গার্ডেন, তারই অন্য একটি নাটক থেকে অভিনয়ের জন্য রূপান্তর করেছিলেন জাইলস কুপার নামে এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক। ক্রমে আমার রূপান্তরিত নাটক এই নিষিদ্ধপল্লীতে মঞ্চায়নের জন্য তৈরি হয়ে যায়। এই সময় আমার জীবন ধারায় বেশকিছু পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আমি সবসময়ই বন্ধু বান্ধব নিয়ে হৈ চৈ করে চলতে ভালবাসতাম এবং এই সব বন্ধুরা বিভিন্নজন বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে এসেছিলেন। কিন্তু নাটকের কাজ শুরু করার পর স্বভাবতই জীবন হয়ে গেল নাটক কেন্দ্রিক। আমার নিজস্ব সন্ধ্যাগুলো হয়ে পড়ল নাটক সন্ধ্যা। সারাদিন পেশার কাজে ব্যস্ত থাকার পর মহড়া কক্ষে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। পড়াশোনা শুরু করি নাটক নিয়ে অথবা নাটক সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রন্থ নিয়ে। সেই সময় বছরে অন্তত পক্ষে দু’বার কোলকাতায় যাওয়া হতো। বের্টল্ট ব্রেশ্ট এর নাটকের সঙ্গে সম্যক পরিচয় তখনি। তাঁর প্রথম নাটক দেখেছিলাম বাংলায় রূপান্তরিত থ্রি পেনি অপেরা। অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় কৃত এই নাটকের নাম দেয়া হয়েছিল তিন পয়সার পালা। বার পাঁচেক দেখেছিলাম নাটকটি এবং প্রতিবারই চমৎকৃত হয়েছিলাম। অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়, কেয়া চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অসিত বন্দোপাধ্যায় এরা সবাই অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। অনেকেই আমাকে কথাচ্ছলে প্রশ্ন করেন যে, আমি একজন পেশাদার বিজনেস এক্সিকিউটিভ কি করে নাটকে এলাম? এর একটি সহজিয়া উত্তর আছে আমার কাছে। আমি বলি নাটক আমার ভাললাগে সেই জন্যেই আসা। কিন্তু পূর্ববঙ্গের যুবক হিসেবে নাটক ভাললাগার কোন বিশেষ কারণ তো নেই আমার। কেননা, আগে যেমন বলেছি, এখানে তো আকর্ষিত হওয়ার মতো নাট্যচর্চা কোন কালেই ছিল না এবং আমি এমন কোন প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলাম না যে বিস্তর পড়াশোনা করে একেবারে নিজস্ব চিন্তায় নাটকের একটি ধারার সৃষ্টি করবো। স্বীকার করতে বাধা নেই নাটকের প্রতি আমার আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল কলকাতার নাটক দেখেই। সেই বাল্যকাল থেকে মায়ের হাত ধরে কলকাতায় নানা বাড়িতে যাওয়া-আসা আমার। কৈশোর থেকে কলকাতার মঞ্চে নাটক দেখা এবং নাটকের প্রতি একধরনের সম্মোহনের সৃষ্টি। এই ভাল লাগাই পরবর্তীতে আমাকে নাটক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে উৎসাহিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে কলকাতার নাটকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। সেখানে যেমন মৌলিক নাটক দেখেছি তেমনি অনূদিত এবং রূপান্তরিত নাটক দেখে বিমুগ্ধ হয়েছি। এটা স্বীকার করতেই হয় ব্রেশ্ট, চেকভ, ইবসেন, পিরপনদেল্লো এই সব প্রখ্যাত নাট্যকারদের কাজে আগ্রহী করে তুলেছেন কলকাতার নাট্যজনেরা। (চলবে)
×