ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তাইফুর রহমান তমাল

কালের সাক্ষী- কলরেডি

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

কালের সাক্ষী- কলরেডি

একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে যুক্ত হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ভাষণের মাধ্যমেই বাঙালীর স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণটি এখন শুধু দেশের সম্পদ নয়, বিশ্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে। সেদিন জনসভায় ‘কলরেডি’র মাইক ব্যবহৃত হয়েছিল। এর আগে পরে এবং এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জনসভায় এই প্রতিষ্ঠানের মাইক ব্যবহার করা হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটি ইতিহাসের গৌরবের অংশ। কেমন আছে ‘কলরেডি’? এ কথা জানতেই গিয়েছিলাম ঋষিকেশ দাস লেনে। বলা হয়ে থাকে, ইতিহাসের প্রয়োজনে ইতিহাস সংরক্ষিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর শাসকগোষ্ঠী এবং হত্যকারীরা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ মুছে দিতে। তারা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কীর্তি। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি সঙ্গত কারণেই। বাঙালীর হৃদয়ে এখনও অমলিন জাতির পিতার নাম। আর দেশের রাজনীতিকদের ভালবাসায় এখনও রয়েছে কলরেডি। ৭১ সালেই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে জনসভার উদ্যোক্তাদের কাছে প্রতিষ্ঠানটি এখনও বেশ জনপ্রিয়। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা আবদুর রশিদ বলেন, লক্ষ্মীবাজারের দুই সহোদরের হাতে ‘কলরেডি’র জন্ম ও উত্থান। আরও দুই ভাই পরবর্তী সময়ে এই কাজে সহায়তা করেছেন। দয়াল, হরিপদ, গোপাল ও কানাই ঘোষ- এই চার ভাইয়ের কেউ বর্তমানে বেঁচে নেই। কীভাবে কলরেডির জন্ম হলো? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিংশ শতাব্দীর আটচল্লিশ সাল। মাত্র মাস কয়েক আগে ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান নামের দুটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে। এই রকম ওলট-পালট সময়ে ঢাকার সূত্রাপুরের হরিপদ ঘোষ এবং দয়াল ঘোষের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম। তখন পল্টন ময়দানে নিয়মিত সভা-সমাবেশ হতো। এবং সেগুলো মানুষ শুনত। সেখানে অনেক মাইক ব্যবহার করা হতো। হরিপদ ঘোষ ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি মাইকের ব্যবসা করবেন। ছোট ভাইকে সে কথা জানালেন। এরপর দুই ভাই নয়টি মাইক, একটি গ্রামোফোন কিনে ব্যবসা শুরু করলেন। নাম কী দেবেন কোম্পানির? এ প্রসঙ্গে পরিচিত সেলিম চাচা পরামর্শ দিলেন, অলয়েজ রেডি এ্যাট ইওর সার্ভিস অন কল- এই হলো ব্যবসার মূলমন্ত্র। সুতরাং ইংরেজী বাক্যটি সংক্ষিপ্ত করে তিনি ‘আরজা ইলেক্ট্রনিক্স’ নাম রাখার প্রস্তাব দিলেন। আরেকটু সহজ করলে শব্দটি দাঁড়ায় ‘আরজু’। প্রস্তাবটি দুই ভাইয়ের পছন্দ হলো। এই নামেই যাত্রা শুরু করল প্রতিষ্ঠান। পরে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের এক ছাত্রের পরামর্শে নাম পরিবর্তন করা হয়। নতুন নাম রাখা হয় ‘কলরেডি’। অর্থাৎ যে কেউ যে কোন সময় ডাকলে তাদের প্রতিষ্ঠান মাইক নিয়ে প্রস্তুত থাকবে। ১৯৫২ সাল। মিটিং হবে ঢাকা ইউনিভার্সিটির জিমনেসিয়াম মাঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন মাতৃভাষার দাবিতে জ্বলে উঠেছে। তমুদ্দিন মজলিশ হয়ে ভাষা সংগ্রাম ঐক্য পরিষদের নেতারা সবাই একাট্টা। এই আগুন সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় একটাই স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। এমন একটি সমাবেশের জন্য তাদের কাছে বায়না এসেছে ভেবে রোমাঞ্চিত হলেন কলরেডির কর্ণধার দুই ভাই। হরিপদ আরও সরঞ্জাম সংগ্রহে মনোযোগী হলেন। দয়াল রাজনীতিমনস্ক ছিলেন। তিনি ভাবলেন, যদিও রোষানলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে তবুও এ ধরনের জনসভার জন্য তারা মাইক সরবরাহ করবেন। কারণ এ তো দেশের কাজ। প্রয়োজনে তারা বিনা পয়সায় সার্ভিস দিতেও রাজি। সেই শুরু। এরপর কলরেডি ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের অসংখ্য সভা-সমাবেশে মাইক সরবরাহ করে এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কণ্ঠ হয়ে ওঠে। আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। এ দিনের জনসভার জন্যও কলরেডির কাছেই বায়না আসে। কিছু অতিরিক্ত মাইক, জরুরী হ্যান্ড মাইকসহ ইলেক্ট্রিক তার তারা জনসভার জন্য সরবরাহ করেছিল। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। গৌরবের ব্যাপার হলো, যে মাইকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, সেই মাইকেই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে ভাষণ দেন। বর্তমানে হরিপদ ঘোষের চার ছেলে কলরেডির দেখভাল করছেন। ত্রিনাথ ঘোষ সাগর প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। এখন কেমন ব্যবসা চলছে? জানতে চাইলে তিনি অকপটে জানালেন- খুবই ভাল। কারণ সব সময় রেডি আছে কলরেডি।
×