ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মজিবর রহমান

কমিটিতে খুনী-কলঙ্কিত দেশের হকি!

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

কমিটিতে খুনী-কলঙ্কিত দেশের হকি!

২০০০ সালে ঢাকার সাবেক ডেপুটি মেয়র জাহাঙ্গীর আদেলের বাড়িতে পাকিস্তানী পতাকা ওড়ানোর প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ নেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক কামাল হোসেন খুন হয়েছিলেন, প্রায় ১৮ বছর আগে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় জাহাঙ্গীর আদেলের পুত্ররা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, তাদের দুজন সাজেদ এ আদেল ও তারেক এ আদেল বর্তমানে ফেডারেশনের কর্মকর্তা খেলাধুলার মূলমন্ত্র হচ্ছে সুস্থ শরীর, সুন্দর মন। যুব সমাজকে খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট, নৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে পাঠ্য-পুস্তকেও স্থান পেয়েছে এই অমরবাণী। বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রটা একোবের ছোট নয়। সরকার স্বীকৃত ফেডারেশন সংখ্যা তাই প্রমাণ করে। কিন্তু খেলাধুলা সচল রাখতে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন তারা কতটুকু মূল্যায়িত? বিশেষ করে যারা গাঁটের অঢেল অর্থ খরচ করে মনের টান থেকে খেলাধুলাকে বাঁচিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তারা কি আদৌ যতটুকু সন্মান পাবার যোগ্য তা পাচ্ছেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটিই শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে ‘না’। ক্রীড়াপ্রেমী সংগঠক, স্পন্সরদের ফেডারেশনে সম্পৃক্ত রাখতে চেষ্টার ঘাটতি রয়েছে। রাজনৈতিক বৈরিতার স্বীকারও অনেকে। প্রকৃত ক্রীড়াপ্রেমীদের ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে বেশিরভাগ অযোগ্যরা ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ আসন দখল করে আছেন। এটাই এখন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। সঙ্গত কারণে ফেডারেশনের সংখ্যা যতই থাকুক। জায়গা, সন্মান না পেয়ে ক্রীড়াঙ্গন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন অনেক সংগঠক, যাদের অর্থে পরিচালিত হতো খেলাধুলা। ক্রীড়াপ্রেমী খ্যাত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খেলাধুলার যে কোন অনুষ্ঠানে বরাবরই বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে উৎসাহিত হয়ে অনেকেই পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জড়িত হন বা হয়েছেন খেলাধুলার সঙ্গে। কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারেন না তারা। স্পোর্টস পলিটিক্সের শিকার হয়ে চলে যেতে বাধ্য হন। এই ঘটনা বেশি দেখা যায় কমিটি গঠনের সময়। ক্ষমতালিপ্সুদের দাপটের কাছে হার মেনে অনেকটা নিগৃহীত হয়ে কষ্ট-ক্ষোভ বুকে ধারণ করে বিদায় নিতে দেখা যায় প্রকৃত ক্রীড়াপ্রেমী সংগঠকদের। অবশ্য বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এটা নিত্য ঘটনা। আর এ কারণে এগোতে পারছে না বেশিরভাগ খেলা। ক্রিকেট, ফুটবলের পরই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হকি। তিনটি দলীয় খেলার মধ্যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট। পুরুষ ফুটবলের অবস্থা কিছুটা টালমাটাল। তবে ফুটবলে নারীদের সাফল্য, অগ্রযাত্রা ঈর্ষণীয়। সে তুলনায় দলাদলি-ক্ষমতার দ্বন্দ্বে হকির অবস্থা একেবারে নাজুক। যদিও সম্প্রতি কয়েক বছরের চেষ্টায় কিছুটা প্রাণ ফিরেছে হকির। কিন্তু প্রত্যাশার তুলনায় অগ্রগতি চিত্র পুরাপুরি স্বচ্ছ নয়। সাংগঠনিক দুর্বলতা, ক্লাব-কর্মকর্তা পর্যায়ে দ্বন্দ্বে বলতে দ্বিধা নেই হকির জীবন ওষ্ঠাগত। যদিও একসময় ক্রিকেটের চেয়েও বেশি স্বপ্ন দেখা হতো হকি নিয়ে। কিন্তু সব তামাদি হয়ে গেছে ফেডারেশনের অদূরদর্শিতায়। বিশেষ করে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। ফলে অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে হকি। তবে বর্তমানে আবার জেগে ওঠার যে চেষ্টা চলছে সেখানেও দানা বেঁধেছে ক্ষমতার দাপট। ক্রীড়াপ্রেমী সংগঠকদের বিতাড়িত করে ক্ষমতা দখলের যে প্রক্রিয়া চলছে তাতে না আবার পথ হারিয়ে ফেলে দেশের এক সময়কার অপার সম্ভাবনার এই হকি। সেটাই দেখার। এমনটাই মনে করছেন ওয়াকেফহাল মহল। গত বছরের জুলাইয়ে চার বছর মেয়াদী নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু নতুন করে নির্বাচন করার উদ্যোগ নেয়নি ফেডারেশনে থাকা কর্মকর্তারা। বর্তমান এ্যাডহক কমিটির যুগ্ম সম্পাদক, সাবেক হকি তারকা মাহবুবুল এহসান রানা বললেন বিগত কয়েক মাস তো দেখার কেউ ছিল না ফেডারেশনে। আমরা দু’চারজনেই চালিয়েছি ঠেকার কাজ। এভাবে তো আর এত বড় ফেডারেশন চলে না। ফলে ফেডারেশনের কার্যক্রম সচল রাখতে সম্প্রতি গঠন করা হয়েছে ৩১ সদস্যের অস্থায়ী কমিটি। উল্লেখ্য, ফেডারেশনের সভাপতি বরাবরই সরকার মনোনীত। বর্তমান কমিটিতেও তাই। বড় ধরনের ঝাড়পোছ দিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কর্তৃক গঠিত এই এ্যাডহক কমিটিতে জায়গা হয়নি হকির বর্তমান সময়ের সবচেয়ে দরদী স্পন্সর সফিউল্লাহ আল মুনীরের। বাদ পড়েছেন আগের কমিটির প্রায় হাফডজন কর্মকর্তা/সদস্য। যাদের অনেকেরই অবদান রয়েছে হকির জেগে ওঠার প্রয়াসে। তবে সবাই বিস্মিত হয়েছেন নির্বাচিত কমিটির সহসভাপতি সফিউল্লাহ আল মুনীরের নাম এ্যাডহক কমিটিতে না থাকায়। ঠিক যেমনটা বাদ পড়েছিলেন এক সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক খন্দকার জামিল উদ্দিন। অথচ মৃতপ্রায় হকি জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে খন্দকার জামিলই প্রথম হাল ধরেছিলেন। জনপ্রিয় এই খেলার উন্নতির লক্ষ্যে নিজ উদ্যোগে হকির সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন অনেক নামী-দামী স্পন্সর। কার্পণ্য করেননি প্রয়োজনে নিজের পকেটের অর্থ খরচেও। জামিলের বদৌলতে ইউরোপে প্রশিক্ষণ ও খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন অনেক তারকা খেলোয়াড়। কিন্তু রাজনীতির শিকার হয়ে ফেডারেশন ছাড়তে হয়েছিল এই খন্দকার জামিলকে। এতে অবশ্য তার ক্ষতি হয়নি। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের হকির। ঠিক একইভাবে সফিউল্লাহ আল মুনীরের অনাকাক্সিক্ষত বিদায় সুখকর হয়নি হকির জন্য। তবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এ্যাডহক কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছেন খুনী তারেক এ আদেল। নতুন এই কমিটিতে তারেক আদেলের জায়গা পাওয়া আর সফিউল্লাহ আল মুনীরের বাদ পড়া সরস আলোচনার খোরাক তৈরি করেছে হকি অঙ্গনে। বিএনপি শাসনামলে ২০০০ সালে ঢাকার সাবেক ডেপুটি মেয়র জাহাঙ্গীর আদেলের বাড়িতে পাকিস্তানী পতাকা ওড়ানোর প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ নেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক কামাল হোসেন খুন হয়েছিলেন। প্রায় ১৮ বছর আগে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় জাহাঙ্গীর আদেলের পুত্ররা এই হত্যাকা- ঘটিয়েছিল। তাদের একজন এই তারেক এ আদেল। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীন বাংলাদেশের ওই বাড়িতে সে সময় ওড়ানো হয়েছিল পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা। হত্যাকা-ের ঘটনায় পুলিশ গ্রেফতার করেছিল জাহাঙ্গীর আদেলের দুই পুত্র পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মোনায়ের খানের নাতি জোবায়ের আদেল, তারেক আদেল ও তাদের দেহরক্ষী পাপ্পুকে। বিক্ষুদ্ধ জনতা আদেলের বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল। যার অন্যতম প্রতিবাদকারী ছিলেন কামাল হোসেন। নিহত কামাল তৎকালীন আওয়ামী লীগের ৬৭নং ওয়ার্ডের সভাপতি ছিলেন। বাড়িতে হামলা ও পাকি পতাকা উড়ানোর প্রতিবাদ করায় গুলি করে নির্মমভাবে কামালকে খুন করেন জাহাঙ্গীর আদেশের দুই পুত্র। পরবর্তীতে সাজা হলেও তারা খালাস পেয়ে যান তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের উদারতায়। হকি ফেডারেশন সূত্রে জানা গেছে খুনী তারেক এ আদেল কমিটিতে এসেছেন ক্লাব কোটায়, পুরনো ঢাকার ঊষা ক্রীড়াচক্রের প্রতিনিধি হিসেবে। তারপরও খুনী বলে কথা। খুনী জায়গা পায়। অথচ কমিটির তালিকায় কাঁচিকাটা হয়ে গেলেন সফিউল্লাহ আল মুনীরের মতো নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক, সাবেক তারকা খেলোয়াড় রফিকুল ইসলাম কামালসহ অনেকে। আঠারো বছর আগের এই ঘটনার নায়ক তারেক আদেলের আপন ভাই সাজেদ এ আদেলও রয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের গঠিত এই এ্যাডহক কমিটিতে। উল্লেখ্য, জাহাঙ্গীর আদেল যুদ্ধাপরাদের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপন চাচা শ্বশুর। স্বাধীনতার সপক্ষের দল আওয়ামী লীগের শাসনামলে হকির কমিটিতে বিতর্কিত দুই ভাইয়ের অন্তর্ভুক্তি কিভাবে সম্ভব? মেনে নিতে পারছেন না কেউ। ফলে গোটা ক্রীড়াঙ্গনে বইছে তীব্র সমালোচনার ঢেউ।
×