ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কাফনের কাপড় পরার হুমকি

প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট আশ্বাস সত্ত্বেও অনড় শিক্ষকরা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট আশ্বাস সত্ত্বেও অনড় শিক্ষকরা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও ও জাতীয়করণে পরিকল্পনার কথা স্পষ্ট করে জানালেও অনশনে অনড় শিক্ষকদের একটি অংশ। সরকারী টাকায় বেতনপ্রাপ্ত এ আন্দোলনকারীদের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর কথায় জাতীয়করণের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নেই। এখনই তারা দাবি পূরণের ঘোষণা চান। অনশনকারীরা দু’এক দিনের মধ্যে উল্টো কাফনের কাপড় পরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে যাওয়া ও এসএসসি পরীক্ষা বর্জনের মতো কর্মসূচীরও হুমকি দিয়েছেন। তবে প্রধামন্ত্রীর ঘোষণার পরও এভাবে ক্লাশ বন্ধ করে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বসে থাকায় এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, অনশনকারীদের মধ্যে ‘ভাড়ায় খাটা’ বহিরাগতরাও যুক্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিকানাও বলতে ব্যর্থ হচ্ছেন! যাদের ডাকে আন্দোলন সেই সংগঠনগুলোর জোট ‘বেসরকারী শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরামের’ নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় জাতীয়করণের সুনির্দিষ্ট কোন আশ্বাস নেই। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দাবি মানার বিষয়ে কিছু বলেননি প্রধানমন্ত্রী। তাই তারা অনশন প্রত্যাহার করবে না। ফোরামের নেতারা নিজেদের সরকার সমর্থক ও মুুক্তিযুৃদ্ধের পক্ষের লোক বলে দাবি করলেও আন্দোলনে শিক্ষকদের বাইরের ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করছেন। তাদের দাবি, ‘যারা প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিকানা বলতে পারছেন না তারা হয়তো ভয়ে বলতে সাহস পান না।’ এর আগে কয়েকদিন আগে একই স্থানে টানা ১১ দিন ধরে প্রতিষ্ঠান এমপিও‘র দাবিতে অনশনকারীদের অবস্থান নিয়েও শেষ পর্যায়ে আনা প্রশ্ন সামনে চলে আসে। দেখা যায়, অনশনকারীদের অনেকেই তাদের প্রতিষ্ঠান ও ঠিকানার কথা বলতেও পারেননি। শিক্ষকরাই বলছেন, নন-এমপিও যেসব শিক্ষক আন্দোলন করেছেন তাদের অনেকেই ১০ থেকে ১৫ বছর আগে কোন প্রতিষ্ঠানে কোনমতে কাজ করেছেন। যাদের নেই নিয়োগের কোন যোগ্যতা, নেই কোন নিয়োগ পরীক্ষাও। অনেকেই আছেন যারা ১০-১২ বছর ধরে সে প্রতিষ্ঠানের কাছেও যান না। এখন নেতারা বলেছেন তাই আন্দোলনে নেমেছেন। আশা যদি সরকারী বেতন বা অন্য সুবিধা পাওয়া যায়। তার পরেও সরকার শেষ পর্যন্ত নীতিমালা অনুসারে প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিলে তারা অনশন বন্ধ করেন। কিন্তু এরপরই শুরু হয়েছে বেসরকারী শিক্ষা জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে সরকারী অর্থে বেতন চলা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের একটি অংশের আমরণ অনশন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী এমপিও এবং জাতীয়করণ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছেন। জাতীয় সংসদে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সংসদ অধিবেশনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি ও জাতীয়করণ সরকারের বিবেচনায় রয়েছে বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা নীতিমালার ভিত্তিতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে যাচ্ছি। স্কুল সরকারীকরণ ও এমপিওভুক্তি নীতিমালার ভিত্তিতেই হবে। কোন স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী কত, পাওয়ার যোগ্য কিনা দেখতে হবে। আমরা আশ্বস্ত করেছি, নিশ্চয়ই আমরা বিবেচনা করব, পরবর্তী বাজেট যখন আসবে তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারব। তিনি আর বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা প্রায় ৩৬ হাজার স্কুল সরকারীকরণ করেছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তখন আমরা ২৬ হাজার স্কুল সরকারী করে দিয়েছি। তখন কিন্তু একটা কথা ছিল, আর কোনো স্কুল সরকারীকরণের জন্য দাবি করা যাবে না, এমপিওভুক্ত করলেই হবে। এরপর বেশকিছু স্কুল এমপিওভুক্ত করে দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে জাতীয়করণ ও এমপিও করার বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনার কথা উঠে আসার পর শিক্ষকদেরই অনেকে আশা প্রকাশ করেছিলেন হয়তো অনশন কর্মসূচী তুলে নেয়া হবে। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট নন জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষকরা। তারা অনশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে চতুর্থ দিনের মত অনশন পালন করেছেন তারা। জাতীয়করণের দাবিতে গত ১০ জানুয়ারি থেকে আন্দোলনে নামেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। ১৫ জানুয়ারি থেকে তারা প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তার পাশে পাটি বিছিয়ে গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে বসে আমরণ অনশন পালন করে যাচ্ছেন। আন্দোলনে ৬৭ জন শিক্ষক-কর্মচারী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলেও বলছেন শিক্ষক নেতারা। কেউ কেউ পার্শ্ববর্তী হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে আবারও আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। অনেক শিক্ষকের শরীরে স্যালাইন লাগিয়েই তারা অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ মাইকে তাদের দাবি পূরণে আন্দোলন চালিয়ে যেতে উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষকদের এ অংশটির এমন অনড় অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। জাতীয়করণের মতো একটি বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়ে এভাবে রাতারাতি সরকারী ঘোষণা দাবি করে আমরণ অনশনে অনড় থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকরাও। একই সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বহিরাগত ব্যক্তিরাও রাতে অবস্থান নিয়ে থাকছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দিনভর যারা অবস্থান নিয়ে আছেন তাদের মধ্যেই শিক্ষক নয় এমন ব্যক্তি থাকছেন বলে অভিযোগ পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার বিকালে অনশনস্থলে কথা বলতে গেলেও এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। এক শিক্ষকের কাছে তাদের দাবি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, জাতীয়করণ ছাড়া আমরা ক্লাসে যাব না। আন্দোলন চলবে। নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানান তিনি। এসময় তার কাছে তার প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে চাইলেই বাধে বিপত্তি। কোথা থেকে এসেছেন? আপনার প্রতিষ্ঠানের নাম কী? প্রশ্ন করতেই তিনি চেয়ে থাকেন পাশে থাকা আন্দোলনকারীদের দিকে। কয়েকজন এসময় বলেন, নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কেন জিজ্ঞেস করতেই তারা বলেন, নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানাতে হবে। অপর এক শিক্ষক অবশ্য নিজেকে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একটি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দেন। এ শিক্ষকের কাছে বহিরাগত ব্যক্তিরাও কর্মসূচীতে এসেছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, তা তো আমি জানি না। নেতারা বলেছেন তাই এসেছি। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য রাতে মোবাইলে দেখেছি। আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন বাসায় চলে যাব। প্রধানমন্ত্রীতো তার ইচ্ছার কথাই বলেছেন। তবে অনড় অবস্থানের কথা জানালেন নেতারা। লিয়াজোঁ ফোরামের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল খালেক বলেন, জাতীয়করণ ছাড়া আমরা ঘরে ফিরে যাব না। অনশন চলবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সুস্পষ্ট নয়। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস না আসায় সোমবার থেকে দেশের ২৬ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীরা আমরণ অনশনে নামছেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও শিক্ষক-কর্মচারী সংগ্রামী ঐক্যজোটের প্রধান সমন্বয়কারী মোঃ নজরুল ইসলাম রনি এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির মহাসচিব মোঃ রবিউল আলম এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছেন-শীর্ঘই দাবি না মানা হলে কাফনের কাপড় পরে লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সামনে অবস্থান নেয়া হবে। নজরুল ইসলাম রনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা সরকারের পক্ষের শিক্ষক। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট কোন ঘোষণা নেই। তাই অনশন চলবে। আমরা দাবি আদায়ে কাফনের কাপড় পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাওয়ার কর্মসূচি দেব। এসএসসি পরীক্ষা বর্জনের চিন্তাও আছে আমাদের। আন্দোলনকারীদের মধ্যে বহিরাগত থাকা ও নিজের প্রতিষ্ঠানের নাম পরিচয় দিতে ব্যর্থ হওয়া প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে এ নেতা বলেন, এমনতো হওয়ার কথা নয়। তবে অনেকে নিজের নাম পরিচয়, প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে হয়তো সাহস পান না। আমি আজই বলে দিচ্ছি সকলে ঠিকানা বলবা। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক ঘোষণার পর জাতীয়করণের আন্দোলনের কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবার পক্ষে অন্য অনেক শিক্ষক সংগঠন। স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শাজাহান আলম সাজু বলছিলেন, জাতীয়করণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ইতিবাচক। তার বক্তব্যেই জাতীয়করণের পরিকল্পনার বিষয়টিতো চলে এসেছে। এ অবস্থায় আমাদের আন্দোলন নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবা দরকার। কোন হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করা উচিত নয়। আন্দোলন নিয়ে যেন কেউ প্রশ্ন তোলার সুযোগ না পায়।
×