ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

৬২ মন্ত্রণালয় ও দফতরের অংশগ্রহণ

বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র উন্নয়নমেলায়

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র উন্নয়নমেলায়

এম শাহজাহান ॥ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতির উদীয়মান বাঘ’। দ্রুত বদলে যাওয়া বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর এই মূল্যায়ন যে অমূলক নয়, সেই জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে এবার উন্নয়ন মেলায়। ২০০৯ থেকে ২০১৭ অগ্রযাত্রার নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিন বদলের সনদ হিসেবে জাতির সামনে রূপকল্প ২০২১ উপস্থাপন করেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, এরপর থেকে সত্যিই ম্যাজিকের মতো দ্রুত বাংলাদেশের দিন বদলে যেতে থাকে। বিশ্বের ১১ উদীয়মান অর্থনীতির দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। বলা হচ্ছে, ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে আসবে। বিকাশমান তথ্য প্রযুক্তি খাত দেশকে নিবিড় শ্রম-সহায়ক অর্থনীতি হইতে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে যুক্ত করেছে। বাংলাদেশের লক্ষ্য এখন আরও বিস্তৃত, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ উন্নীত হওয়া এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশের স্বপ্নপূরণ। এই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এদিকে, টানা তিনদিনের উন্নয়ন মেলায় এবার পুরো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চিত্র ফুটে উঠেছে। সরকারের ৬২ মন্ত্রণালয় এবং দফতর গত নয় বছরে কি কাজ করেছে এবং আগামীতে তাদের কি পরিকল্পনা সবই প্রকাশ করা হয়েছে উন্নয়ন মেলায়। মেলায় গিয়ে এদেশের একজন সাধারণ মানুষও জানতে পেরেছেন বর্তমান বাংলাদেশকে। ভবিষ্যত বাংলাদেশ কেমন হবে তার একটি আগাম চিত্র পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে সরকারী কর্মকর্তাদের পাশাপাশি উন্নয়ন মেলার সাফল্য নিয়ে প্রশংসা করেছেন উদ্যোক্তা সম্প্রদায়। মেলা থেকে কি অর্জন হলো তারও একটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। জানতে চাইলে অথর্ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ মুসলিম চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস সামনে রেখে উন্নয়ন মেলা হয়ে গেল। এই মেলায় যারা এসেছেন, তারাই বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কর্মকা- এবং সেবা সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। সরকারের সব মন্ত্রণালয় এবং দফতর উন্নয়ন মেলায় অংশ নিয়েছে। ফলে পুরো বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র পাওয়া গেলে এবারের মেলায়। প্রতি মন্ত্রণালয় ও দফতর থেকে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- নিয়ে পৃথক পুস্তিকা, লিফলেট এবং আলাদা ব্রশিয়ার বের করা হয়েছে। উন্নয়ন মেলায় (২০০৯-১৭) অগ্রযাত্রার নয় বছর নিয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) বলছে, মানুষের আয় বাড়লে দেশের আয় বাড়ে। দেশের আয় বাড়লে বাজেট বাড়ে। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পরিসংখ্যান দিয়ে দফতরটি জানিয়েছে, ২০০০-০১ সালের তুলনায় ২০১৭-১৮ সালের বাজেট প্রায় ৯ গুণ বড় হয়েছে। মাথাপিছু গড় আয় ৪ গুণ বেশি হয়েছে। শুধু তাই নয়, গ্রামীণ যোগাযোগ, বিদ্যুত উৎপাদন, শিল্পসহায়ক অবকাঠামো নির্মাণসহ শিক্ষার আধুনিকায়ন, কমিউনিটি ক্লিনিক পুনরুজ্জীবন, গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানোন্নয়নসহ সরকারের অনেক কর্মসূচী বাংলাদেশকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দারিদ্র্য দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। পল্লী ও সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল বিশ্বের রোল মডেল। দেশের বেশিরভাগ প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলের জনগণ নিজগ্রাম থেকে সর্বোচ্চ দুই কিলোমিটারের মধ্যে পাকা সড়ক পায়। যে সড়ক দিয়ে সহজেই সেই ব্যক্তি মহাসড়কে উঠতে পারেন। বিশ্ব ব্যাংকের সমীক্ষায় একে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের এসব উন্নয়ন কর্মকা- নসাৎ করে দেশকে বরাবরই পেছনের দিকে ঠেলে দিতে তৎপর রয়েছে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। বিএনপি-জামায়াতের সহায়তায় এসব সন্ত্রাসীরা কখনও কখনও মাথাচারা দিয়ে উঠছে। হলি আর্টিজান হত্যাকা-ের পর বিদেশী উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারের অনেক কাজ করতে হয়েছে। এছাড়া মুদ্রা জাল, সোনা চোরাচালান, মানিলন্ডারিং ও জঙ্গী অর্থায়নের মতো বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে সরকারের সামনে। এসব বাধা দূর হলে উন্নয়নের রোল মডেল হবে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত সম্প্রতি জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, গত ৪০ বছরে মৌলবাদের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নিট মুনাফা হয়েছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। এর বেশিরভাগ টাকা সরাসরি ব্যয় হয়েছে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গী কর্মকা-ে। বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা উগ্র রূপ ধারণ করেছে। শুধু তাই নয়, মৌলবাদের অর্থনীতি ও সংশ্লিষ্ট রাজনীতি আমাদের মূল চেতনার বিরুদ্ধে কাজ করছে। তাই বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে মৌলবাদের অর্থনীতি আগে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। এদিকে, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, আর্থ-সামাজিক অর্জনে বর্তমান সরকার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। উন্নয়ন মেলা উপলক্ষে আর্র্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি তুলে ধরেছে বিডা। আর্থ-সামাজিক অর্জন ২০১৬-১৭ ॥ গত ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের রেকর্ড অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে সব রেকর্ড ভঙ্গ করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। গত বছর ছিল ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। এছাড়া জাতীয় মাথাপিছু আয় ২০০৬ অর্থবছরে ৫৪৩ মার্কিন ডলার হতে ২০১৬ সালে ১৬১০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০০৬ সালের তুলনায় রফতানি ১০ দশমিত ৫৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩৮ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ দশমিক ৪৮ থেকে বেড়ে ৩৩ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান হয়েছে ৩২ দশমিত ৪৮ শতাংশ। এছাড়া ব্যাপকভিত্তিতে কর্মসংস্থান তৈরিতে জিডিপির ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশ আবার বিনিয়োগ করা হয়েছে। গত ২০০৬ সালে বিএনপির শেষ সময়ে দেশে বিদ্যুত উৎপাদন হয়েছে ৫ হাজার ২৪৫ মেগাওয়াট। আর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে রেকর্ড বিদ্যুত উৎপাদন হয়েছে। বর্তমান ১৫ হাজার ৩৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে। বিদ্যুতের আরও বড় কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। এসব প্রকল্প থেকে বিদ্যুত পাওয়া গেলে নতুন শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। ইতোমধ্যে এলএনজি টার্মিনাল, ওষুধ শিল্পপার্ক, মেট্রোরেল, রূপপুর পাওয়ার প্লান্ট, প্লাস্টিক শিল্প, চামড়া শিল্প, এলপিজি গ্যাস, পদ্মা সেতু, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, আইসিটি, তৈরি পোশাক শিল্প এবং পায়রা বন্দর উন্নয়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বিডার মতে, উন্নয়নের রোল মডেল শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে বিনিয়োগ করুন, নিজে সমৃদ্ধ হোন এবং দেশকে সমৃদ্ধ করুন। ২০০৬ সালের সঙ্গে তুলনা করে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের অর্থনীতি কোন পর্যায়ে রয়েছে তার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছে বিডা। প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল ৬৬ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে ৭১ দশমিক ৬ উন্নীত, দারিদ্র্যের হার ৩৮ দশমিক ৪ থেকে নেমে ২৩ দশমিক ২ শতাংশ, স্বাক্ষরতার হার ৫২ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে ৭১ শতাংশ, শিশু মৃত্যুহার ৪৮ থেকে নেমে ২৮ জনে এবং খাদ্য উৎপাদন ২ কোটি ৭৯ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ৩ কোটি ৮৮ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিডা। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ সফরে এসে এদেশকে এশিয়ার পরবর্তী উদীয়মান বাঘ বলেছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কৌশিক বসু। তার মতে, বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশে অর্থনীতির সূচকগুলো এগিয় যাচ্ছে। এক দশক আগেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি চিন্তা করা যেত না, আজ বাংলাদেশ তা করে দেখাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য দুটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছেন, এদেশে অবকাঠামো দুর্বলতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বড় দুই চ্যালেঞ্জ। তবে এটা ঠিক যে অবকাঠামো দুর্বলতা কাটানো খুব সহজ নয়। এতে অর্থও প্রয়োজন। অন্যদিকে ডুইং বিজনেস প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ব্যবসার খরচ কমাতে হবে। সব দেশ ও সংস্থার আমলাতন্ত্র থাকে। তবে এটি দেখতে হবে যে আমলাতন্ত্র কত দ্রুত কাজ করে। জানা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, স্যাটেলাইট ও পরমাণু ক্লাবে যোগদান, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের মতো মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সাফল্য এখন বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর কাছে রীতিমতো রহস্য। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যমতে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। এক্ষেত্রে অনেক উন্নত দেশের চেয়েও বাংলাদেশ ভাল অবস্থানে রয়েছে। জাপানের মতো দেশও এখন বাংলাদেশের পেছনে। বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে পৃথিবীতে চতুর্থ। হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনে বৈশ্বিক গড় পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। শুধু ধান নয়, গম ও ভুট্টায়ও বিশ্বের গড় উৎপাদন পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। বিশ্বে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের প্রথম। বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। মাছ চাষে বাংলাদেশ এখন শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, ১০ বছর ধরে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে। সব মিলিয়ে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ তৈরি করছে।
×